কক্সবাংলা ডটকম(১১ জানুয়ারী) :: ২৯ ডিসেম্বর ভোর সাড়ে চারটা। রাজধানীর শান্তিনগর মোড়ের ৫১ নম্বর বাড়ি। ছয় তলা বাড়ির ছাদ থেকে অজ্ঞাত পরিচয় এক ব্যক্তি নিচে পড়ে যান। ৫/৭ মিনিট পর ওই বাড়ি থেকে তিন যুবক ছুটে আসেন। তারা রক্তাক্ত দেহটি টেনে বাড়ির সামনের বেইলি রোডে রেখে দেন। কিছু সময় পর খবর পেয়ে সিদ্ধেশ্বরী পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই ইসহাকের নেতৃত্বে পুলিশের একটি টিম ঘটনাস্থলে পৌঁছে।
পুলিশ প্রাথমিকভাবে ধারণা করে, গাড়ির ধাক্কায় ওই ব্যক্তি নিহত হয়েছেন। সুরতহাল রিপোর্ট করে লাশ ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ মর্গে পাঠিয়ে দেয় পুলিশ। এ ঘটনার একদিন পর জানা যায়- ওই ব্যক্তির নাম সহির আলী। তিনি পেশায় রিকশা চালক। বাড়ি জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার ঝালরচরে। সেদিনই নিহতের চাচাতো ভাই আব্দুর রশিদ বাদী হয়ে রমনা থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা করেন।
মামলার বাদী দাবি করেন, সহিরকে হত্যা করা হয়েছে। এমন দাবির পরও পুলিশ বিষয়টি আমলে নেয়নি। পুলিশ বিষয়টি অপমৃত্যু হিসেবেই চালিয়ে দিতে চায়।
সহির আলীর পরিবারের অভিযোগ, যে বাড়ি থেকে তাকে ফেলে হত্যা করা হয়েছে সেই বাড়ির মালিক হাজী শামসুল হক ভুঁইয়া। তিনি রাজধানীর হক বেকারির মালিক। তার নাতি সামিউল হক ভুঁইয়া রন ও তার দুই বন্ধু সহির আলীকে ছাদ থেকে ফেলে দিয়েছে। রনর মা রোখসানা শিমু অভিযোগ করেন, চুরি করতে গিয়ে বাড়ির ছাদ থেকে পড়ে গিয়ে সহির আলীর মৃত্যু হয়েছে।
শিমুর সঙ্গে রমনা থানা পুলিশের বিশেষ সখ্যতারও অভিযোগ রয়েছে।
এ বছরের ৩ জানুয়ারি ডিবি পুলিশের একটি টিম তদন্ত করতে গিয়ে ওই বাড়ির পাশে একটি রিকশা খুঁজে পায়।
জানা যায়, রিকশাটি নিহত সহির আলী চালাতেন। এরপরই ডিবি পুলিশ দেখতে পায়, শান্তিনগরের ৫১ নম্বরের এই বাড়িতে চলে ইয়াবা ব্যবসা।
শামসুল হকের পাঁচ ছেলের মধ্যে তিনজনই মাদক সেবন ও ব্যবসা করতেন। মাদকসেবন করে নানা রোগে ভুগে সাইদুল হক ভুঁইয়া ছাদু, জহিরুল হক ভুঁইয়া ও ফজলুল হক ভুঁইয়া দিদার নামে তিন ভাই মারা যান। এদের মধ্যে ছাদুর বিরুদ্ধে ২০০০ সালে শান্তিনগর বাজারে মাছ ব্যবসায়ী আনু হত্যার অভিযোগ ছিল। এই ছাদুর ছেলে হলেন সহির আলী হত্যা মামলার আসামি রন।
জহির ও দিদারও শান্তিনগর এলাকায় ইয়াবা ব্যবসা করতেন। দিদার বেসরকারি একটি মেডিক্যাল কলেজে তৃতীয় বর্ষ পর্যন্ত পড়াশুনা করে মাদকাসক্তের কারণে বাদ পড়েন। ২০১০ সালের ৩০ জুলাই তিনি মারা যান। তার সাতদিন আগে ঢাকার ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিত্সাধীন অবস্থায় জহির মারা যান।
অভিযোগ রয়েছে, ইয়াবা ব্যবসা ও আসক্তির কারণে হক বেকারির মালিকের পরিবারটি একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেছে। বাপ-দাদার রেখে যাওয়া সম্পদের বেশিরভাগ অংশ বিক্রি করে ইয়াবা সেবনের পেছনে ব্যয় করেছেন তার উত্তরসূরিরা। শান্তিনগর এলাকায় ইয়াবা ব্যবসায়ীর তালিকায় রয়েছে রনর মা শিমুর নামও।
১১ জানুয়ারী রন’র মা রোকসানা শিমু এই প্রতিবেদকের কাছে তার ছেলের বিরুদ্ধে রিকশা চালককে ছাদ থেকে ফেলে দিয়ে হত্যার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে স্ট্যান্ডার্ড এইটে পড়ছে। এতটুক একটা বাচ্চা ছেলে এ ধরনের কাজ করতেই পারে না। ডিবি পুলিশ রনকে আটক করে মিথ্যা তথ্যের স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় করেছে। তার বিরুদ্ধে কোনো মাদক বিক্রির অভিযোগ নেই।’
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের উপ-কমিশনার (দক্ষিণ) মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ বলেন, রন জিজ্ঞাসাবাদে বলেছে যে, ওই রিকশা চালক ডলার বিক্রির নামে প্রতারণা মূলক ব্যবসা করতেন। এ কারণে রিকশা চালককে ধরে এনে বাড়ির ছাদে আটকে রাখা হয়েছিল। ছাদে রিকশা চালককে মারধর করার এক পর্যায়ে পালাতে গিয়ে পড়ে গিয়ে তার মৃত্যু হয়।
এ ঘটনার পর রন বাড়ি থেকে পালিয়ে যায়। পুরান ঢাকার তার এক বন্ধুর বাড়ি থেকে তাকে গ্রেফতার করা হয়। পরে রন ও তার দুই বন্ধুকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এ ব্যাপারে মঙ্গলবার রন ও শুভ আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। বাবু এখনও রিমান্ডে রয়েছে।
মামলার তদন্ত সংশ্লিস্ট এক কর্মকর্তা বলেন, ২৮ আগস্ট রাতে রন তার বাড়ির ছাদে পার্টির আয়োজন করে। পার্টিতে ইয়াবা সেবন করা হয়। রিকশা চালক সহির আলীকে রাত ১১ টার দিকে ধরে আনা হয়। ছাদের এক পাশে রিকশা চালককে বেঁধে রাখে। গভীর রাতে পার্টি শেষ হওয়ার পর সহির আলীকে মারপিট করে রন ও তার বন্ধুরা। এক পর্যায়ে সহির আলী নিচে পড়ে যায়।
পুলিশের রমনা জোনের সহকারী কমিশনার এহসান বলেন, তদন্তে প্রমাণিত হয়েছে যে রন পরিকল্পিতভাবে ওই রিকশা চালককে হত্যা করেছে। রন’র বিরুদ্ধে মাদক ব্যবসার অভিযোগও রয়েছে।