কক্সবাংলা ডটকম(৯ জুন) :: সরকারি মালিকানাধীন আর্থিক ও অ-আর্থিক প্রতিষ্ঠানের নেয়া ঋণের বিপরীতে গ্যারান্টি ও কাউন্টার গ্যারান্টি দিয়ে থাকে সরকার। ৭৭টি সংস্থা ও প্রকল্পের ৭১ হাজার ৪৯২ কোটি ৬২ লাখ টাকা ঋণের বিপরীতে সরকার এ গ্যারান্টি দিয়েছে। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান সময়মতো ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে, তা পরিশোধ করতে হচ্ছে সরকারকে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সাধারণত সরকারের সঙ্গে সরকারের (জিটুজি) সম্পাদিত চুক্তির মাধ্যমে বাস্তবায়িত বিভিন্ন প্রকল্পে নেয়া ঋণের গ্যারান্টার হয়ে থাকে সরকার। এর বাইরে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানের বিশেষ প্রয়োজনে সরকার গ্যারান্টার হতে পারে। তবে ঋণ পরিশোধে সক্ষমতা নেই এমন প্রতিষ্ঠানের নেয়া ঋণের গ্যারান্টার হওয়ায় তা দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতির জন্য ঝুঁকির কারণ হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
খাতভিত্তিক সবচেয়ে বেশি ঋণের বিপরীতে সরকার গ্যারান্টি দিয়েছে বিদ্যুতে। ১৮টি প্রকল্পের জন্য নেয়া ৪৪ হাজার ৭৪৪ কোটি ১৩ লাখ টাকার বিপরীতে এ গ্যারান্টি দিয়েছে সরকার। এর মধ্যে শুধু রামপাল ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ প্রকল্পের ঋণ ১২ হাজার ৮০০ কোটি টাকা। গত বছরের ৯ এপ্রিল এক্সিম ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার অনুকূলে সরকার এ গ্যারান্টি দিয়েছে।
কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে বাংলাদেশ-ইন্ডিয়া ফ্রেন্ডশিপ পাওয়ার কোম্পানি লিমিটেড। পায়রায় বাস্তবায়নাধীন ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট তাপ-বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য প্রয়োজনীয় ঋণের ৫০ শতাংশের বিপরীতে গ্যারান্টি দিয়েছে সরকার।
এক্সিম ব্যাংক অব চায়নাকে দেয়া গ্যারান্টিতে ঋণের পরিমাণ ৮ হাজার ৩৩২ কোটি ৮০ লাখ টাকা।
এছাড়া আশুগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনের ৪৫০ মেগাওয়াট সিসিপিপি প্রকল্পের ৩ হাজার ৩৬০ কোটি, বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (বিপিডিবি) শাহজীবাজার ৩৩০ মেগাওয়াট সিসিপিপি প্রকল্পের ২ হাজার ৫৭ কোটি ১২ লাখ, ঘোড়াশাল তৃতীয় ইউনিট রি-পাওয়ার প্রকল্পের ২ হাজার ৬৬৪ কোটি ও বিবিয়ানা-৩ ৪০০ মেগাওয়াট গ্যাসভিত্তিক কম্বাইন্ড সাইকেল পাওয়ার প্ল্যান্ট প্রকল্পের ২ হাজার ২৪০ কোটি টাকা ঋণের গ্যারান্টার হয়েছে সরকার।
ঢালাওভাবে এ ধরনের গ্যারান্টি ভবিষ্যতে অর্থনীতির জন্য ঝুঁকি তৈরি করবে বলে মনে করেন বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন।
তিনি বলেন, এজন্য প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবস্থাপনাগত দক্ষতা বাড়াতে হবে, যাতে করে তাদের গ্যারান্টার প্রয়োজন না হয় অথবা হলেও যথাসময়ে ঋণের অর্থ পরিশোধে সক্ষম হয়।
কৃষিঋণ বিতরণ কার্যক্রমে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক ও রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের নেয়া ৯ হাজার ১৫৫ কোটি ৩৭ লাখ টাকার বিপরীতেও গ্যারান্টার হয়েছে সরকার। ২০০৪ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত সময়ে ১৬টি ঋণের বিপরীতে গ্যারান্টি ইস্যু করা হয়েছে।
এর মধ্যে কিছু কার্যক্রমে দেয়া গ্যারান্টির মেয়াদ শেষ হওয়ায় পুনরায় সেগুলোর মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। এ ঋণের বিপরীতে সরকার গ্যারান্টি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক, সোনালী, জনতা, অগ্রণী ও রূপালী ব্যাংককে।
বাংলাদেশ বিমানের উড়োজাহাজ কেনার ঋণেরও গ্যারান্টার সরকার। ২০১১ সালে দুটি নতুন বোয়িং (প্রথম পর্যায়) কিনতে সিনিয়র লোনের বিপরীতে ২ হাজার ৯৬ কোটি, ২০১২ সালে জুনিয়র লোনের বিপরীতে ৫২০ কোটি, ২০১৪ সালে দুটি নতুন বোয়িং (দ্বিতীয় পর্যায়) কিনতে ২ হাজার ৩২০ কোটি টাকার সিনিয়র লোনের বিপরীতে সরকার গ্যারান্টার হয়েছে। একই বছর ৫২৮ কোটি টাকার জুনিয়র লোন ও ২০১৬ সালে চারটি নতুন বোয়িং (চতুর্থ পর্যায়) কিনতে প্রি-ডেলিভারি পেমেন্ট হিসেবে নেয়া ১ হাজার ৮৮ কোটি টাকা ঋণের বিপরীতে গ্যারান্টার হয়েছে সরকার।
যুক্তরাষ্ট্রের এক্সিম ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক (সিন্ডিকেটেড) ও সোনালী ব্যাংক (ইউকে) লিমিটেডকে এ গ্যারান্টি দেয়া হয়েছে।
পরিশোধিত ও অপরিশোধিত জ্বালানি তেল আমদানিতে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) নেয়া ঋণের বিপরীতে সরকারকে গ্যারান্টার হতে হয়েছে। এ ঋণের পরিমাণ ১ হাজার ৬৮০ কোটি টাকা। চলতি বছরের জানুয়ারিতে এ ঋণের বিপরীতে বাংলাদেশ ব্যাংককে গ্যারান্টি দিয়েছে সরকার।
সম্প্রতি উৎক্ষেপিত দেশের প্রথম স্যাটেলাইট বঙ্গবন্ধু-১ প্রকল্পের অর্থায়নেও সরকারকে গ্যারান্টি দিতে হয়েছে। প্রকল্পটির ১ হাজার ৩৪৪ কোটি টাকা ঋণের বিপরীতে ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে এইচএসবিসি ব্যাংককে এ গ্যারান্টি দিয়েছে সরকার। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের দায়িত্বে বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন (বিটিআরসি)।
এর বাইরে বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ও প্রকল্পের জন্য নেয়া ৮ হাজার ১৬ কোটি ৭২ লাখ টাকার ৩৪টি ঋণের বিপরীতে গ্যারান্টার হয়েছে সরকার। এর মধ্যে রয়েছে মধ্যপাড়া কঠিন শিলা খনি উন্নয়ন প্রকল্পের ১ হাজার ৯ কোটি ৬০ লাখ ও বাংলাদেশ টেলিকমিউনিকেশন্স কোম্পানি লিমিটেডের (বিটিসিএল) বাস্তবায়নাধীন জেলা পর্যায়ে ডিজিটাল টেলিফোন স্থাপন প্রকল্পের ১ হাজার ৬৮০ কোটি টাকা ঋণ।
এছাড়া বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প করপোরেশনের (বিএসএফআইসি) অধীনস্থ চিনিকলগুলোতে পরিচালন মূলধন হিসেবে জোগান দেয়া ১ হাজার ৩৮০ কোটি ৭৩ লাখ টাকার বিপরীতে সরকার গ্যারান্টার হয়েছে। সোনালী ও জনতা ব্যাংক থেকে এ অর্থের সংস্থান করা হয়েছে।
বাংলাদেশ পাটকল করপোরেশনের (বিজেএমসি) অধীনস্থ ১৬টি চালু কারখানার পরিচালন মূলধন জোগান দিতেও একইভাবে গ্যারান্টার হয়েছে সরকার।
যদিও সক্ষমতার অভাবে অনেক সময়ই নিয়মিত ঋণের অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হচ্ছে রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলো। ফলে সরকারকেই সেই ঋণের অর্থ পরিশোধ করতে হচ্ছে। ২০১৭ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সময়কালে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংকের কাছ থেকে সরকারের মোট ডিএসএল (ডেট সার্ভিস লায়াবিলিটি) বকেয়ার পরিমাণ দাঁড়ায় ৭৫২ কোটি ১ লাখ ২০ হাজার টাকা।
বিএসএফআইসির কাছে এ বকেয়ার পরিমাণ ৪ হাজার ২১১ কোটি ৬০ লাখ ৮০ হাজার টাকা। আর বাংলাদেশ বিমানের নেয়া সব ঋণের শুধু গ্যারান্টারই নয়, সরকারকে কিস্তির অর্থও পরিশোধ করতে হচ্ছে।
ঋণের বিপরীতে সরকারের এ গ্যারান্টি সংস্কৃতি হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে মন্তব্য করেন বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর।
তিনি বলেন, যাচাই-বাছাই ছাড়াই সরকারের এভাবে গ্যারান্টার হওয়ার বিষয়টি গ্রহণযোগ্য নয়। রাষ্ট্রায়ত্ত বিভিন্ন লোকসানি প্রতিষ্ঠানকে টিকিয়ে রাখতে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এসব প্রতিষ্ঠানকে কেউ ঋণ দিতে চায় না। এজন্য সরকারকেই ঋণের গ্যারান্টার হতে হয়।
Posted ১২:৪৩ অপরাহ্ণ | শনিবার, ০৯ জুন ২০১৮
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta