বিশেষ প্রতিবেদক :: কক্সবাজারের টেকনাফে ফের সক্রিয় হয়ে উঠেছে মানব পাচার চক্র। ছয়টি শক্তিশালী সিন্ডিকেটের ২ শতাধিক মানব পাচারকারী এ অবৈধ কাজে জড়িত। এরা বিভিন্ন এলাকা থেকে শিশু, নারী ও পুরুষ পাচারের জন্য জোগার করছে। এদের মধ্যে যাদের অর্থনৈতিক অবস্থা কিছুটা ভালো তাদের নিলামে তোলা হয়।
তাদের নিলামে কিনে নিয়ে আটকে রেখে মুক্তিপণ আদায় করা হচ্ছে। এমন অবস্থা এখন নিত্যদিনের।
সরেজমিন জানা যায়, মানব পাচারের জন্য ব্যবহার করা হয় টেকনাফ ও উখিয়ার ছয়টি নৌঘাট। নৌঘাট ছয়টি দিয়ে সাগরপথে মালয়েশিয়ায় লোক পাচার করা হচ্ছে।
মানব পাচারকারী ছয় সিন্ডিকেটের সদস্যরা হলেন- মো. হোছন প্রকাশ মাছন মাঝি (৪৫) (তার ভাই হাসেমের বাড়ি থেকে পুলিশ অভিযান চালিয়ে লোকজনকে উদ্ধার করেছিল), পিতা-শফিকুর রহমান, সদর ইউনিয়ন, নোয়াখালী পাড়া-কোনার পাড়া, বাহারছড়া ইউনিয়ন, টেকনাফ। তার ভাই মো. হাছন প্রকাশ আতুরী (৩৫), হাবিরছড়া, সদর ইউনিয়ন।
সুলতান মাহমুদউল্লাহ (৩২), পিতা-আবদুল হামিদ, গ্রাম-হাবিরছড়া, সদর ইউনিয়ন। রশিদ মিয়া (৩২) (বর্তমান মেম্বার, মাদক ও মানব পাচারকারী), পিতা-কবির আহমদ, গ্রাম-হাবিরছড়া, সদর ইউনিয়ন। আবদুল আমিন (৪২), পিতা-শহর মল্লুক, গ্রাম-হাবিরছড়া, সদর ইউনিয়ন।
(পাহাড়ের ভিতর অবস্থান নিয়ে মানব পাচার ও অপহরণ বাণিজ্য করে) এবং হুমায়ুন। এই ছয় সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করছে মানব পাচার। এরাই মানুষ নিলামে তুলছে। বিদেশে যাওয়া লোকজনকে নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিচ্ছে।
কক্সবাজারের সীমান্ত উপজেলা টেকনাফ। শাহপরীর দ্বীপ, লম্বরী, মহেশখালিয়াপাড়া এবং বাহারছড়াসহ সাগরতীরবর্তী ছয়টি ঘাট এখন আলোচনার কেন্দ্রে। কারণ এসব ঘাট দিয়ে সাগরপথে মালয়েশিয়া যাচ্ছে অনেকে। গত ৪ নভেম্বর মহেশখালীয়াপাড়ায় অভিযান চালিয়ে পাঁচ মানব পাচারকারীকে আটক করে পুলিশ। তাদের জিম্মিদশা থেকে উদ্ধার করা হয় একজনকে।
স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, এসব ঘাটে সক্রিয় রয়েছে অন্তত ২ শতাধিক মানব পাচারকারী।
টেকনাফ সদর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জিয়াউর রহমান বলেন, যারা মানব পাচার করছে তারা এখন অনেক সোচ্চার।পুলিশের তোয়াক্কা করছে না তারা।
বাহারছড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আমজাদ হোসেন খোকন বলেন, আমার ইউনিয়ন উপকূলে হওয়ায় এদিক দিয়ে পাচারের চেষ্টা বেশি হয়। এসব নৌঘাটে মানব পাচারে কারা সম্পৃক্ত তা জানে স্থানীয়রাও।
পরিচয় গোপন রাখার শর্তে স্থানীয়রা বলেন, লম্বরী ঘাটের সাইফুল, নতুন পল্লানপাড়ার সিরাজ মেম্বারের ছেলে আরিফ, ইয়াসিন, মাস্টার মাহবুব আলম, এনামসহ কয়েকজন মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত।
মানব পাচারের জন্য আলোচিত শাহপরীর দ্বীপে যে কজন সক্রিয় বলে অভিযোগ, তাদের অন্যতম আবুল কালাম ভুলু ও শাহপরীর দ্বীপ মাঝরপাড়ার জাইর হোসেনের ছেলে ছৈয়দ উল্লাহ (৪২)।
টেকনাফ উপকূলের নোয়াখালীপাড়ার কাটাবনিয়া-কচুবনিয়া, শাহপরীর দ্বীপ ঘাট ‘মালয়েশিয়া এয়ারপোর্ট’ নামে ব্যাপক পরিচিতি পায়। সম্প্রতি আবারও এ পথে মানব পাচার বেড়ে গেছে।
পাচারের পয়েন্ট : টেকনাফের সাগর তীরবর্তী কয়েকটি এলাকার পাশাপাশি কক্সবাজার ও চট্টগ্রামের বেশকিছু পয়েন্ট দিয়ে মানব পাচারের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে পাচারকারীরা।
এর মধ্যে কক্সবাজার শহরের নুনিয়াছটা, ফিশারিঘাট, নাজিরাটেক, সমিতিপাড়া; মহেশখালীর সোনাদিয়া, গোরকঘাটা, কুতুবজোম, ধলঘাটা; উখিয়ার সোনারপাড়া, রেজুরখাল, ইনানী, ছেপটখালী, মনখালী; টেকনাফ উপজেলার বাহারছড়া, নোয়াখালীপাড়া, মহেশখালীয়াপাড়া, শাহপরীর দ্বীপ, কাটাবনিয়া, খুরেরমুখ, হাদুরছড়া, জাহাজপুরা, কচ্ছপিয়া, শামলাপুর, সদরের ঈদগাঁও, খুরুশকুল, চৌফলন্ডী, পিএমখালী, চকরিয়া, পেকুয়া; চট্টগ্রামের বাঁশখালী, আনোয়ারা ও পটিয়া উল্লেখযোগ্য। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পাচারকারীরা সক্রিয়। ক্যাম্পের মো. ওসমান, আবদুল গফুর ও সাইফুল মানব পাচারের সঙ্গে জড়িত।
তারা উখিয়া-টেকনাফ রোহিঙ্গা শিবিরের বাসিন্দা। এ ছাড়া উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবিরে আরও কয়েকজন রোহিঙ্গা মানব পাচারকারী সক্রিয় হয়ে উঠেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।
অভিযুক্তরা হলেন- হাফেজ ছলিম, আতাত উদ্দিন, মোহাম্মদ আলম, আবদুর করিম, হাফেজ মোহাম্মদ আইয়ুব, আবদুল করিম, মোহাম্মদ ইলিয়াছ, মোহাম্মদ কবির, আমির হোসেন, মোহাম্মদ ফয়েজ, নূর হোছন, মোহাম্মদ নাগু, নুরুল কবির, আবুল কালাম, লাল বেলাল, দিল মোহাম্মদ, মোহাম্মদ ফারুক, জোবাইর হোসেন, লালু মাঝি, আলী আকবর, ইমাম হোসেন ও শুক্কুর।
মোহাম্মদ ছলিম, লম্বা কবির, মোহাম্মদ শাহর বিরুদ্ধে মামলা থাকলেও এলাকায় তারা পাচারে তৎপর রয়েছে। তবে মানব পাচার ঠেকাতে নজরদারির পাশাপাশি পুরনো পাচারকারীদের সহায়তায় নতুন কোনো চক্র তৈরি হচ্ছে কি না তা খতিয়ে দেখার কথা জানায় পুলিশ।
কক্সবাজার পুলিশ সুপার মো. মাহফুজুল ইসলাম জানান, যারা মিয়ানমার দিয়ে চলে যেত তাদের আমরা উদ্ধার করেছি। এর বাইরে পাচারকারীদের অনেক প্রচেষ্টাই আমরা নিষ্ফল করে দিয়েছি। এদিকে মানব পাচারকারীদের নতুন তালিকা করে দ্রুত আইনের আওতায় আনা না গেলে সাগরপথে মরণযাত্রা বেড়ে যাবে বলে আশঙ্কা স্থানীয়দের।
জানা গেছে, আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে মাঝে-মধ্যে সিন্ডিকেট সদস্যরা ধরা পড়লেও আইনের ফাঁকফোকরে তারা জেল থেকে বেরিয়ে আবারও শুরু করে মানব পাচার। স্থানীয়দের পাশাপাশি মালয়েশিয়া পাচার ভিত্তিক সিন্ডিকেটে যোগ হয়েছে রোহিঙ্গারা। রোহিঙ্গাদের একটি বড় অংশ তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পাচার প্রক্রিয়াকে ত্বরান্বিত করছে।
উখিয়া জালিয়াপালং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান ছৈয়দ চৌধুরী বলেন, দীর্ঘদিন পাচার প্রক্রিয়া বন্ধ ছিল। আবারও মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে পাচারকারী সিন্ডিকেট। তাদের খপ্পরে পড়ে অনেক পরিবার নিঃস্ব হচ্ছে।
এলাকার সচেতন মহল জানিয়েছে, আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার নজর এড়িয়ে বহু রোহিঙ্গা দালালের মাধ্যমে পাচার হয়ে বর্তমানে মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছে। এবং তাদের পরিবারের অনেকেই এখন বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন রোহিঙ্গা শিবিরে আছেন। এখানে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের সঙ্গে তাদের নিয়মিত যোগাযোগ রয়েছে। ওখান থেকে সিগন্যাল এলে তারা এখান থেকে দালালের মাধ্যমে মালয়েশিয়া যেতে মরিয়া হয়ে ওঠেন তারা।
Posted ১২:৩৬ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২৫ মে ২০২৩
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta