কক্সবাংলা ডটকম :: সঞ্চয়পত্রে ২ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছেন রাজধানীর যাত্রাবাড়ীর আনোয়ার মোস্তফা। হঠাৎ করেই তার নামে চিঠি ইস্যু করেছে করাঞ্চল-১৪। চিঠিতে কেন আয়কর রিটার্ন জমা দেয়া হয়নি জানতে চাওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, উত্তর না দিলে নেয়া হবে আইনগত ব্যবস্থা।
নিয়মানুযায়ী ৫ লাখ টাকা সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করলে কর শনাক্তকরণ নম্বর বা টিআইএন থাকা বাধ্যতামূলক। কিন্তু ২ লাখ টাকা বিনিয়োগে রিটার্ন জমার তথ্য চাওয়ায় হতবাক আনোয়ার মোস্তফা। তিনি বলেন, ‘জীবনের শেষ সম্বল সঞ্চয়পত্রে জমা করে এখন বিপদে পড়েছি। উত্তর দেয়ার জন্য আইনজীবীর শরণাপন্ন হয়েছি। বাড়তি টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে।’
শুধু এই বিনিয়োগকারীই নন, আরও অনেক সাধারণ গ্রাহকও সঞ্চয়পত্র কিনে রাজস্ব বিভাগের মারপ্যাঁচে পড়ছেন। কর শনাক্তকরণ নম্বর বা টিআইএনের তথ্য দেয়া নিয়েই তৈরি হচ্ছে জটিলতা। ৫ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের ক্ষেত্রে টিআইএন বাধ্যতামূলক হলেও ২ লাখ টাকা বিনিয়োগেও জানতে চাওয়া হচ্ছে আয়ের উৎস ও টিআইএন নম্বর। ফলে বিড়ম্বনায় সঞ্চয়পত্র কেনা কমিয়ে দিয়েছে সাধারণ মানুষ।
সঞ্চয় অধিদপ্তরের গুলিস্তান ঢাকা কার্যালয়ের অতিরিক্ত পরিচালক মোতালেব হোসেন বলেন, টিআইএন-সংক্রান্ত জটিলতায় অনেকেই অভিযোগ জানাচ্ছেন। অনেকে ভয়ে বিনিয়োগেও আগ্রহী হচ্ছেন না। সেই কারণে বিক্রি কমে গেছে।
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, আগে একটা সময় সঞ্চয়পত্রে প্রতিষ্ঠানগুলো বেশি বিনিয়োগ করেছে। ফলে সরকারের এ খাতে ভর্তুকি বেড়ে যায়। এটা নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। সাধারণ, নিম্নমধ্যবিত্তরা যাতে তাদের অর্থ জমা রাখতে পারে, বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সে সুবিধা করে দেয়া উচিত।
এনবিআরের চিঠি
আনোয়ার মোস্তফাকে দেয়া চিঠি ইস্যু করেন এনবিআরের করাঞ্চল-১৪-এর সার্কেল ২৯৬ সহকারী কর কমিশনার মুহাম্মদ গিয়াস উদ্দিন। আয়কর রিটার্ন দাখিল ও সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগসংক্রান্ত ব্যাখ্যা দাখিল বিষয়ে আনোয়ারকে দেয়া ওই চিঠিতে বলা হয়, ‘আপনার সঞ্চয়পত্র খাতে বিনিয়োগের পরিমাণ ২ লাখ টাকা। কিন্তু অদ্যবধি আপনি অত্র সার্কেলে আয়কর রিটার্ন দাখিল করেননি। আয়কর রিটার্ন দাখিল ও সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগসংক্রান্ত বিষয়ে আপনার কোনো বক্তব্য থাকলে সেটা ১৯ ফেব্রুয়ারির মধ্যে উপযুক্ত তথ্য-প্রমাণসহ কার্যালয়ে দাখিল করতে হবে। আপনার নিকট থেকে কোনো সাড়া পাওয়া না গেলে আয়কর আইনের সংশ্লিষ্ট ধারা মোতাবেক আইনানুগ কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে।’
কেনার ক্ষেত্রে শর্ত
সঞ্চয়পত্র বিনিয়োগে যাতে কোনো প্রতিষ্ঠান যুক্ত হতে না পারে, সে জন্য নানা ক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ আরোপ করেছে অর্থ বিভাগ। আগের মতো চাইলেই এখন আর কেউ সব ধরনের সঞ্চয়পত্র কিনতে পারেন না। এ ব্যাপারে সরকার কিছু শর্ত ঠিক করে দিয়েছে।
পরিবার সঞ্চয়পত্রের ক্ষেত্রে ১৮ বছর ও তার চেয়ে বেশি বয়সের যেকোনো বাংলাদেশি নারী, যেকোনো বাংলাদেশি শারীরিক প্রতিবন্ধী নারী ও পুরুষ এবং ৬৫ বছর ও তার চেয়ে বেশি বয়সী বাংলাদেশি নারী ও পুরুষরা শুধু একক নামে কিনতে পারবেন। তবে প্রতিবন্ধী হলে বিষয়টি সংশ্লিষ্ট জেলা সমাজসেবা কার্যালয় কর্তৃক সত্যায়িত হতে হবে।
তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র যেকোনো বাংলাদেশি নাগরিক একক বা যুগ্ম নামে কিনতে পারেন। পাঁচ বছর মেয়াদি বাংলাদেশ সঞ্চয়পত্রও সবার জন্য উন্মুক্ত। ১৮ বছর বা তার বেশি বয়সী যেকোনো শ্রেণি-পেশার মানুষ একক বা যুগ্ম নামে এ দুই ধরনের সঞ্চয়পত্র কিনতে পারেন।
তিন মাস অন্তর মুনাফাভিত্তিক সঞ্চয়পত্র প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে অটিস্টিকদের জন্য প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা যেসব প্রতিষ্ঠান অটিস্টিকদের সহায়তায় কাজ করে, তারা কিনতে পারে। তবে শর্ত হলো, মুনাফার অর্থ অটিস্টিকদের সহায়তা কাজে ব্যয় হবে মর্মে সংশ্লিষ্ট জেলা সমাজসেবা অফিস থেকে প্রত্যয়নকৃত হতে হবে।
পেনশনার সঞ্চয়পত্রের ক্ষেত্রে অবসরভোগী সরকারি, আধা সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ও কর্মচারী, সুপ্রিম কোর্টের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি, সশস্ত্র বাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত সদস্য এবং মৃত সরকারি চাকরিজীবীর পারিবারিক পেনশন সুবিধাভোগী স্বামী, স্ত্রী ও সন্তানরা কিনতে পারেন।
নাবালকের পক্ষে সঞ্চয়পত্র কেনার এখন আর সুযোগ নেই।
১ লাখ টাকার বেশি অঙ্কের সঞ্চয়পত্র কিনতে হলে ইলেকট্রনিক কর শনাক্তকরণ নম্বর (ইটিআইএন) থাকতেই হবে। ১ লাখ টাকা পর্যন্ত অবশ্য ইটিআইএন লাগে না। আর ৫ লাখ টাকার বেশি সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগ করতে হলে অবশ্যই সর্বশেষ বছরের আয়কর রিটার্ন জমার প্রমাণপত্র দেখাতে হবে। ব্যাংক অ্যাকাউন্ট না থাকলে সঞ্চয়পত্র বিক্রি না করার শর্ত, গ্রাহকের মোবাইল নম্বরের সঙ্গে জাতীয় পরিচয়পত্রের (এনআইডি) সার্ভারের সংযুক্তি আরোপসহ আরও কিছু কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ফলে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রি কমে গেছে।
সব সঞ্চয়পত্রেরই নির্দিষ্ট ফরম ওয়েবসাইট থেকে ডাউনলোড করা যায়। সঞ্চয়পত্র কিনতে গেলে গ্রাহকদের এ ফরম পূরণ করে, গ্রাহক ও নমিনির দুই কপি করে পাসপোর্ট আকারের ছবি দিতে হবে। গ্রাহকের ছবি প্রথম শ্রেণির সরকারি কর্মচারীর মাধ্যমে সত্যায়িত করতে হয়। তবে নমিনির ছবির সত্যায়ন করতে হয় গ্রাহককে।
কমেছে বিক্রি
এদিকে অতি কড়াকড়ির কারণে সঞ্চয়পত্রবিমুখ হচ্ছে সাধারণ মানুষ। অন্য যেকোনো উৎসে অর্থ বিনিয়োগের তুলনায় সঞ্চয়পত্রে বেশি মুনাফা পাওয়া যায় বলে এতে বেশি আগ্রহ। কিন্তু কেনার ক্ষেত্রে নানা বিপত্তি তৈরি করছে এনবিআরের শর্ত।
এসব শর্তের মধ্যে টিআইএন বাধ্যতামূলক করা এবং বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সীমা নির্দিষ্ট করে দেয়া বড় কারণ। এ ছাড়া গত বছরের ২১ সেপ্টেম্বর থেকে ১৫ লাখ টাকার বেশি বিনিয়োগের ক্ষেত্রে সব রকম সঞ্চয়পত্রের সুদহার ২ শতাংশের মতো কমিয়ে দেয় সরকার। তারও আগে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে সঞ্চয়পত্রের বিনিয়োগসীমা কমিয়ে আনা হয়। এ ছাড়া ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে মুনাফার ওপর উৎসে করের হার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়।
এত কড়াকড়ির ফলে সঞ্চয়পত্র কেনার চেয়ে ভাঙানোর পরিমাণ বেশি দেখা গেছে সম্প্রতি। চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে (জুলাই-ডিসেম্বর) ৪০ হাজার ৪৭১ কোটি ৬৮ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র বিক্রি হয়েছে। এর বিপরীতে মুনাফা ও মূল বাবদ পরিশোধ করা হয়েছে ৪৩ হাজার ৫৭৮ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে ছয় মাসে যা বিনিয়োগ হয়েছে তারচেয়ে ৩ হাজার ১০৭ কোটি টাকা বেশি পরিশোধ করেছে সরকার। ফলে প্রকৃত বিক্রি বাড়েনি। উল্টো এ ছয় মাসে সঞ্চয়পত্রের নিট বিক্রিতে নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। অথচ এক বছর আগে একই সময়ে সঞ্চয়পত্র বিক্রিতে ৯ হাজার ৫৮৯ কোটি টাকার ইতিবাচক প্রবৃদ্ধি ছিল।
আইএমএফের শর্ত
ভর্তুকি কমানোর অংশ হিসেবে সুদহার বাজারভিত্তিক এবং সঞ্চয়পত্র বিক্রি কমিয়ে আনতে পরামর্শ দিয়েছে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)। আইএমএফ বাংলাদেশের জন্য ৪৭০ কোটি ডলার ঋণ অনুমোদন করেছে। ঋণের সঙ্গে সংস্থাটি শর্ত দিয়েছে, সঞ্চয়পত্র থেকে সরকারের ঋণ এখন যা আছে, তা ২০২৬ সালের মধ্যে এক-চতুর্থাংশ কমিয়ে ফেলতে হবে। সঞ্চয়পত্র বিক্রির সুদ ব্যয় কমিয়ে আনতেই সংস্থাটি এ শর্ত দিয়েছে।
বাজেটে বিক্রি লক্ষ্য
চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে অভ্যন্তরীণ ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ৪৬ হাজার ৩৩৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণের লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ৬ হাজার ৩৩৪ কোটি টাকা। আর সঞ্চয়পত্র বিক্রির মাধ্যমে ঋণ নেয়ার লক্ষ্যমাত্রা ৩৫ হাজার কোটি টাকা। বাকি ৫ হাজার কোটি টাকা অন্যান্য খাত থেকে আসবে।
কিন্তু দেখা গেছে, ছয় মাসে সঞ্চয়পত্র থেকে কোনো ঋণ পায়নি সরকার। উল্টো ৩ হাজার ১০৬ কোটি ৮৬ লাখ টাকা কোষাগার ও ব্যাংকব্যবস্থা থেকে ঋণ নিয়ে শোধ করেছে।
Posted ১:৩০ পূর্বাহ্ণ | রবিবার, ২৬ ফেব্রুয়ারি ২০২৩
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta