কক্সবাংলা ডটকম(৬ জুন) :: চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের পর এবার ভিন্ন পরিস্থিতিতে উদযাপিত হতে যাচ্ছে ঈদুল আজহা। গতবারের ঈদুল আজহার সময় ব্যাপক আলোচনায় ছিল সাদিক অ্যাগ্রো ও সাবেক এনবিআর কর্মকর্তা মতিউরের পুত্রের ছাগলকাণ্ড, সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদের লুটপাটসহ তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের নানা দুর্নীতি। ওই ঈদুল আজহার পর দুই সপ্তাহ পার না হতেই শুরু হয়ে যায় সরকারি চাকরিতে কোটা নিয়ে বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন। এর ফলে ছাত্র-জনতার ব্যাপক অংশগ্রহণে রক্তঝরা গণ-অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হতেও বেশি সময় লাগে না।
রাজনীতিকরা ঈদুল আজহার দীর্ঘ সরকারি ছুটিতে নিজ নিজ এলাকায় নির্বাচনমুখী তৎপরতা বাড়াতে সক্রিয় থাকবেন। জনসংযোগ বাড়াবেন। ঈদুল আজহার পর দ্রুত নির্বাচনের দাবি আদায়ে প্রস্তুত থাকতে দলীয় কর্মীদের প্রস্তুতি সম্পন্ন করবেন। নতুন দলগুলোর সাংগঠনিক বিস্তৃতি ঘটনোই লক্ষ্য হবে এবারের ঈদে।
কোরবানির পশু বিক্রেতাদের আশঙ্কা, প্রায় ১৬ বছর ধরে যাঁরা ক্ষমতায় থেকে ব্যাপক লুটপাট ও দুর্নীতির মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়েছিলেন, খদ্দের হিসেবে এবার হয়তো তাঁদের পাওয়া যাবে না। সে কারণে বেচাকেনা কম হতে পারে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় এবারও মূল ভরসা হিসেবে মাঠে থাকছে পুলিশসহ অন্যান্য বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যরা। সরকারি দীর্ঘ ছুটির মধ্যেও দেশকে নিরাপদ রাখার লক্ষ্য পূরণে তাঁরা নিরলস।
এবার ঈদুল আজহা উদযাপন হতে যাচ্ছে এমন সময়, যখন দেশ প্রয়োজনীয় সংস্কার ও আরেকটি জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে গণতন্ত্রে ফেরার পথে। এবার সবচেয়ে বেশি আলোচনা রাজনীতি ও নির্বাচন। কত দিন থাকবে অন্তর্বর্তী সরকার, কি ডিসেম্বরেই হতে যাচ্ছে, সংস্কার কতটা হবে—এ প্রশ্ন এখন সর্বত্র। এর মধ্যে বেকারত্ব বেড়ে যাওয়া, আর্থিক মন্দা, ব্যবসা-বাণিজ্যে প্রায় অচলাবস্থাও অন্যতম আলোচ্য বিষয়।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সুস্পষ্ট রোডম্যাপ আদায় না হলেও ঈদে নির্বাচনি আমেজে ভোটের মাঠে সরব বিএনপি, জামায়াত, এনসিপিসহ দেশের সব রাজনৈতিক দল। মুক্ত পরিবেশে সাধারণ মানুষসহ কর্মী-সমর্থকদের কাছে যাচ্ছেন দলগুলোর নেতারা। ঈদুল আজহায় শুভেচ্ছা বিনিময়ের নামে চালাচ্ছেন প্রচার ও গণসংযোগ। মনোনয়নপ্রত্যাশীরা নির্বাচনি মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। নিজ নিজ দলীয় সিদ্ধান্ত তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের জানাচ্ছেন। তাদের চাঙা করছেন। দিচ্ছেন নানান প্রতিশ্রুতি। সব মিলিয়ে ঈদের মাঠে বইছে নির্বাচনি হাওয়া।
জানা যায়, প্রতিটি দলের নেতারাই আগামী নির্বাচন কেন্দ্র করে জনসাধারণের কাছে সহযোগিতা চাইছেন। ঈদ পুনর্মিলনী, মতবিনিময় সভা এবং নানান ধরনের সেমিনারে অংশ নিয়ে তাঁরা কৌশলে নিজের প্রার্থিতা ঘোষণা করছেন। এতে ঈদকেন্দ্রিক ভোটের রাজনীতি জমে উঠেছে। এবারের ঈদে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে থেকে সহযোগিতার জন্য বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের নির্দেশনা রয়েছে।
এ ছাড়া দলের ৩১ দফা প্রস্তাব তুলে ধরছেন। পাশাপাশি সুস্পষ্ট নির্বাচনি রোডম্যাপ ঘোষণার দাবি জানাচ্ছেন। দলের সিংহভাগ নেতাই ঈদের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে নির্বাচনি এলাকার মানুষের পাশে থাকার চেষ্টা করছেন। সেই সঙ্গে নির্যাতিত ও গুম-খুনের শিকার নেতা-কর্মীর পরিবারের পাশেও দাঁড়াচ্ছেন। বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ইতোমধ্যে সব আসনে তাদের সম্ভাব্য প্রার্থী চূড়ান্ত করেছে। এসব প্রার্থী তৃণমূল নেতা-কর্মীর সঙ্গে ঈদ আনন্দ ভাগাভাগি করতে এলাকায় গেছেন।
লম্বা ছুটি কাজে লাগিয়ে কর্মী-সমর্থকদের আরও চাঙা করতে চাচ্ছে দলটি। বসে নেই তরুণদের নতুন দল জাতীয় নাগরিক পার্টি-এনসিপির নেতারাও। দলটির অধিকাংশ নেতা এবার নিজ এলাকায় ঈদ উদ্যাপন করবেন। এ তিনটি দলের বাইরে অন্য রাজনৈতিক দলের সম্ভাব্য প্রার্থীরাও নিজ নির্বাচনি এলাকায় গিয়েছেন।
যারা নিজ এলাকায় কাটাচ্ছেন তারা ঈদ উৎসবে যোগদানের পাশাপাশি সবাই দুস্থদের মধ্যে কোরবানির পশুর গোশত বিতরণ করবেন। সামাজিক-রাজনৈতিক-ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে, ঈদ কার্ড, এসএমএস পাঠিয়ে এবং সোশ্যাল মিডিয়া ও ব্যানার-পোস্টারের মাধ্যমে গণসংযোগ করছেন সম্ভাব্য প্রার্থীরা। ঈদ বকশিশের নামে অনেক প্রার্থী দিয়েছেন নগদ টাকা। নেতা-কর্মীর পাশাপাশি সাধারণ ভোটারদের জন্য ঈদের দিন ভোজের আয়োজনও করবেন অনেকে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন- ফ্যাসিস্টের পতনের পর এখন দেশে নির্বাচনি হাওয়া বইছে। সবার মধ্যে আনন্দ-উচ্ছ্বাস বিরাজ করছে। উৎসবমুখর পরিবেশ দেখা যাচ্ছে। সবার মধ্যে নির্বাচনের উৎসাহ ও আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। সবার মনে হচ্ছে, দেশ নির্বাচনের দিকে যাচ্ছে। এখানে যেভাবে উৎসবমুখর পরিবেশে নির্বাচন হতো, আজ মনে হচ্ছে বাংলাদেশের মানুষ সেভাবে বহু বছর পর নির্বাচনের সেই আনন্দঘন পরিবেশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। গণতন্ত্রের স্বাদ পাচ্ছেন। তবে পুরো পরিবেশ আসেনি। এ জন্য দ্রুত নির্বাচনি সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ ঘোষণা করতে হবে। ঈদের দিনে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া গুলশান বাসভবন থাকবেন।
স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন গুলশানে, মির্জা আব্বাস শাহজানপুরে, গয়েশ্বর চন্দ্র রায় কেরানীগঞ্জ, ড. আবদুল মঈন খান নরসিংদীতে, নজরুল ইসলাম খান বনানীতে, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী চট্টগ্রামে, সালাহউদ্দিন আহমেদ কক্সবাজারে, সেলিমা রহমান বনানীতে, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু সিরাজগঞ্জে, হাফিজউদ্দিন আহমদ বীরবিক্রম বনানীতে, আবদুস সালাম আজাদ মুন্সীগঞ্জে নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কুশল বিনিময় করছেন।
জামায়াতে ইসলামী ইতোমধ্যে ৩০০ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করেছে। ঈদ উপলক্ষে দলটির সম্ভাব্য প্রার্থীরা এলাকায় মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। জুলাই আন্দোলনে শহীদ পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে ঈদের আনন্দ ভাগাভাগি করছেন। শহীদ পরিবারের বাসা-বাড়িতে গিয়ে পরিবারের সার্বিক খোঁজখবর নিচ্ছেন।
জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান তার নির্বাচনি এলাকায় (ঢাকা-১৫), সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার খুলনায়, নায়েবে আমির সাবেক এমপি ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের কুমিল্লায়, জামায়াত নেতা মাওলানা শামসুল ইসলাম চট্টগ্রামে, এটিএম মাছুম কুমিল্লায়, মোয়াজ্জম হোসাইন হেলাল বরিশালে, মাওলানা রফিকুল ইসলাম খান সিরাজগঞ্জে, মাওলানা মুহাম্মদ শাহজাহান চট্টগ্রামে, হামিদুর রহমান আযাদ কক্সবাজারে নিজ নির্বাচনি এলাকায় নানা সামাজিক অনুষ্ঠানে অংশ নেওয়ার পাশাপাশি সাধারণ মানুষের সঙ্গে মতবিনিময় করছেন।
দলটির নেতারা বলছেন, দীর্ঘ বছর পর খোলা পরিবেশে সব মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে ঈদ করতে পারছি এবার।
এতদিন জামায়াতে ইসলামীসহ বিরোধী শিবিরের সব নেতা-কর্মীর মনের মধ্যে অজানা ভয় আর আতঙ্ক নিয়ে চলতে হতো। মানুষের মন থেকে সেই ভয় কেটেছে। ছাত্র-জনতার আন্দোলন এ দেশের মুক্তিকামী মানুষের মধ্যে নির্ভয়ে চলার প্রেরণা জুগিয়েছে। এনসিপির সদস্যসচিব আখতার হোসেন নিজ এলাকা রংপুরে, সিনিয়র যুগ্ম মুখ্য সমন্বয়ক আবদুল হান্নান মাসউদ নোয়াখালী-৬, উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম পঞ্চগড়-১, আরেক মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ কুমিল্লা-৪, মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী চাঁদপুরে এবং ঢাকা-১৩ আসনে যুগ্ম সদস্যসচিব আকরাম হুসাইনসহ আরও অন্তত ৪০ নেতা গেছেন তাদের নির্বাচনি এলাকায়।
জুলাই বিপ্লবের পর থেকেই প্রত্যন্ত এলাকায় ব্যাপক জনসংযোগ চালিয়ে যাছেন তারা। আলোচনা সভা, আগাম নির্বাচনি প্রচার-প্রচারণায় ব্যস্ত সময় পার করছেন।
এ ছাড়া জাতীয় পার্টি (জাপা), ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এলডিপি, জাতীয় পার্টি-জেপি, বাংলাদেশের সাম্যবাদী দল (এম.এল), কৃষক শ্রমিক জনতা লীগ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, বিকল্পধারা বাংলাদেশ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদ, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জেএসডি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি-বিজেপি, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ, ন্যাশনাল পিপলস্ পার্টি-এনপিপি, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, গণফোরাম, গণফ্রন্ট, বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-বাংলাদেশ ন্যাপ, বাংলাদেশ জাতীয় পার্টি, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশ, বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি, ইসলামী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ মুসলিম লীগ-বিএমএল, বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তিজোট (মুক্তিজোট), বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট-বিএনএফ, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন-এনডিএম, বাংলাদেশ কংগ্রেস, ইনসানিয়াত বিপ্লব বাংলাদেশ, বাংলাদেশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-বাংলাদেশ জাসদ, বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন-বিএনএম, বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি বিএসপি, আমার বাংলাদেশ পার্টি-এবি পার্টি, গণঅধিকার পরিষদ, নাগরিক ঐক্য, গণসংহতি আন্দোলন, বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি, বাংলাদেশ মাইনরিটি জনতা পার্টি ঈদে নিজেদের সাংগঠনিক তৎপরতা চালাচ্ছে। নিজেদের সাধ্য অনুযায়ী কর্মসূচির মাধ্যমে ভোটের মাঠে নিজেদের উপস্থিতি জানান দিচ্ছেন।
Posted ১০:৫২ পূর্বাহ্ণ | শুক্রবার, ০৬ জুন ২০২৫
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta