কক্সবাংলা ডটকম(২২ আগষ্ট) :: বাংলাদেশের কর্মকর্তারা বলেছেন, নভেম্বরে সই হওয়া প্রত্যাবাসন চুক্তির ১০ মাস পরেও প্রধান কোনো শর্তই মিয়ানমার বাস্তাবায়ন করেনি।
তারা বলছেন, দু’টি অভ্যর্থনা ক্যাম্প এবং একটি ট্রানজিট ক্যাম্প তৈরি করা ছাড়া কিছুই করেনি মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ।
মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সূ চি মঙ্গলবার সিঙ্গাপুরে এক বক্তৃতায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন আটকে থাকার জন্য কার্যত বাংলাদেশকে দায়ী করেছেন।
তার ঐ বক্তব্যে বাংলাদেশের একাধিক কর্মকর্তা ক্ষোভ ও বিস্ময় প্রকাশ করেছেন।
কক্সবাজারে আশ্রয় নিয়ে থাকা রোহিঙ্গা শরণার্থীদেরও অনেকে বলেছেন,তারা নিজের দেশে কোনো ক্যাম্পে থাকার জন্য ফিরে যেতে চাননা।
মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সূ চি সিঙ্গাপুরে এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, মিয়ানমার শরণার্থীদের নিতে প্রস্তুত, তাদের পুনর্বাসনের জন্য জায়গাও ঠিক হয়েছে। কিন্তু তাদের পাঠানোর দায়িত্ব মূলত বাংলাদেশের।
রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন শুরু না হওয়ার জন্য তিনি কার্যত বাংলাদেশকেই দায়ী করেছেন।
এ ব্যাপারে বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিক কোনো প্রতিক্রিয়া দেয়নি।
তবে আলাপকালে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উর্ধ্বতন একজন কর্মকর্তা বলেছেন, অং সান সূ চি-র এমন বক্তব্যকে দুর্ভাগ্যজনক বলে তিনি মনে করছেন।
বাংলাদেশ সরকারের রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবাসন বিষয়ক কমিশনার আবুল কালাম বলেছেন, মিয়ানমারের নেত্রীর বক্তব্যের সাথে বাস্তবতার কোনো মিল নেই।
“যেটা আসলে বাস্তব অবস্থা থেকে শত যোজন দূরে, এধরণের মন্তব্য সত্যিই খুব বিস্ময়কর এবং খুবই হতাশাজনক বটে।
গত বছরের নভেম্বরে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের ব্যাপারে মিয়ানমারের সাথে বাংলাদেশের চুক্তি হয়।
এরপর দুই দেশের কর্মকর্তাদের মধ্যে কয়েকদফা বৈঠক হয়েছে।
কিন্তু চুক্তি সইয়ের পর দশ মাসেও সেই চুক্তির প্রধান কোনো শর্তই মিয়ানমার বাস্তবায়ন করেনি বলে জানিয়েছেন আবুল কালাম।
তিনি বলেছেন, “মুল সমঝোতা চুক্তিতে পরিস্কারভাবে বলা আছে, তারা প্রত্যাবাসিত হবে তাদের নিজেদের গ্রামে। সম্ভব হলে স্বগৃহে। এবং কোনো কারণে যদি সেটি সম্ভব না হয়, তাহলে তাদের এমন স্থানে নিতে হবে, যেটি তাদের গ্রামের নিকটবর্তী। কিন্তু মিয়ানমার মোটাদাগে শুধু দু’টি অভ্যর্থনা ক্যাম্প এবং একটি ট্রানজিট ক্যাম্প তৈরি করেছে।”
আবুল কালাম আরও জানিয়েছেন, সপ্তাহ দেড়েক আগে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নেতৃত্বে তিনিসহ বাংলাদেশের যে প্রতিনিধি দল মিয়ানমার গিয়েছিল, সে সময় তাদের ঐ তিনটি ক্যাম্প তারা দেখিয়েছেন।
কক্সবাজারে কুতুপালং ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের একজন নেতা মো: নূর বলছেন, জমিজমা বা নিরাপত্তা এবং মর্যাদা নিশ্চিত না করে তারা ফিরে গেলে আবারও নির্যাতনের মুখে পড়তে হবে বলে তারা মনে করেন।
“আমাদের ফেরত নেয়ার বিষয় নিয়া কিছুই করে নাই মিয়ানমার সরকার। আমাদের ফেরত নেয়ার ব্যাপারে কোনো পরিকল্পনাই তারা করে নাই। এটা হইলো, দুনিয়াতে নাটক বানাইতেছে মিয়ানমার সরকার।”
স্বামীর হত্যাকান্ডের পর সন্তানদের নিয়ে দু’জন নারী গত বছরের অগাষ্টে মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে এসে কুতুপালং ক্যাম্পে আশ্রয় পেয়েছেন।
তাদের একজন হামিদা বলেছেন, মিয়ানমারে বিচ্ছিন্নভাবে তাদের দুই একজন আত্মীয় আছেন, তাদের কাছ থেকে তারা খবর পাচ্ছেন যে, মিয়ানমার সরকার তাদের ফেরত নিলে কোনো অধিকার না দিয়ে ক্যাম্পে রাখবে। তারা এভাবে কখনই যাবেন না বলে তিনি বলেন।
রোহিঙ্গা আরেক নারী বলছিলেন, তারা যেতে চান না।
তারা দু’জনই প্রশ্ন করেছেন, “তারা কীভাবে সেখানে যাবেন? যেখানে তাদের ঘরবাড়ি, নিরাপত্তা এবং মর্যাদাসহ কোনো অধিকারই নেই। তারা বাংলাদেশে ক্যাম্পে আছেন, নিজের দেশ মিয়ানমারে ফেরত গিয়েও তারা ক্যাম্পে থাকতে রাজি নন।”
রোহিঙ্গা শরণার্থীদের জন্য কাজ করে, এমন একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার শিউলী শর্মা মনে করেন, রোহিঙ্গাদের এখন ফেরত পাঠানো হলে তাদের আবারও আগুনের মুখে ঠেলে দেয়া হবে।
“শরণার্থীরাও মিয়ানমারে ফেরত যাওয়ার প্রশ্নে নিরাত্তাহীনতায় ভুগছে। আমরাও যারা তাদের সহায়তায় কাজ করছে, আমরাও এমন একটা পরিবেশে তাদের ফেরত পাঠাতে পারি না।”
রোহিঙ্গারা যাতে সব অধিকার নিয়ে স্বেচ্ছায় নেজের দেশে ফিরতে পারে, সেটা মিয়ানমারকেই নিশ্চিত করতে হবে বলে বিশ্লেষকরা মনে করেন।
সেনাসদস্যদের ‘মিষ্টি মানুষ’ আখ্যা দিলেন সু চি
মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি তার মন্ত্রিসভায় থাকা সেনাসদস্যদের ‘মিষ্টি মানুষ’ আখ্যা দিয়ে বলেছেন, সেনাবাহিনীর সঙ্গে তার সম্পর্ক খুব একটা খারাপ নয়। সামরিক জান্তাদের শাসনে প্রায় ১৫ বছর গৃহবন্দিত্বে কাটানো সু চি মঙ্গলবার সিঙ্গাপুরের একটি অনুষ্ঠানে এক বক্তব্যে সেনাবাহিনী নিয়ে একথা বলেন। তবে মিয়ানমারের শাসন-ক্ষমতায় নিরঙ্কুশ সেনা-কর্তৃত্বের কথা পরোক্ষে স্বীকার করেছেন সু চি। বলেছেন, ওই নিরঙ্কুশ ক্ষমতার লাগাম টেনে ধরতে সংবিধান সংশোধনের প্রয়োজন।
১৯৬২ সালে অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে ক্ষমতায় আসা সামরিক বাহিনী প্রায় ৫০ বছর মিয়ানমারের শাসনক্ষমতা নিজেদের পূর্ণাঙ্গ নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হয়। ২০১০ সালের শেষ দিকে এসে সামরিক শাসকরা ওই সময়কার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের নেত্রী সু চিকে গৃহবন্দিত্ব থেকে মুক্তি দেওয়ার পাশাপাশি সংস্কার কার্যক্রম শুরু করে। ২০১৫ সালের নির্বাচনে সু চির দল জয় পাওয়ার পর জেনারেলরা তার সরকারের হাতে দায়িত্ব ছেড়ে দিলেও শাসনক্ষমতার মূল কর্তৃত্ব এখনই নিজেদের হাতে রাখতে সক্ষম হয়েছে।
মিয়ানমারে আরেকটি সেনা অভ্যুত্থানের আশঙ্কা করছেন কিনা- এ প্রশ্নের জবাবে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, “সেনাবাহিনীর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক অতটা খারাপ নয়।” সু চি বলেন, “ভুলে যাবেন না, আমাদের মন্ত্রিসভায় তিন সদস্য আছেন যারা আদতে সামরিক বাহিনীর মানুষ, তারা জেনারেল। আর তারা সবাই মিষ্টি মানুষ।”সেনাবাহিনীকে নিয়ে সু চি এমন সময় এই ইতিবাচক মন্তব্য করলেন যখন ওই বাহিনীর বিরুদ্ধে রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত নিধনযজ্ঞ ও মানবতাবিরোধী অপরাধ ও গণহত্যার আলামত মিলেছে। জাতিসংঘসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন থেকে সেনাবাহিনীর ওইসব ভূমিকার আলামত তুলে ধরা হলেও সু চি নিজেও তা স্বীকার করতে নারাজ। রোহিঙ্গা প্রশ্নে সু চি সেনাবাহিনীর সুরেই কথা বলেন। তিনিও সেনাবাহিনীর মতো করে রোহিঙ্গাদের জাতিগত পরিচয় ও তাদের ওপর সংঘটিত নিপীড়নের কথা অস্বীকার করেন।
মিয়ানমারের সংবিধান অনুযায়ী এখেও দেশটিতে সেনাবাহিনীর অনেক প্রভাব রয়ে গেছে, নিষিদ্ধ রয়েছে সু চির প্রেসিডেন্ট হওয়ার সুযোগ। সংবিধান অনুযায়ী দেশটির পার্লামেন্টের এক চতুর্থাংশ আসন এখনও সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। স্বরাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা এবং সীমান্তসহ গুরুত্বপূর্ণ তিনটি মন্ত্রণালয়ে নিয়ন্ত্রণ অব্যাহত রেখেছে সেনাবাহিনী। এর অর্থ হচ্ছে দেশটির পুলিশের ওপরও নিয়ন্ত্রণ রয়েছে সেনাবাহিনীর।
শক্তিশালী জাতীয় প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা পরিষদের ১১টি আসনের মধ্যে ছয়টি আসনেও রয়েছেন সেনাবাহিনী মনোনীত ব্যক্তিরা। গণতান্ত্রিক সরকার বাতিলের ক্ষমতা রয়েছে এই পরিষদের। এছাড়া অনেক শীর্ষস্থানীয় পদ দখল করে আছেন সাবেক সামরিক কর্মকর্তারা। এই প্রেক্ষাপটে সিঙ্গাপুরে দেওয়া বক্তৃতায় সু চি স্বীকার করেছেন, দেশে গণতান্ত্রিক উত্তরণ প্রক্রিয়া ‘এখনো পুরোপুরি সম্পন্ন হয়নি।’ তবে সাংবিধানিক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে মিয়ানমারে সেনাবাহিনীর প্রভাব ধীরে ধীরে কমবে বলেও মন্তব্য করেন রাখাইনে সেনা অভিযানের বিরুদ্ধে উচ্চবাচ্য না করে সমালোচিত হওয়া নোবেলজয়ী নেত্রী সু চি।
বিশ্ববাসী সু চি কে মিয়ানমার সরকারের অন্তর্গত একজন মানুষ হিসেবেই দেখে না, দেখে শান্তির পক্ষের একজন অ্যাকটিভিস্টি আকারে। তাই রোহিঙ্গা প্রশ্নে তার নীরবতা নিয়ে বার বারই প্রশ্ন উঠেছে, আহ্বান এসেছে সরব হওয়ার। দক্ষিণ আফ্রিকার বিবেকের বাতিঘর হিসেবে স্বীকৃত ধর্মযাজক ও মানবাধিকার আন্দোলনের কর্মী ডেসমন্ড টুটু কিছুদিন আগে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে সরব হতে অং সান সু চি’র প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। গত বছরের সেপ্টেম্বরে অং সান সু চিকে উদ্দেশ্য করে সামাজিক মাধ্যমে পোস্টকৃত এক খোলা চিঠিতে টুটু প্রশ্ন করেন,নীরবতার মধ্য দিয়ে সু চি তার দেশের উচ্চ পদে আসীন হওয়ার রাজনৈতিক মূল্য চুকাচ্ছেন কিনা। যদি তাই হয়,তবে সে মূল্য খুব চড়া বলে সু চিকে সতর্ক করেন তিনি। তবে বিপুল পরিমাণ আন্তর্জাতিক সমালোচনা এবং উদ্বেগ প্রকাশের পরও সু চি তার অবস্থান থেকে সরে আসেননি।লক এবং সাবেক রাজনৈতিক বন্দি খিন জ উয়িন মনে করেন, অদূর ভবিষ্যতে দেশটি (মিয়ানমার) পূর্ণ গণতান্ত্রিক দেশে পরিণত হতে পারবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। তিনি বলেন, ‘তিনি নিজেকে সেনাবাহিনীর বন্ধনে বন্দি করে ফেলছেন কারণ দুই পক্ষই বোঝে তাদেরকে একসঙ্গে চলতে হবে। তার (সু চির) অতীত ও বর্তমান সবক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর ওপর তার প্রভাবের মাত্রা শূন্য।’