কক্সবাংলা ডটকম(২৬ এপ্রিল) :: এক সময়ে বাংলাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ার গুড ব্যাংকের তালিকায় থাকা দেশের সর্ববৃহৎ বেসরকারি ব্যাংক ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড অবশেষে সর্বস্ব হারাতে চলেছে। ইসলামী ব্যাংকের সব বিনিয়োগ বন্ধ, কর্মকর্তাদের মধ্যে ‘ছাঁটাই’ আতঙ্ক চলছে। তীব্র গ্রুপিংয়ে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে ব্যাংকটির স্বাভাবিক কর্মকান্ড। ঋণ বিতরণ কবে থেকে চালু হবে তা এখনো অনিশ্চিত।
নগদ টাকার তীব্র সংকটের কারণে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড সব ধরনের বিনিয়োগ বন্ধ করে দিয়েছে। আগে মৌখিকভাবে বিনিয়োগ বন্ধের কথা বলা হলেও গত রোববার ব্যাংকের কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ সুইচ বন্ধ করে দিয়ে বিনিয়োগ বন্ধ করা হয়েছে। নগদ টাকার সঙ্কট মেটাতে কোনো ব্যাংকের বিনিয়োগ এভাবে বন্ধ করে দেয়ার এ ঘটনা দেশের ব্যাংকিং খাতে নজিরবিহীন ঘটনা। দেশের কোনো জায়গা থেকে বিনিয়োগ (ঋণ) দিতে পারেনি ব্যাংকের শাখাগুলো।
ইসলামী ব্যাংকের জনপ্রিয় সেবা এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের আউটলেট দেয়ার কার্যক্রমও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ব্যাংকটির এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের ১০৫টি আউটলেটের অনুমোদন দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর মধ্যে ৯৫টি আউটলেট চালু হয়েছে। বর্তমানে নতুন আউটলেট উদ্বোধন বন্ধ রেখেছে ব্যাংকটি। দ্রুত জনপ্রিয়তা পাওয়ায় এর আগে বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে আরো ২০০টি আউটলেটের অনুমোদন চেয়েছিল ব্যাংকটি।
বিনিয়োগসহ প্রয়োজনীয় সেবা বন্ধ রাখার পাশাপাশি ব্যাংকটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মধ্যে এখনো ‘ছাঁটাই’ আতঙ্ক কাজ করছে। এতে ব্যাংকটি এক প্রকার স্থবির হয়ে পড়েছে। তবে আমানতকারীদের কাছ থেকে আমানত গ্রহণ ও প্রদান ঠিক রয়েছে বলে ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।
নগদ টাকার সঙ্কট মেটাতে ও বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্ধারিত আমানত ও বিনিয়োগ হার (আইডিআর) ঠিক করার জন্য বিনিয়োগ বন্ধ রাখা হয়েছে বলে জানা গেছে। পরিচালনা পষর্দের এমন সিদ্ধান্তে ব্যাংকটির সংকট আরো ঘনীভূত হতে পারে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। গত বছর জানুয়ারিতে ব্যাংকটিতে যে পরিবর্তন শুরু হয় তা চলতি মাসেও অব্যাহত থাকায় ব্যাংকটি নানান সঙ্কটের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এসব বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নীরবতায় হতাশা প্রকাশ করেছেন আমানতকারীরা।
তাদের মতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বেচ্ছাচারিতায় ব্যাংকটি সর্বস্বান্ত হচ্ছে।
একজন আমানতকারী জানান, ব্যাংকটিতে তার পরিবারের লোকজনের কয়েক কোটি টাকা আমানত রয়েছে। বর্তমানে ব্যাংকটির যে হাল তাতে তিনি বেশ উদ্বিগ্ন। তিনি বলেন, এক সময় ইসলামী ব্যাংক শুধু বাংলাদেশ নয় দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যেও শীর্ষ ব্যাংক ছিল। আমরা সে কারণেই আমানত রেখেছি। গত দেড় বছরে ব্যাংকটিতে যে অপকর্ম চলছে তা দেখেও না দেখার ভান করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। এতে আমরা বেশ হতাশ হয়ে পড়েছি।
প্রশ্ন উঠেছে, এসব অপকর্মে কি কেন্দ্রীয় ব্যাংকও জড়িত। তা না হলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এসব অপকর্মকে বৈধতা দেয় কিভাবে?
ইসলামী ব্যাংকের বর্তমান হাল ও বিনিয়োগ বন্ধ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র দেবাশিষ চক্রবর্তী বলেন, এটি একান্তই ইসলামী ব্যাংকের পষর্দের বিষয়। গ্রাহকের চাহিদা ও অন্যান্য বিষয় বিবেচনায় নিয়ে বিনিয়োগ বিষয়ে ব্যাংক সিদ্ধান্ত নেয়। এক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের সরাসরি কিছু বলার নেই।
এ বিষয়ে ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সিদ্ধান্তই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাবে দেখা গেছে, ব্যাংকের আমানত ও বিনিয়োগ হার (আইডিআর) বর্তমানে ৯২ শতাংশ হয়ে গেছে, যা বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশিত হারের চেয়ে ২ শতাংশ বেশি।
অন্যদিকে ব্যাংকটি বন্ড ছেড়ে ৫০০ কোটি টাকা তোলার যে পরিকল্পনা নিয়েছিল তাও বাস্তবায়ন করতে পারছে না। ফলে ব্যাংকটির অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, নগদ টাকার অভাবে প্রয়োজনীয় কাজ করতে পারছে না।
এক সময় এ ব্যাংকের কর্মকর্তাদের বিভিন্ন খাতে ঋণ নেয়ার জন্য বলা হতো, এখন কর্মকর্তারা ঋণের জন্য আবেদন করলেও তাদেরও ঋণ দিতে পারছে না ব্যাংকটি। ইসলামী ব্যাংকের বর্তমান মোট আমানতের পরিমাণ ৭৬ হাজার ৪৯৫ কোটি টাকা। যার মধ্যে মুদারাবা আমানত ৬৭ হাজার ৫৩ কোটি টাকা। আর বাকিটা খরচ ছাড়া (কস্ট ফ্রি) আমানত। ব্যাংকটি বিনিয়োগ রয়েছে ৭৭ হাজার ৮৬৯ কোটি টাকা।
এ বিনিয়োগের মধ্যে সাধারণ বিনিয়োগ ৭৪ হাজার ৮৭ কোটি এবং বাকিটা শেয়ার বিনিয়োগ। সে হিসাবে আইডিআর ৯১ দশমিক ৪৬ শতাংশ হয়ে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনা অনুযায়ী ইসলামী ব্যাংকগুলো তাদের সংগৃহীত আমানতের ৮৫ শতাংশ ঋণ বিতরণ করতে পারে। তবে সার্বিক আর্থিক সূচক ভালো থাকলে সর্বোচ্চ ৯০ শতাংশ ঋণ বিতরণ করা যায়।
যদিও সর্বোচ্চ এই হার এক শতাংশ কমিয়ে ৮৯ শতাংশ নির্ধারণ করে দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। যেসব ব্যাংকের ঋণ ৮৯ শতাংশের বেশি রয়েছে তাদের আগামী বছরের মার্চের মধ্যে এই সীমার মধ্যে নামিয়ে আনতে হবে।
হঠাৎ করে আবারো বড় ধরনের পরিবর্তনে ইসলামী ব্যাংক নিয়ে সর্বমহলে চলছে নানা কানাঘোষা। আরাস্তু খান মঙ্গলবার ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের সভায় পদত্যাগপত্র জমা দেন। ব্যক্তিগত কারণ দেখিয়ে তিনি পদত্যাগের কথা জানান। পদত্যাগের পর ইসলামী ব্যাংকের ওয়েবসাইট থেকে চেয়ারম্যান আরাস্তু খানের ছবি সরিয়ে ফেলা হয়েছে। নতুন চেয়ারম্যান নির্বাচন করা হয়েছে ব্যাংকের স্বতন্ত্র পরিচালক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নাজমুল হাসানকে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত কয়েক বছর থেকে বিশেষ কয়েকজন ব্যক্তি সরকারকে বুঝিয়ে আসছিল যে- ইসলামী ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের টাকা জামায়াত-শিবিরের ফান্ডে যাচ্ছে। অর্থনৈতিকভাবে জামায়াত-শিবিরকে দুর্বল করতে হলে ব্যাংকটিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে।
এরপর ২০১৭ সালের ৫ জানুয়ারি ব্যাংকটির চেয়ারম্যান মুস্তফা আনোয়ার ও এমডি আব্দুল মান্নানকে সরিয়ে দিয়ে আরাস্তু খানকে চেয়ারম্যান ও আব্দুল হামিদ মিয়াকে এমডি করা হয়। আর শামীম আফজালকে দেয়া হয় ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশনের গুরুত্বপূর্ণ একটি পদ।
এদিকে নতুন পর্ষদ এসে সরকারের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা দিয়ে তদন্ত করা হয় যে ইসলামী ব্যাংকের টাকা আসলেই জামায়াতের ফান্ডে যায় কি না।
কিন্তু একাধিক গোয়েন্দা প্রতিবেদনে সরকারকে জানানো হয়, ব্যাংকের কোনো টাকা জামায়াত-শিবিরের ফান্ডে যায় না। আর ব্যাংকের কর্মকর্তা-কর্মচারী যারা আছেন তারা জামায়াত-শিবিরকে সমর্থন করলেও তারা সৎ মানুষ। এবং ব্যাংকের কাজে তারা খুব কর্মঠ ও যোগ্য।
সরকারি গোয়েন্দা রিপোর্ট পাওয়ার পরই চেয়ারম্যান আরাস্তু খান একাধিকবার বলেছেন যে, ইসলামী ব্যাংকের কর্মকর্তা কর্মচারীদের মতো এত সৎ মানুষ আমি জীবনেও দেখিনি। তারা নামাজি, কর্মঠ ও যোগ্য। ইসলামী ব্যাংকে যে সততা রয়েছে তা সরকারের কোনো খাতেই নেই। এরপর থেকে সরকারও এ নিয়ে আর মাথা ঘামায়নি।
দেশের বেসরকারি খাতের সবচেয়ে বড় এ ব্যাংক সম্পর্কে সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ব্যাংকটির এমন সঙ্কটে পড়ার যৌক্তিক কারণ নেই। ব্যাংকটির এত বছরে কখনো তহবিল সঙ্কটে (নগদ টাকা) পড়েনি।
গত বছর প্রায় ৮ হাজার কোটি টাকা আমানত সংগ্রহ হয়েছে। তারপরও কেন এমন হচ্ছে সে বিষয়ে কেউই কিছু বলতে পারছে না। দিনে দিনে ব্যাংকটির প্রতি গ্রাহকদের আস্থা সঙ্কট বাড়ছে বলেও মনে করছেন তারা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে, ইসলামী ব্যাংক থেকে বিনিয়োগ প্রাপ্তির অনুমোদন পাওয়া কোনো কোনো প্রকল্পে বড় অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করে রেখেছে। এখন উদ্যোক্তারা আটকে গেছেন। ঋণ না পেলে এসব প্রকল্প আলোর মুখও দেখবে না।
এদিকে ইসলামী ব্যাংকের বর্তমান সার্বিক পরিস্থিতিতে শেয়ার হোল্ডার ও বিনিয়োগকারীরা হতাশা প্রকাশ করছেন। কারণ শেয়ারবাজারের অন্তর্ভুক্তির পর থেকে ভালো শেয়ার হিসাবে সবসময় বিনিয়োগকারীরা ইসলামী ব্যাংকের শেয়ার কিনে আসছেন। কিন্তু গত বছরের পরিবর্তন শুরু হওয়ার পর থেকে শেয়ারটির দাম কেবল কমছেই।
অন্যদিকে নগদ লভ্যাংশ ও বোনাস লভ্যাংশও গত বছর পাননি তারা। গত বুধবার (১৮ এপ্রিল) ইসলামী ব্যাংকের শেয়ারপ্রতি দাম ছিল ২৭ টাকা ৮০ পয়সা। গত বছরের ৬ জানুয়ারি যেখানে শেয়ারের দাম ছিল ৩১ টাকা ৪০ পয়সা। গত বছরে এ ব্যাংকের শেয়ারপ্রতি সর্বোচ্চ দাম হয়েছিল ৩৯ টাকা ৫০ পয়সা।
বুধবার ব্যাংকের কয়েকজন কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তারা চরম অনিশ্চয়তার মধ্যে সময় কাটাচ্ছেন। কখন চাকরি চলে যায় এমন আতঙ্কের মধ্যে দিন কাটছে। আর কী কারণে চাকরি যাচ্ছে সেটাও কারো কাছেই স্পষ্ট নয়। তুলনামূলক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের মাঝে এমন আতঙ্ক বিরাজ করছে। দেশের বেসরকারি ব্যাংকের মধ্যে শীর্ষস্থানে থাকা
এ ব্যাংকে গত বছর জানুয়ারি থেকে পরিবর্তন শুরু হয়। চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা কমিটির শীর্ষ ৫ জন কর্মকর্তাকে অপসারণ করা হয়। যদিও ব্যাংকের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, তারা সবাই পদত্যাগ করেছেন।
বুধবার (২৫ এপ্রিল) অনুষ্ঠিতব্য বোর্ড সভায় ব্যাংকটির বার্ষিক সাধারণ সভার (এজিএমে) তারিখ এবং শেয়ারহোল্ডারদের কত শতাংশ লভ্যাংশ দেয়া হবে সে বিষয়ে আলোচনা হয়। এবার শেয়ারহোল্ডারদের জন্য কোনো নগদ লভ্যাংশ না দিয়ে শুধু বোনাস শেয়ার বা স্টক ডিভিডেন্ড দেওয়া হবে।
অন্যদিকে ব্যাংকের খেলাপি ঋণ হিসাবে খাতা কলমে না টেনে অনেক রাইট অব করে আইডিআর বাড়ানোর কথাও জানিয়েছে ব্যাংকটির কর্তৃপক্ষ।
Posted ৩:১৭ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২৬ এপ্রিল ২০১৮
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta