প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে কিছু সমস্যা রয়েছে। প্রতিবেশী দেশ হিসেবে যা থাকাটাই স্বাভাবিক। ভাইয়ে-ভাইয়েও সমস্যা থাকে। আন্তরিকতা থাকলে সে সব সমস্যা যে মেটানো সম্ভব, তা দু’দেশ বারবার প্রমাণ করেছে। তিনি আরও বলেন, ১৯৯৬ সালে গঙ্গা নদীর পানিবণ্টন চুক্তি সম্পাদন করেছি। ২০১৫ সালে স্থলসীমানা চুক্তি সম্পাদিত হয়। ভারতের সংসদের সব সদস্যের সমর্থনে স্থলসীমানা বিলটি পাস হয়। ছিটমহল বিনিময়ের মধ্য দিয়ে বিশ্বে এক বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে দুই দেশ। এত উৎসবমুখর পরিবেশে এবং শান্তিপূর্ণভাবে বিশ্বে কোথাও ছিটমহল বিনিময় হয়নি। বন্ধুপ্রতিম দুই রাষ্ট্রের মধ্যে যে কোনো সমস্যা বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশেই সমাধান করতে পারব।
শুক্রবার পশ্চিমবঙ্গে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে নবনির্মিত ‘বাংলাদেশ ভবন’ ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে যৌথভাবে উদ্বোধনকালে শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন। অনুষ্ঠানে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও উপস্থিত ছিলেন। নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে দুই দিনের সরকারি সফরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল সকালে কলকাতা পৌঁছান।
শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে দীর্ঘদিনের কৌশলগত বন্ধুত্ব বিশ্বের কাছে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের মডেল হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। আমি দৃঢ়ভাবে ঘোষণা দিতে পারি, উভয় দেশ সহযোগিতার এই মনোভাব ভবিষ্যতেও অব্যাহত রাখবে। শেখ হাসিনা বক্তব্যের শুরুতেই মোদি ও মমতাকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, শান্তিনিকেতন শুধু পশ্চিমবঙ্গের নয়, আমাদেরও। রবীন্দ্রনাথের অধিকাংশ কবিতা বাংলাদেশের মাটিতে লেখা, তাই আমাদের অধিকার বেশি। এখানে এলে রবীন্দ্রনাথের কথা মনে পড়ে। আমাকে বিশ্বভারতী থেকে দেশিকোত্তম দেওয়া হয়েছিল, তাই নিজেকে বিশ্বভারতীর একজন বলেই আমি মনে করি। যদিও আমি এখানে পড়ার সুযোগ পাইনি।
এদিন শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর রবীন্দ্রপ্রীতির কথাও উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু ঢাকা থেকে টুঙ্গিপাড়া স্টিমারে যাওয়ার সময় ডেকে দাঁড়িয়ে কবিগুরুর কবিতা পড়তেন। তার রাজনৈতিক জীবনের প্রেরণা তিনি পেয়েছিলেন রবীন্দ্রনাথ থেকে।
স্থলসীমান্ত চুক্তিসহ একাধিক বিষয়ে ভারতের সাহায্যের জন্য প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে ধন্যবাদ জানান শেখ হাসিনা। উন্নয়নশীল দেশ থেকে উন্নত দেশে পরিণত হওয়ার জন্য ভারতের সহযোগিতা চান তিনি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আরও বলেন, পারিপার্শ্বিকতা আমাদের আলাদা করে রাখলেও বাঙালিরা মনেপ্রাণে এক এবং অভিন্ন। অনেক সময় ক্ষুদ্র স্বার্থ আমাদের মনের মধ্যে দেয়াল তৈরি করে। আমরা ভুল পথে পরিচালিত হই। এই দেয়াল ভাঙতে হবে। মনের ভেতর অন্ধকার দানা বাঁধতে দেওয়া যাবে না। ক্ষুদ্র স্বার্থ বিসর্জন দিতে পারলেই কেবল বৃহত্তর অর্জন সম্ভব। কবিগুরু বলেছেন- নিশিদিন ভরসা রাখিস, ওরে মন, হবেই হবে।/যদি পণ করে থাকিস, সে পণ তোমার রবেই রবে।/ওরে মন হবেই হবে…। আমরা মানুষের জন্য কাজ করার পণ করেছি। সে পণ আমরা পূরণ করবই। এ জন্য অর্থনৈতিক যোগাযোগের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক যোগাযোগও সুদৃঢ় করা দরকার।
শেখ হাসিনা বলেন, শান্তিনিকেতনে প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ ভবন দুই দেশের মানুষের মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে। দুই দেশের জ্ঞানপিপাসুদের তীর্থক্ষেত্রে পরিণত হোক এই ভবন, এই প্রত্যাশা।
সম্পর্কের সোনালি অধ্যায়- মোদি : এদিন বক্তব্যের শুরুতে বাংলায় কথা বলে উপস্থিত দর্শকদের চমকে দেন নরেন্দ্র মোদি। তিনি বলেন, দু’দেশের বন্ধুত্বের প্রতীক বাংলাদেশ ভবন। রমজান মাসে এটা খুশির উপহার। এটা আমাদের সেই সম্পর্ক, যা ইংরেজরা দেশভাগ করেও ভাঙতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুকে আপনারা যা সম্মান দেন, আমরাও সেই সম্মান দিই। একইভাবে আমি জানি আমাদের মতো আপনারা বিবেকানন্দ,গান্ধীজি ও নেতাজিকে সম্মান করেন।
মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ টেনে মোদি বলেন, যুদ্ধ ওপারে হলেও এর লড়াইয়ের প্রেরণার বীজ ছিল এপারে। বাংলাদেশের মানুষ অত্যাচারিত হলে আমরাও ব্যথা পেয়েছি। সেদিন যুদ্ধ করা ভারতীয় সেনাদের যে সম্মান আপনার দিয়েছেন তা সারাবিশ্বে বিরল।
মোদি বলেন, বাংলাদেশের উন্নয়নে ভারত শরিক। এখন সম্পর্কের সোনালি অধ্যায় চলছে। জল-রেল-সড়ক যোগাযোগ বাড়ছে। ৬০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ দিয়েছি, আরও ১১০০ মেগাওয়াট দেব। দু’দেশ এবার মহাকাশ প্রযুক্তিতে একসঙ্গে কাজ করবে। বঙ্গবন্ধু উপগ্রহ মহাকাশে পাঠিয়ে বাংলাদেশ প্রমাণ করেছে তারাও পারে।
শেখ হাসিনার প্রশংসা করে মোদি বলেন, বাংলাদেশ সরকার যেভাবে দারিদ্র্য দূর করছে তা আমাদের জন্য প্রেরণা। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশকে ২০৪১ সালের মধ্যে যেখানে নেওয়ার লক্ষ্য নিয়েছেন, তাতে ভারতের পূর্ণ সমর্থন থাকবে।
মোদি বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্কে বন্ধুত্ব এবং স্বার্থগত সংযোগ দুটিই রয়েছে। বাংলাদেশ ব্যথা পেলে ভারত ব্যথা পায়। একইভাবে বাংলাদেশও ভারতের আনন্দ-বেদনার অনুভূতি নিজের মতো করেই অনুভব করে। এটাই দুই ঘনিষ্ঠতম প্রতিবেশীর সম্পর্ক।
বাংলাদেশ ভবনের উদ্বোধন শেষে বৈঠকে বসেন শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি। প্রায় ৪৫ মিনিট বৈঠক চলে। এ সময় রোহিঙ্গা ইস্যু উঠে আসে বলে জানা যায়। বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম বলেন, আলোচনায় দ্বিপক্ষীয় স্বার্থসংশ্নিষ্ট ও আন্তর্জাতিক বিষয় স্থান পায়।
বাংলাদেশ ভবন উদ্বোধন : সকাল ৯টা ২৫ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সফরসঙ্গীদের নিয়ে বাংলাদেশ বিমানের ভিভিআইপি ফ্লাইটটি কলকাতার নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে পৌঁছায়। বিমানবন্দর থেকে নেমে তিনি হেলিকপ্টারে কলকাতা থেকে ১৮০ কিলোমিটার উত্তরে পশ্চিমবঙ্গের বীরভূম জেলার শান্তিনিকেতনে যান।
এর পাশাপাশি কলাইকুণ্ডা থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টারে শান্তিনিকেতনে এসে পৌঁছান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। এদিন দুই প্রধানমন্ত্রীকেই বিশ্বভারতীর হেলিপ্যাডে স্বাগত জানান পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও বিশ্বভারতীর উপাচার্য সবুজকলি সেন।
এরপর দুই প্রধানমন্ত্রী বিশ্বভারতীর আম্রকুঞ্জে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে যোগ দেন। অনুষ্ঠানে বিশ্বভারতীর পক্ষ থেকে শেখ হাসিনার হাতে তুলে দেওয়া হয় বর্ষায় ময়ূরের আনন্দ প্রকাশের অনুকরণে অঙ্কিত একটি আলপনা। দেওয়া হয় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আঁকা চিত্রাবলির ৫ খণ্ডের একটি সেট, কাঁথা স্টিচের একটি শাড়ি, গীতাঞ্জলি ও পাঠভবনের শিশুদের তৈরি করা বিভিন্ন হাতের কাজের সামগ্রী। নরেন্দ্র মোদির হাতে তুলে দেওয়া হয় দক্ষিণ ভারতের হাসান জেলার হেলবিন্দু মন্দিরের ভাস্কর্যের আদলে তৈরি আলপনা চিত্র।
সমাবর্তন শেষ করেই শেখ হাসিনা, নরেন্দ্র মোদি, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়সহ বাংলাদেশের মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, শিক্ষাবিদ ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের প্রতিনিধিরা চলে আসেন বাংলাদেশ ভবন প্রাঙ্গণে। দুপুর ১২টা ২৫ মিনিট নাগাদ বাংলা ও ইংরেজিতে লেখা প্রস্তর ফলকের আবরণ উন্মোচনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ভবনের উদ্বোধন করেন দুই প্রধানমন্ত্রী।
উদ্বোধন শেষে দুই প্রধানমন্ত্রী প্রস্তর ফলকের সামনে দাঁড়ান। এ সময় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন নরেন্দ্র মোদির পাশে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মমতাকে তার পাশে এসে দাঁড়ানোর আহ্বান জানালে মমতা দৌড়ে এসে শেখ হাসিনার পাশে দাঁড়ান।
প্রধানমন্ত্রীর ছোট বোন শেখ রেহানা, বাংলাদেশে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচ মাহমুদ আলী, শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ, সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম, পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠি, বিশ্বভারতীর উপাচার্য সবুজকলি সেন এবং বাংলাদেশের শিক্ষাবিদ ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের প্রতিনিধিরা এ সময় উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশ ভবনের ভেতরে অডিটোরিয়ামে দু’দেশের জাতীয় সঙ্গীতের মধ্য দিয়ে শুরু হয় উদ্বোধন অনুষ্ঠান।
এ সম্পর্ক চিরন্তন- মমতা : অনুষ্ঠানের শুরুতেই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, এটা দারুণ হয়েছে। আমার বঙ্গবন্ধুর কথা মনে পড়ছে। অনেক জল গড়িয়েছে, আরও গড়াবে আর তাতে দু’দেশের সম্পর্ক ভালো হবে। রবীন্দ্র-নজরুলকে বাদ দিয়ে ভারত-বাংলাদেশ ভাবতে পারে না। এটা একটা তীর্থস্থান হবে। বিশ্ব বাংলা কেন্দ্র হবে। আমরা নজরুলের নামে বিশ্ববিদ্যালয়, বিমানবন্দর করেছি। কলকাতায় আপনারা সহযোগিতা করলে বঙ্গবন্ধুর নামে একটি ভবন আমরা তৈরি করতে চাই। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের সম্পর্ক পদ্মা, মেঘনা, যমুনার মতো বহমান। এ সম্পর্ক চিরন্তন, এর শেষ নেই।
প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ব্যবসায়ী নেতাদের সাক্ষাৎ : বাসস জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, দেশের আরও উন্নয়নে ভারতীয় বিনিয়োগকে বাংলাদেশ স্বাগত জানায়। একই সঙ্গে তিনি বাংলাদেশি বিনিয়োগকারীদের ভারতে বিনিয়োগে, বিশেষ করে যৌথ উদ্যোগের সুবিধা দিতে সে দেশের সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, এতে উভয় দেশ লাভবান হবে।
গতকাল সন্ধ্যায় কলকাতার তাজ বেঙ্গল হোটেলের ম্যান্ডারিং কক্ষে সেখানকার ব্যবসায়ী নেতারা প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি এ কথা বলেন।
সাক্ষাৎ শেষে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম এ ব্যাপারে সাংবাদিকদের জানান, বাংলাদেশে নদী খননে ভারতীয় ব্যবসায়ীদের সমর্থন কামনা করে শেখ হাসিনা বলেন, এতে আঞ্চলিক যোগাযোগ জোরদার হবে।
পরে প্রধানমন্ত্রী পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল কেশরীনাথ ত্রিপাঠির দেওয়া ভোজসভায় যোগ দেন। কলকাতার রাজভবনে এ ভোজসভা অনুষ্ঠিত হয়।