কক্সবাংলা ডটকম(২৫ আগষ্ট) :: রোহিঙ্গা সম্প্রদায়কে বাস্তুচ্যুত করার ১ বছর আজ। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্য থেকে সেনাবাহিনীর নির্মম নির্যাতন থেকে বাঁচতে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে শুরু করে লাখ লাখ রোহিঙ্গা। পরে তাদের ফেরত নিতে কয়েক দফা বৈঠকের পর চলতি বছরের শুরুতেই মিয়ানমারের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক চুক্তি স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ। চুক্তির শর্ত অনুসারে তালিকা ধরে ধাপে-ধাপে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার কথা।
প্রথম দফায় প্রত্যাবাসনের জন্য মিয়ানমারের কাছে ৮ হাজার ৩২ জনের তালিকা হস্তান্তর করে বাংলাদেশ। তবে ওই তালিকা থেকে একজনকেও ফেরত নেয়নি মিয়ানমার। বর্তমানে তাদের প্রত্যাবসনের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট করে কোনো দিনক্ষণও বলতে পারছেন না কেউই।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিয়ানমার সফর করে আসার পর পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক বলেন, আমরা মিয়ানমার গিয়ে রাখাইনে বিভিন্ন গ্রাম পরিদর্শন করেছি। মিয়ানমারের প্রস্তুতি দেখেছি।
আমরা সন্তুষ্ট। কবে থেকে প্রত্যাবাসন শুরু হবে প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, এটি এমন একটি জটিল বিষয় যেটা আগে থেকে সুুনির্দিষ্ট করে দিন তারিখ বলা যায় না। তবে আমরা আশাবাদী রোহিঙ্গারা তাদের নিজ দেশে ফিরতে পারবে। এ প্রক্রিয়াটি দীর্ঘমেয়াদি।
তিনি জানান, আগামী মাসে যুক্তরাষ্ট্র জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে সভাপতিত্ব করবে, তারা এ সংকট তুলে ধরার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সেপ্টেম্বরে নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ সভাতেও এ বিষয়ে আলোচনা হবে।
২০১৭ সালের ২৪ আগস্ট রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে গঠিত আনান কমিশন তাদের প্রতিবেদন পেশ করে। ‘রাখাইনের জনগোষ্ঠীর জন্য একটি শান্তিপূর্ণ, ন্যায্য ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের পথে’ শীর্ষক ৬৩ পৃষ্ঠার ওই প্রতিবেদনে ৮৮টি সুপারিশ কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।
এতে রাখাইনে জঙ্গিবাদের ঝুঁকি এড়িয়ে শান্তি ফিরিয়ে আনতে হলে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষকে রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ও চলাফেরার ওপর বিধিনিষেধ তুলে নেওয়ার কথা বলা হয়।
জাতিসংঘের সাবেক মহাসচিব কফি আনানের নেতৃত্বে গঠিত কমিশন এও বলেছে, রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব যাচাইয়ে একটি নির্দিষ্ট কৌশল ও সময়সীমা ঠিক করতে হবে, যা হবে স্বচ্ছ ও বিদ্যমান আইনের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ।
আনান কমিশনের প্রতিবেদন জমার পর দিনই ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের সেনাচৌকিতে সন্ত্রাসী হামলা হয় বলে দাবি করে মিয়ানমার সরকার। হামলায় পুলিশসহ নিরাপত্তা বাহিনীর ১২ সদস্য নিহত হওয়ার তথ্যও প্রকাশ করা হয়।
এর পরই রাখাইন রাজ্যে মিয়ানমার সেনাবাহিনী সর্বাত্মক অভিযান শুরু করে। সেখানে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ আসে। প্রাণ বাঁচাতে রোহিঙ্গারা স্রোতের মতো বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে থাকে।
বাংলাদেশও সে সময় মানবিক দিক বিবেচনায় সীমান্ত খুলে দেয়। ২৫ আগস্টের পর প্রায় সাড়ে ছয় লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করে। আগে থেকেই বাংলাদেশে আছে তিন লাখের মতো রোহিঙ্গা। সব মিলিয়ে ১০ লাখের মতো রোহিঙ্গার বোঝা এখন বাংলাদেশের মাথায়।
নিবন্ধন কার্যক্রম সম্পন্ন : রাখাইন থেকে আসা রোহিঙ্গাদের নিবন্ধনে আনার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। সে অনুযায়ী নিবন্ধন প্রক্রিয়া শুরু হয়। রোহিঙ্গারা কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের ১২ অস্থায়ী ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়। এসব ক্যাম্পে ১১ লাখ ১৯ হাজার রোহিঙ্গা নিবন্ধন করে।
আন্তর্জাতিক চাপ : রোহিঙ্গা ইস্যুতে ব্যাপক আন্তর্জাতিক চাপের মুখে পড়ে মিয়ানমার। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা রাখাইনে গণহত্যার কড়া সমালোচনা করে সমস্যা সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানায়। এ ছাড়া সমস্যার সমাধানে যে কোনো উদ্যোগে বাংলাদেশের পাশে থাকারও অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা। অব্যাহত চাপের মুখে কিছুটা নমনীয় হয় মিয়ানমার।
উ কিয়া তিন্ত সোয়ের বাংলাদেশ সফর : অব্যাহত চাপের মুখে অবশেষে নতিস্বীকার করে মিয়ানমার। রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে আলোচনার জন্য বাংলাদেশে আসেন মিয়ানমারের স্টেট কাউন্সেলর অং সান সু চির দপ্তরের মন্ত্রী উ কিয়া তিন্ত সোয়ে। গত বছরের ২ অক্টোবর পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলীর সঙ্গে বৈঠক করেন তিন্ত সোয়ে।
বৈঠকে সেনাবাহিনীর নির্যাতন-হত্যা আর ধর্ষণের মুখে রাখাইন রাজ্য থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ রাজি হয়েছে বলে সে সময় জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী।
মন্ত্রী জানান, এ জন্য বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে একটি যৌথ ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করা হবে। দুই দেশের প্রতিনিধিদের নিয়ে শিগগিরই এ কমিটি হবে। তার আগে বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মিয়ানমার সফর করবেন।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মিয়ানমার সফর : মিয়ানমার সরকারের আমন্ত্রণে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল মিয়ানমারে যান। সফরে তিনি বাংলাদেশের ৯ সদস্যের একটি প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন। সফরকালে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সে দেশের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অং সান সু চিসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গেও বৈঠক করেন। দেশে ফিরে সংবাদ সম্মেলনে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে এসে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের ফেরত নেবে না, এমন কথা মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ কখনই বলেনি। বৈঠকে রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার বিষয়ে সু চিসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের ইতিবাচক মনোভাব দেখা গেছে।
সমঝোতা স্মারক সই : গত ২৩ নভেম্বর রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফেরত পাঠাতে মিয়ানমারের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই করে বাংলাদেশ। স্মারকে দুই মাসের মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু করার কথা বলা হয়। তবে কবে সেই প্রক্রিয়া শেষ হবে, তা নিয়ে সময়সীমার উল্লেখ নেই।
সে সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী জানান, সমঝোতা স্মারক প্রথম পদক্ষেপ, দুই দেশকে এখন পরের ধাপে যেতে হবে। সমঝোতা স্মারকে তিন সপ্তাহের মধ্যে জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ ও আগামী দুই মাসের মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া মাঠপর্যায়ে শুরুর কথা বলা হয়।
জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন : প্রত্যাবাসন চুক্তির ২৬ দিনের মাথায় ১৯ ডিসেম্বর জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠিত হয়। দুই দেশের ১৫ জন করে সদস্য নিয়ে মোট ৩০ সদস্যের সমন্বয়ে এ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হয়। দুই দেশের পররাষ্ট্র সচিব জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপে নিজ দেশের নেতৃত্বে আছেন।
প্রত্যাবাসনবিষয়ক জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ (জেডব্লিউজি) বা যৌথ কার্যকরী দলসংক্রান্ত টার্মস অব রেফারেন্স এমনভাবে করা হয়েছে, এখন থেকে ওই কমিটিই পরবর্তী প্রয়োজনীয় চুক্তি-প্রটোকল থেকে শুরু করে টেকনিক্যাল কমিটি, সাব-কমিটি গঠনসহ সব কিছু করতে পারবে। তবে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ায় দ্বিপক্ষীয় চুক্তি কভার করে না এবং নীতি বা পলিসি সংক্রান্ত কোনো বিষয়ে সিদ্ধান্তের প্রয়োজন হলে দুই দেশের রাজনৈতিক লেভেলে আলোচনা হবে।
সম্মতিপত্র মতে, জেডব্লিউজির সঙ্গে যুক্ত দুই দেশের কর্মকর্তারা পূর্বানুমতি সাপেক্ষে সীমান্তের দুই পাশেই যেতে পারবেন। সেখানে সাংবাদিকদের পুরো প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণের সুযোগ রাখার বিষয়ে সম্মত হয় দুপক্ষ। মিয়ানমারের ৯ এবং বাংলাদেশের ১১ সদস্যের উপস্থিতিতে পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠক এবং সই হওয়া সম্মতিপত্রে রোহিঙ্গাদের ডিসপ্লেসমেন্ট মিয়ানমার রেসিডেন্ট বা বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের বাসিন্দা হিসেবে উল্লেখ করা হয়।
মিয়ানমারের বারবার সুর বদল : বারবার সুর বদল করার কারণে ২০১৮ সালের ২২ জানুয়ারির মধ্যে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া মাঠপর্যায়ে শুরু করার বাধ্যবাধকতা থাকলেও বাস্তবায়ন হয়নি। সে সময় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মাঠপর্যায়ে গঠিত কারিগরি কমিটির প্রস্তুতি সম্পন্ন না হওয়ার কথা বলা হয়। এ বছরের ১৬ জানুয়ারি মিয়ানমারের নেপিদোতে, রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের লক্ষ্যে মাঠ পর্যায়ের কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণে ৩০ দফা ফিজিক্যাল অ্যারেঞ্জমেন্টে সম্মত হয় বাংলাদেশ ও মিয়ানমার। সে লক্ষ্যে টার্মস অব রেফারেন্সের সম্মতিপত্রে সই করেন দুদেশের জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের প্রধান।
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, রোহিঙ্গা যাচাই-বাছাই ও প্রত্যাবাসনের জন্য মাঠপর্যায়ে কাজ করবে দুটি কারিগরি ওয়ার্কিং গ্রুপ।
জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের পর সংবাদ সম্মেলেন করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। তিনি বলেন, দুই দেশের যৌথ ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠন করা হয়েছে। আশা করছি খুব দ্রুত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন শুরু হবে। কিন্তু জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপ গঠনের কিছুক্ষণের মধ্যেই মিয়ানমার তাদের অবস্থান পরিবর্তন করে।
জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠক সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ : এ বছরের ১৭ মে প্রত্যাবাসনের জন্য গঠিত জয়েন্ট ওয়ার্কিং গ্রুপের বৈঠক কোনো ধরনের সুনির্দিষ্ট সিদ্ধান্ত ও সমাধান ছাড়াই শেষ হয়। ফলে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে অনিশ্চিয়তা সৃষ্টি হয়। এর মধ্যেই বৈঠকে যাচাই-বাছাইয়ের জন্য নতুন করে রোহিঙ্গাদের আরও একটি তালিকা হস্তান্তর করা হয়।
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর রাখাইন রাজ্য পরিদর্শন
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের সর্বশেষ অবস্থা দেখতে গত ৮ আগস্ট মিয়ানমার সফর করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। তিনি রাখাইন রাজ্যের মংডু এলাকা পরিদর্শন করেন। দেখতে যান ৩০ হাজার লোকের ধারণক্ষমতাসম্পন্ন হ্লা পোই কংয়ের ট্রানজিট ক্যাম্পে। এর পর তিনি শোয়ে জার গ্রামে যান যেখানে ভারত সরকারের অর্থায়নে রোহিঙ্গাদের জন্য ১৪৮টি গৃহ নির্মাণ করা হয়েছে।
সফরকালে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিয়ানমারের বেশ কয়েকজন মন্ত্রী ও জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তার সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে প্রাথমিক প্রত্যাবাসনের জন্য নিজেরাই যাচাইকরণ ফরম পূরণ করবে বলে সম্মত হয় দুই দেশ। উভয় মন্ত্রীই রাখাইন রাজ্যের বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা ইস্যু সমাধানে তাদের অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেন।
Posted ২:৪৫ পূর্বাহ্ণ | শনিবার, ২৫ আগস্ট ২০১৮
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta