কক্সবংলা ডটকম(১৮ মে) :: বাংলাদেশের সরকারি ও বেসরকারি মেডিকেল কলেজে এমবিবিএস-বিডিএস কোর্সে বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যা ক্রমান্বয়ে কমছে। গত তিন বছর ধরে কমতে কমতে এবার শিক্ষার্থীর সংখ্যা গত বছরের তুলনায় ৪৫ শতাংশে নেমে এসেছে।
বিশেষ করে সর্বোচ্চ শিক্ষার্থীর দেশ ভারত, নেপাল ও পাকিস্তানের শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে অর্ধেক হয়েছে। এমনকি কলেজভেদে শিক্ষার্থী কমেছে ৫০-৬৯ শতাংশ পর্যন্ত।
নিরুপায় স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তর বিদেশি শিক্ষার্থীর আশায় সার্ক কোটায় সরকারি মেডিকেল কলেজে ভর্তির জন্য পোর্টাল পুনরায় উন্মুক্ত করেছে। শিক্ষার্থীরা আগামী ২০ মে পর্যন্ত ভর্তির আবেদন করতে পারবে।
এমন অবস্থায় আসন অনুযায়ী শিক্ষার্থীর আশায় বাংলাদেশ বেসরকারি মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশন (বিপিএমসিএ) দেশি-বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য ভর্তির পোর্টাল পুনরায় খুলে দেওয়ার জন্য স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরে আবেদন জানিয়েছে।
গত ১২ মে জমা দেওয়া বিপিএমসিএর আবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ৬৭টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের এমবিবিএস কোর্সে দেশি ও বিদেশি ৬ হাজার ২০৮টি আসনের মধ্যে এখনো ১ হাজার ২০০-এর মতো আসন শূন্য রয়েছে। অনেক ভালো ভালো বেসরকারি মেডিকেল কলেজেও দেশি-বিদেশি এবং অসচ্ছল ও মেধাবী কোটায় আসন শূন্য রয়েছে বলেও বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা হয়।
বিদেশি শিক্ষার্থী কমে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরও। আগামী ২০ মে ভর্তি শেষের পর পুনরায় ভর্তির আবেদনের জন্য পোর্টাল খুলে দেওয়া হতে পারে বলেও অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা মনে করছেন।
বিদেশি শিক্ষার্থী কমে যাওয়ার পেছনে অধিদপ্তরের কর্মকর্তা, বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষক ও মালিকরা মোটা দাগে পাঁচটি কারণ চিহ্নিত করেছেন। তারা এসব সমস্যার সমাধানের পাশাপাশি বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য নতুন উৎস খুঁজে বের করার পরামর্শ দিয়েছেন।
এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. টিটো মিঞা বলেন, ‘অনেক কারণেই বিদেশি মেডিকেল শিক্ষার্থী কিছুটা কমেছে। এখন আমাদের দরকার স্টাডি করা, কেন কমে যাচ্ছে? বেসরকারি মেডিকেল কলেজের মালিকদের ও মন্ত্রণালয়কে বলেছি কমে যাওয়ার কারণ বের করে আমাদের শিক্ষার্থী বাড়ানোর পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ
এসব ছাত্রছাত্রী এলে আমরা যেমন আর্থিকভাবে একটু লাভবান হই, তেমনি দেশের সুনাম হয়। এ ছাড়া বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে অনেক শিক্ষক, লোকজন জড়িত। তাদের চাকরি ও বেঁচে থাকার বিষয় আছে। আমরা বিদেশি শিক্ষার্থী বাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।’
এ কর্মকর্তা বলেন, ‘বিদেশি সংস্থা কর্র্তৃক আমাদের দেশের এমবিবিএস ডিগ্রির স্বীকৃতি জুনের পর থেমে যাবে। এটাও গত দুই বছর শিক্ষার্থী কমার একটি কারণ ছিল। আমরা অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল করেছি। আশা করছি জুনের পর থেকেও আমাদের ডিগ্রির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি থাকবে। এবার যারা ভর্তি হবে, তাদের জন্য এটা কোনো বাধা হবে না।’
স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এ বছর সরকারি ৩৭টি মেডিকেল কলেজ ও ৯টি ডেন্টাল কলেজে বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য আসন রয়েছে ২২১টি। এর মধ্যে সার্কভুক্ত দেশ ভারত, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভুটান, মালদ্বীপ ও আফগানিস্তানের জন্য ১১৭টি, মিয়ানমার ও প্যালেস্টাইনের জন্য সার্কভুক্ত দেশের সমান সুযোগ সংবলিত ২৮টি, অন্যান্য দেশের জন্য ৪৯টি ও সংরক্ষিত পাঁচটি আসন রয়েছে।
অন্যদিকে বেসরকারি ৬৩টি মেডিকেল কলেজ ও ২৬টি ডেন্টাল কলেজে মোট ৬ হাজার ২০৮টি আসনের মধ্যে ৪৫ শতাংশ হিসেবে আসন রয়েছে ২ হাজার ৭৯০টি।
সরকারি হিসাবে ৪৫% কমেছে :
অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এ বছর সরকারি-বেসরকারি কলেজে ভর্তির জন্য মোট আবেদন করেছেন ১ হাজার ৯৩০ বিদেশি শিক্ষার্থী। তাদের মধ্যে সরকারি কলেজে আবেদন করেছেন ৩৯৪ ও বেসরকারিতে ১ হাজার ৪৮৯ জন। এ ছাড়া আর্মড ফোর্সেস মেডিকেল কলেজে আবেদন করেছেন ৪৭ জন।
অন্যদিকে গত বছর মোট আবেদন করেছিলেন ৩ হাজার ৫৩২ জন। তাদের মধ্যে সরকারিতে আবেদন করেছিলেন ৬৩৩ ও বেসরকারিতে ২ হাজার ৮২৯ জন। আর্মড ফোর্সেস মেডিকেল কলেজে আবেদন করেছিলেন ৭০ জন।
সে হিসাবে গত বছরের তুলনায় এবার আবেদনকারী শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমেছে ৪৫ শতাংশ বা ১ হাজার ৬০ জন। তাদের মধ্যে সরকারি কলেজে আবেদন কমেছে ২৩৯টি, যা গত বছরের ৩৮ শতাংশ ও বেসরকারিতে কমেছে ১ হাজার ৩৪০টি, যা গত বছরের ৪৭ শতাংশ। এ ছাড়া ২০২২ সালে ২ হাজার ৬৬, ২০২১ সালে ১ হাজার ৭৩৭ ও ২০২০ সালে ১ হাজার ৪২৭ জন বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছিলেন।
৪০% আসন এখনো খালি :
বেসরকারি মেডিকেল কলেজের শিক্ষক ও কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, প্রতি বছর বাংলাদেশে গড়ে দুই হাজারের মতো বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হন। সেখানে এ বছর এখনো ৫০০-৭০০ আসন এখনো খালি আছে। অর্থাৎ মোট আসনের ৫০-৬০ শতাংশ ভর্তি হয়েছে, ৪০ শতাংশ খালি আছে।
বিপিএমসিএর এক কর্মকর্তা জানান, বিদেশি শিক্ষার্থীর জন্য নতুন নতুন উৎস সন্ধান করতে হবে। ইন্টারন্যাশনাল অ্যাক্রিডিটেশন কাউন্সিল করতে হবে। বিপিএমসির আমন্ত্রণে ওয়ার্ল্ড মেডিকেল ফেডারেশনের সভাপতি আগামী সেপ্টেম্বরে আসবেন।
তারা ভারত ও পাকিস্তানের সব মেডিকেল কলেজের অ্যাক্রিডিটেশন দিয়েছে আগামী ১০ বছরের জন্য। কিন্তু বাংলাদেশের সেই স্বীকৃতি নেই। এ কারণে বিদেশ থেকে যে ছেলেমেয়েরা আসবে, তারা যদি অ্যাক্রিডিটেশন না হয়, তাহলে তো পড়ে লাভ নেই। তারা নিজেদের দেশে চাকরি পাবে না।
বিপিএমসিএর তথ্য অনুযায়ী, গত তিন বছর ধরে বিদেশি শিক্ষার্থী ক্রমান্বয়ে কমছে। গত বছরও বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য কয়েকবার পোর্টাল খোলা হয়েছে। অনেকবার আবেদন চাওয়ার পরও ১০ শতাংশের মতো আসন খালি ছিল। সেগুলো আবার দেশি ছাত্র দিয়ে পূরণ করা হয়েছে। সরকারকে এবারও পোর্টাল খুলতে হবে।
কলেজভেদে ৫০-৬৯% কমেছে :
বিভিন্ন বেসরকারি মেডিকেল কলেজ কর্র্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কলেজভেদে বিদেশি শিক্ষার্থী গত দুই-তিন বছরে ধরে গড়ে ৫০-৬৯ শতাংশ পর্যন্ত কমেছে।
এ ব্যাপারে হলি ফ্যামিলি রেড ক্রিসেন্ট মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. দৌলতুজ্জামান বলেন, ‘এবার বিদেশি শিক্ষার্থী ১৪ জন ভর্তি হয়েছে। নিয়ম আছে মোট আসনের ৪৫ শতাংশ হিসাবে ৬৫ জন ভর্তি হতে পারবে। আমরা কম ভর্তি করি। এবার এসেছেও কম। গত বছর নিয়েছিলাম ৪৫ জন। আমরা নিজেরাও নিতে চাইনি। আমাদের কর্র্তৃপক্ষ চায় দেশের ছেলেমেয়েরা ভর্তি হয়ে দেশের সেবা করবে। এটা কর্র্তৃপক্ষের একটা পলিসি।’
ইব্রাহিম মেডিকেল কলেজ কর্র্তৃপক্ষ জানিয়েছে, এ কলেজে এখন পর্যন্ত দুই-তিনজন বিদেশি শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছে। গত বছরও দুই-তিনজন ভর্তি হয়েছিল।
মোট আবেদনের ৬৮% ভারতের :
অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এ বছর মোট আবেদন জমা পড়েছে ১ হাজার ৯৩০টি। এর মধ্যে সর্বোচ্চ ৬৮ শতাংশ বা ১ হাজার ৩১২ জন শিক্ষার্থী ভারতের। এরপর নেপালের ১৭ শতাংশ বা ৩২৭, পাকিস্তানের ৯ শতাংশ বা ১৬৯ ও ভুটানের ২ শতাংশ বা ৪৩ জন শিক্ষার্থী।
এ ছাড়া প্যালেস্টাইনের ৩২, শ্রীলঙ্কার ২২, যুক্তরাষ্ট্রের ৯ এবং আফগানিস্তান, কানাডা, যুক্তরাজ্য ও মালয়েশিয়ার ৪ জন করে শিক্ষার্থী আবেদন করেছেন।
কমার পাঁচ কারণ :
সংশ্লিষ্টরা দেশে বিদেশি শিক্ষার্থী কমে যাওয়ার পেছনে মোট দাগে পাঁচটি কারণ চিহ্নিত করেছেন। এগুলো হলোÑ এজেন্সির মাধ্যমে ভর্তি, বাংলাদেশের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট দেশের ভর্তি পরীক্ষার সময়ের ব্যবধান, ভারত, নেপালসহ বিভিন্ন দেশে বেসরকারি মেডিকেল কলেজের সংখ্যা বৃদ্ধি ও ফি কমানো, চীনসহ কয়েকটি দেশে বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য কম খরচে পড়ালেখার সুযোগ ও ইন্টারন্যাশনাল অ্যাক্রিডিটেশন না থাকা।
এ ব্যাপারে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. টিটো মিঞা বলেন, ‘বিদেশি শিক্ষার্থী কমে যাওয়ার পেছনে যুদ্ধ, করোনাসহ বৈশ্বিক অবস্থা একটা কারণ। তবে আরেকটা কারণ হলো বিদেশি শিক্ষার্থীদের বেশিরভাগ এজেন্সির মাধ্যমে আসে। শিক্ষার্থীরা আবেদন করলে আমরা তথ্য যাচাই-বাছাই করে যোগ্য বলে ছেড়ে দিই। বাকি ভর্তি প্রক্রিয়া হয় সংশ্লিষ্ট দেশের এজেন্সির মাধ্যমে। এসব এজেন্সির কারণেও শিক্ষার্থী কমছে।’
এ কর্মকর্তা আরও বলেন, ‘আমাদের বেশিরভাগ শিক্ষার্থী আসে ভারত ও নেপাল থেকে। ভারতে এখন একশর বেশি নতুন বেসরকারি মেডিকেল কলেজ হয়েছে। সেখানে লেখাপড়ার ফি কমানো হয়েছে। নেপালেও নতুন মেডিকেল কলেজ হয়েছে। নতুন কলেজ ও টিউশন ফি কমানোর কারণে ভারত ও নেপাল থেকে শিক্ষার্থী আসা কমেছে।’
শিক্ষার্থী কমার পেছনে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতাও একটি কারণ বলে মনে করেন অধিদপ্তরের মহাপরিচালক। তিনি বলেন, ‘একসময় আমাদের এখান থেকে অনেক শিক্ষার্থী কম মার্কস পেয়েও চীনসহ বিভিন্ন দেশে এমবিবিএস পড়তে যেত। এখন আমরা নিয়ম করেছি বিদেশে পড়তে যেতে হলে এখানে ভর্তি পরীক্ষায় ৪০ মার্ক পেতে হবে। এখন এখান থেকে চীনে যাওয়া কমেছে। চীন আবার নেপাল, ভারত, শ্রীলঙ্কা, কাশ্মীরসহ যেসব দেশ থেকে আমাদের এখানে বেশিরভাগ শিক্ষার্থী আসত, সেই শিক্ষা বাজারে ভাগ বসিয়েছে। এ কারণেও বিদেশি শিক্ষার্থীর সংখ্যাটা কমে যাচ্ছে।’
একজন অধ্যক্ষ জানান, যেসব কলেজ এজেন্টকে কমিশন কম দেয়, এজেন্টরা সেখানে শিক্ষার্থী দিতে চায় না। যেখানে কমিশন বেশি পায়, সেখানে শিক্ষার্থী দিয়ে দেয়। এ কারণে বাংলাদেশে বিদেশি শিক্ষার্থী কমছে। তিনি আরও জানান, এখানে বেশিরভাগই আসে ভারত থেকে। ওদের মেডিকেল কলেজে ভর্তি হতে হলে আগে একটি কোয়ালিফাইং পরীক্ষা দিতে হয়।
সেটাতে উত্তীর্ণ হলে মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষায় অংশ নিতে পারবে। সেই পরীক্ষা ভারতে মে মাসের শেষের দিকে হবে। তারপর শিক্ষার্থীরা আসতে শুরু করবে। কিন্তু এখানে ভর্তি মে মাসের মধ্যে শেষ হয়ে যাচ্ছে। ফলে ওরা আসতে চাইলেও পারছে না। দুই-এক বছর ধরে এ সমস্যার কারণে বিদেশি শিক্ষার্থী কমছে।
Posted ৩:০০ অপরাহ্ণ | শনিবার, ১৮ মে ২০২৪
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta