কক্সবাংলা ডটকম(২৬ ফেব্রুয়ারী) :: বাংলাদেশে গত বছর থেকে নতুন করে শুরু হওয়া রোহিঙ্গা সংকটের ছয় মাস পূর্ণ হয়েছে রোববার। গত বছর ২৫ আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশে এসেছে প্রায় সাত লাখ রোহিঙ্গা। দেশটিতে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের ফেরত নেয়ার বিষয়ে এ পর্যন্ত কয়েক দফায় বৈঠক হয়েছে বাংলাদেশ এবং মিয়ানমার সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের।
সার্বিকভাবে রোহিঙ্গা সংকটে এ ছয় মাসে কোন অগ্রগতি নেই, ফলাফল কেবল শূন্য। এসব বৈঠকে প্রাথমিকভাবে আট হাজারের মতো রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নিতে রাজি হয়েছে মিয়ানমার সরকার।
একই সাথে জিরো লাইনে আটকে পড়া আরো সাড়ে পাঁচ হাজার মানুষকে তারা ফিরিয়ে নেবে বলে বাংলাদেশের কর্মকর্তারা জানিয়েছে। কিন্তু সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে ফিরিয়ে নেয়া কতটা সহজ হবে তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। আনান কমিশন একটি রিপোর্ট দিয়েছে। সেটা বাস্তবায়ন হলে রাখাইনে ফিরে যেতে চায় রোহিঙ্গারা।
বাংলাদেশে বর্তমানে সরকারি হিসেবে সাত লক্ষের বেশি রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। বাংলাদেশ সরকার বরাবরই বলে এসেছে মানবিক কারণে তাদের আশ্রয় দেয়া হয়েছে কিন্তু দিন শেষে তাদের নিজের দেশ অর্থাৎ মিয়ানমারে ফেরত যেতে হবে।
ছয় মাসে সেই ফেরত যাওয়া বা প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার কতখানি এগিয়েছে? এমন প্রশ্ন এখন সবার। প্রায় প্রতিদিনই মিয়ানমার থেকে শত শত রোহিঙ্গা এখনো নির্যাতনের মুখে পালিয়ে বাংলাদেশে আসছে। আবার প্রায় প্রতিদিনই মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের নিরাপদ আশ্রয় দেয়ার কথাও বলছে। তবে মিয়ানমার একটু বেশিই তাড়াহুড়ো করছে, যদিও মিয়ানমারের রোহিঙ্গা ফেরত নেয়ার আন্তরিকতা ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রশ্নের মুখে পড়েছে।
জাতিসংঘ, ইইউ, হিউমেন রাইটস ওয়াচ, অ্যামনেস্টিসহ আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা এবং দাতা সংস্থাগুলো মনে করছে রোহিঙ্গা ফেরত নেয়ার মতো কোনো কার্যকর পদক্ষেপ এখনো মিয়ানমার গ্রহণ করেনি।
রোহিঙ্গা সহায়তায় জাতিসংঘের ১০ মাসের রেসপন্স প্ল্যান
মিয়ানমান থেকে প্রাণভয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের মানবেতর জীবনযাপন বিশ্ববাসী দেখেছে। এগিয়ে এসেছে জাতিসংঘসহ বিশ্বের নানা দেশ। রোহিঙ্গা পরিস্থিতি মোকাবিলায় আগামী ১০ মাসের জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যান প্রায় প্রস্তুত করেছে জাতিসংঘ।
চলতি বছর মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এ সময়ে যার ব্যয় ধরা হয়েছে, প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা। সবচেয়ে বেশি ব্যয় করা হবে, খাদ্য নিরাপত্তায়, গুরুত্ব পাচ্ছে অন্যান্য খাতও। প্রাকৃতিক বিপর্যয়সহ সন্ত্রাসবাদের মতো ইস্যুগুলোকে গুরুত্বের সাথে দেখা হচ্ছে।
জাতিসংঘের হিসাব বলছে, গত বছরের ২৫ আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত বাংলাদেশের আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা ৬ লাখ ৮৮ হাজার। আগে আসা রোহিঙ্গাসহ বর্তমানে বাংলাদেশে মিয়ানমারের এই বাস্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা ১৩ লাখ।
বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের জন্য গত বছরের সেপ্টেম্বরে ৬ মাসের একটি পরিকল্পনা নিয়েছিল জাতিসংঘ। যেখানে ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা।
সময়সীমা শেষ হচ্ছে এ মাসেই। তাই আগামী মাস থেকে নতুন জয়েন্ট রেসপন্স প্ল্যান প্রায় চূড়ান্ত করেছে সংস্থাটি। ডিসেম্বর পর্যন্ত ১০ মাসে ১২টি খাতে খরচ হবে প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা। সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ রাখা হয়েছে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের খাদ্য নিরাপত্তায়।
এরপর আছে স্বাস্থ্য, আশ্রয়কেন্দ্র পুনর্নির্মাণ ও অন্যান্য খাত। পানি, পয়ঃনিষ্কাশন ও ব্যবস্থাপনার জন্য বরাদ্দ আছে ৯৭৬ কোটি টাকা। এর বাইরে নিরাপত্তা, শিক্ষা, পুষ্টি খাতেও আলাদা আলাদা বরাদ্দ রাখা হয়েছে।
জাতিসংঘের এই নতুন পরিকল্পনায় আসছে বর্ষা মৌসুমকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু ঝুঁকির কথাও বলছে জাতিসংঘ। যেমন, ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসপ্রবণ হওয়ায় কক্সবাজারে রোহিঙ্গাসহ স্থানীয়দের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা কঠিন।
শরণার্থীদের নিরাপত্তায় সাইক্লোন শেল্টাা প্রস্তুত নয়। বর্তমান ক্যাম্পগুলোয় জলোচ্ছ্বাস ও পাহাড়ধসের আশঙ্কা। বৃষ্টিতে ক্যাম্পে চলাচল ও নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা। শরণার্থীদের মৌলিক চাহিদা নিশ্চিত না হওয়ায় সন্ত্রাসের ঝুঁকি। রোহিঙ্গাদের মধ্যে অপরাধের মাত্রা বেড়ে গেলে স্থানীয়দের ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষতি হওয়ারও কথা বলা হয়েছে জাতিসংঘের খসড়া প্রতিবেদনে।
রোহিঙ্গাদের জন্য মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত এই পুরো পরিকল্পনাটি এখনো খসড়া পর্যায়ে রয়েছে। আগামী মাসের মাঝামাঝি আনুষ্ঠানিকভাবে খসড়া তালিকাটি ঘোষণা করবে জাতিসংঘ।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমারের প্রতিশ্রুতি কৌশল মাত্র
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে বাংলাদেশকে দিয়ে গণমাধ্যমে প্রতিশ্রুতি দেয়া হচ্ছে যা আসলে মিয়ানমারের একটি কৌশল।এতে বিশ্ববাসীর কাছে ঢাকাকে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী হিসেবে উপস্থান করতে পারবে নেপিদো। এমনটাই মনে করেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক সাহাব এনাম খান।
আর শরণার্থীবিষয়ক বিশ্লেষক আসিফ মুনির বলছেন, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার সদিচ্ছা নেই মিয়ানমারের। তারা শুধু কালক্ষেপণ করছে। মোর্শেদ হাসিবের প্রতিবেদন।
রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে গণমাধ্যমে যতটা সরব বাংলাদেশ ঠিক বিপরীতে অবস্থান মিয়ানমারের। গেল শুক্রবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকসহ সরকারি পর্যায়ে দেশ দুটি একাধিকবার দ্বিপাক্ষিক আলোচনায় অংশ নিলেও কখনই গণমাধ্যমে কথা বলেননি দেশটির কেউ।
গণমাধ্যম এড়িয়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশকে বিশ্ববাসীর কাছে প্রতিশ্রুতি ভঙ্গকারী বানাবার চেষ্টা করছে মিয়ানমার। তবে শুক্রবারের বৈঠককে উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হিসেবে ভাবতে নারাজ এই বিশ্লেষক। তার মতে, রোহিঙ্গা ফিরিয়ে নিতে কালক্ষেপণ করতে চাইছে মিয়ানমার।
শরণার্থীবিষয়ক এই বিশ্লেষক বলছেন, রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার সদিচ্ছাই নেই মিয়ানমারের। কারণ দেশটির শীর্ষ কর্মকর্তারা বাংলাদেশে আসলেও কখনই শরণার্থী ক্যাম্প পরিদর্শনে যাননি। রোহিঙ্গা ইস্যুতে যুক্ত করা হয়নি ঢাকার মিয়ানমার দূতাবাসকেও। তবে দুই বিশ্লেষকই বলছেন, আন্তর্জাতিক চাপ ধরে রাখার পাশাপাশি হাল ছেড়ে দেয়া ঠিক হবে না বাংলাদেশের।
Posted ২:৪৭ পূর্বাহ্ণ | সোমবার, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta