শহিদুল ইসলাম,উখিয়া(৮ সেপ্টেম্বর) :: মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সহিংসতা থেকে বাঁচতে গত দুই সপ্তাহে ২ লাখ ৭০ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছে বলে শুক্রবার দাবি করেছে জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর।
ইউএনএইচসিআর জানায়, বৃহস্পতিবার পর্যন্ত তারা ১ লাখ ৪৬ হাজার রোঙিঙ্গা আসার কথা বলছিলেন। কিন্তু সীমান্তের নতুন কিছু এলাকায় শরণার্থীদের অবস্থানের তথ্য আসার পর ওই সংখ্যা হঠাৎ করে অনেক বেড়ে গেছে।
সাম্প্রতিক ক্লিয়ারেন্স অপারেশনের লক্ষ্যে রাখাইন রাজ্যে সেনা মোতায়েন শুরুর কয়েকদিনের মাথায় ২৪ আগস্ট ২৪টি পুলিশ চেকপোস্টে ‘বিদ্রোহী রোহিঙ্গা’দের সমন্বিত হামলা হয়। রাতভর সংঘর্ষে বিদ্রোহী-পুলিশ-সেনাসদস্য মিলে অন্তত ১০৪ জন নিহত হয়েছে বলে জানায় সেনাসূত্র।
এ হামলার পর নতুন করে সেনা অভিযান শুরু হলে বাংলাদেশ সীমান্তে শরণার্থীদের ঢল নামে।মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের ওপর জাতিগত নিপীড়ন চলে আসছে কয়েক দশক ধরে। বিভিন্ন সময়ে সহিংসতার মুখে সেখান থেকে পালিয়ে এসে পাঁচ লাখের বেশি মানুষ বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়ে আছে।
ঈদের দিনে নাফ নদীতে জন্ম !
স্বজন হারানোর বেদনায় নিজেকেও হারিয়ে ফেলি। প্রসব বেদনায় কাঁতর ছিলাম। সময় গড়াচ্ছে। ঘন্টা, দিন, সপ্তাহ কখনো হেঁটে, কখনো স্বামীর ঘাঁড়ে হেলে পড়ি। অবশেষে ৭দিন পর মিয়ানমারের খাল পরবর্তী নাফ নদী পার হয়ে এপারে ওঠার পর -পরই প্রসব বেদনায় ঢলে পড়ি। দীর্ঘ ৪ ঘন্টা প্রসব বেদনা সহ্য করে প্রথম সন্তানের, মা, হলাম একবারেই পেলাম দুই জমজ শিশু সন্তান।
উপরোক্ত কথাগুলো বলেছেন মিয়ানমারের বলিবাজারের গর্জনবিল গ্রাম থেকে মগ সেনাদের নির্যাতনে পালিয়ে আসা নবজাতকের মা খালেদা বেগম (১৭) আর নাফ নদীর পাড়েই জমজ শিশু দুটির জন্ম।
মিয়ানমারের সেনা ও নিরাপত্তা বাহিনীর নির্যাতনের শিকার হয়ে পালিয়ে আসা এক রোহিঙ্গা নারী নাফ নদীতে নৌকার মধ্যে সন্তান প্রসব করেন। ৭ দিন আগে জন্ম নেওয়া নবজাতক দুটিসহ সেই পরিবার আশ্রয় নিয়েছে ক্তুুপালং রাস্তার পাশে এক ঝুপড়িতে। অনাহারেই দিন কাটছে তাদের।
বৃহস্পতিবার সকাল ১১টায় উখিয়ার কুতুপালং ঝুপড়িতে কথা হয় ওই নবজাতক পিতা আহমদ উল্লাহর সাথেও।
তিনি বলেন কোরবানির ঈদের দিন রাত ১২টার দিকে নাফ নদীতে নৌকার উপর তাঁর স্ত্রীর প্রসব যন্ত্রণা শুরু হলে ছটফট করতে থাকে। তখন নৌকায় শুধুমাত্র ১জন নারী ছিল, বাকীরা সবাই পুরুষ। তখন চোঁখে মুখে কিছু না দেখে আমি নিজেই সহযোগিতা করি আমার স্ত্রীকে।
স্ত্রী খালেদা বেগম বলেন এটি আমার প্রথম সন্তান। তাও আবার দইজনই ছেলে। এখনো নাম রাখিনি। যেহেতু ঈদের দিন জন্ম হয়েছে তাই মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছি কোরবান আলী নাম রাখব। হাসি মুখে তিনি আরো জানান, সন্তানের চেহেরা দেখে তিনি মিয়ানমারের সেই করুণ স্মৃতি ভুলে গেছেন।
পাহাড়-জঙ্গলে লতাপাতা খেয়ে বেঁচে ছিলেন দিলবাহাররা
দিল বাহারের বয়স ৬০। মিয়ানমারের রাখাইনে সেনা অভিযানে প্রাণ গেছে তাঁর ছেলে মাহবুবের। ঘরবাড়ি ছারখার হয়েছে। নাতি আর স্বামীকে নিয়ে পালিয়ে ১২ দিন কাটিয়েছেন পাহাড়-জঙ্গলে। সঙ্গে থাকা চাল শেষ হয়ে গেছে আট দিনেই। বাকি দিনগুলো কাটিয়েছেন বৃষ্টির পানি আর লতাপাতা খেয়ে। এরপর মাছ ধরার কাঠের নৌকায় চেপে এসে নেমেছেন বাংলাদেশ সীমান্তের উপকূলে।
সেখানে তাঁর সঙ্গে দেখা হয় সাংবাদিকদের সঙ্গে। সাংবাদিকদের জানান, দিল বাহার একটানা কাঁদছিলেন। তাঁর স্বামী জাকির মামুন পেছনে দাঁড়িয়েছিলেন। মুখে দাঁড়ি। দুর্বল শরীর। সঙ্গে রয়েছে নাতি মাহবুব। কিশোর মাহবুবের হাত ব্যান্ডেজের মতো করে বেঁধে রাখা হয়েছে। ব্যথায় কুঁকড়ে যাচ্ছে তার মুখ। দিল বাহার জানালেন, মাহবুবের হাতে গুলি লেগেছে।
জাকির মামুন জানালেন, বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে মাত্র ৫০ কিলোমিটার দূরে মিয়ানমারের বুথিডং এলাকায় তাঁদের বাড়ি। হঠাৎই হামলা চলে তাঁদের গ্রামে। জাকির বলেন, ‘সেনাবাহিনী আমাদের বাড়িসহ অনেক বাড়িতে বোমা ছোড়ে। আগুন ধরিয়ে দেয়। গ্রামবাসী পালানোর চেষ্টা করলে নির্বিচারে গুলি চালায়। সারা রাত ধরে গুলি চলেছে। পরদিন সকালে দেখি গ্রামটি ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছে। গ্রামের বাড়িগুলো থেকে ধোঁয়া উড়ছে। সবকিছু হারিয়েছি আমরা। হামলায় মারা গেছেন আমার ছেলে—মাহবুবের বাবা। পরে আমরা প্রাণ নিয়ে কোনো রকমে পালিয়ে পাহাড়ি এলাকায় ঢুকে পড়ি।’
আবার দেখা হবে ভাবেননি নাবি হাসান ও বোন রহিমা খাতুন। জাকির-দিল বাহারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, প্রাণভয়ে বিধ্বস্ত বাড়ি থেকে কয়েকটি বাসনপত্র ও চাল নিয়ে বের হন তাঁরা। ১২ দিন ধরে তাঁরা দুটি পাহাড় ও বনজঙ্গলে ঘুরেছেন। তাঁদের কাছে যেটুকু চাল ছিল, তা আট দিনেই শেষ হয়ে যায়। নিরুপায় হয়ে লতাপাতা ও বৃষ্টির পানি খেয়ে প্রাণ বাঁচান তাঁরা। বাংলাদেশ সীমান্তের উপকূলে নামার পর আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম) পরিচালিত একটি হাসপাতালে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে মাহবুবকে।
ছোট ছোট নৌকায় চেপে বাংলাদেশ উপকূলে ভিড়ছে রোহিঙ্গারা। কাছাকাছি গেলে দেখা যাবে গাদাগাদি করে আছে রোহিঙ্গারা। নৌকার পাটাতনে রয়েছেন নারীরা। শক্ত করে ধরে রেখেছেন শিশুদের। পুরুষেরা নৌকার একদিকে বসে রয়েছেন। সীমান্তের শ্যামলাপুরের কাছেই আরেকটি নৌকা ভিড়ল। তীরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেল কালো পোশাক পরা মধ্যবয়সী এক নারীকে। নাম রহিমা খাতুন। উদ্বিগ্ন চোখে তাকাচ্ছিলেন এদিক-সেদিক।
রহিমা খাতুন তাঁর ভাইয়ের জন্য অপেক্ষা করছিলেন। জানালেন, ১০ দিন আগে মিয়ানমারের মংগদুতে তাঁদের এলাকায় হামলা হয়। পালানোর সময় তাড়াহুড়োতে অনেকেই আলাদা হয়ে যায় একে অন্যের থেকে। তখন থেকেই প্রতিদিন তীরে এসে ভাই নবি হাসানকে খোঁজেন রহিমা। ৪ নম্বর নৌকাটি তীরে ভেড়ার সঙ্গে সঙ্গে সামনের দিকে ছুটে গেলেন রহিমা। তাঁর দিকে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হেঁটে আসতে দেখা গেল এক যুবককে। পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে শুরু করলেন তাঁরা। বোঝা গেল তিনিই রহিমার সেই হারিয়ে যাওয়া ভাই। রহিমা ও নাবি ভাবেননি আবার দেখা হবে। নাবি বললেন, ‘পরিবারের ১০ সদস্যের মধ্যে বেঁচে আছি মাত্র দুজন। গ্রামে হামলা চালিয়েছে সেনাবাহিনী।’সাগর পেরিয়ে পালিয়ে আসছেন রোহিঙ্গারা।
মিয়ানমারের সেনাবাহিনী এ ধরনের হামলার কথা অস্বীকার করেছে। তাদের ভাষ্য, তারা কেবল রোহিঙ্গা জঙ্গিদের লক্ষ্য করেই হামলা চালাচ্ছে। রাখাইনে পুলিশ চৌকিতে হামলাকারীদের লক্ষ্য করেই তাঁদের অভিযান।কক্সবাজারে বালুখালীর একটি শরণার্থীশিবিরে আছেন অনেক রোহিঙ্গা। অনিশ্চিত জীবনের দুশ্চিন্তায় থাকা রোহিঙ্গাদের জন্য এটি একটি অস্থায়ী আবাস। সাধারণ প্লাস্টিক ও বাঁশ দিয়ে এই শিবির তৈরি করা হয়েছে। সেখানে তাদের ত্রাণ দেওয়া হচ্ছে। জাকির মামুন বলেন, ‘বাংলাদেশে পৌঁছে তিনি একটু স্বস্তি পাচ্ছেন। এটি মুসলিমপ্রধান দেশ। এখানে তাঁরা নিরাপদে থাকবেন।’
৫ দিন ধরে মাকে কাঁধে নিয়ে এপারে অছিউর
মিয়ানমার থেকে বিভিন্ন পাহাড় জঙ্গল,জোরঝাপ পেরিয়ে মিয়ানমারের সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিপির চোখ ফাঁকি দিয়ে ৫ দিন ধরে গর্ভধারিনী মাকে কাঁধে দিয়ে ক্লান্ত অবষন্ন শরীর নিয়ে হোয়াইক্যং লম্বাবিল সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে মিয়ানমারের মন্ডু সবরদি বিল গ্রামের অছিউর রহমান (৪৪)। তার কাঁধে ৭৫ বছর গর্ভধারিনী বৃদ্ধ মা মমতাজ বেগম। বয়সের কারনে তিনি খুব একটা হাঁটতে পারেননা। তাই ছেলে অছিউর ৫ দিন ধরে মাকে কাঁদে নিয়ে বয়ে বেড়িয়েছেন সীমান্তের বিভিন্ন অঞ্চল। কখনো জঙ্গলে,কখনো পাহাড়ে রাত কেটেছে মা ছেলের।
মিয়ানমার থেকে সঙ্গে আনা যৎসামান্য শুকনো খাবার বৃদ্ধ মাকে খাইয়েছেন। তাও আবার তিনদিন। একদিন ধরে অভুক্ত তার মা। আর ছেলে অভুক্ত ৫ দিনের। তাই সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করা মাত্রই ক্ষিধার জ¦ালায় কান্না জুড়ে দেন অছিউর রহমান।
গত বৃহস্পতিবার হোয়াৎক্যং লম্বাবিল সীমান্ত সরেজমিন পরিদর্শনকালে অছিউর রহমান নিয়েই জানান, পরিবারের অন্যন্য সদস্যরা কয়েকদিন আগেই বাংলাদেশে পাড়ি জমায়। মা ও ছেলে ছিল মিয়ানমারে। কিন্তু মিয়ানমার বাহিনী যখন একের পর এক গ্রাম পেট্রোল দিয়ে জ¦ালিয়ে দিচ্ছিল, তখন সে মাকে কাঁদে নিয়ে পালাতে থাকে, ৫ দিন ধরে বিভিন্ন জঙ্গল পেরিয়ে অবশেষে লস্বাবিল সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে মা,ছেলে। শুধু মা,ছেলে নয়, সীমান্ত জুড়ে এখন অসংখ্য কাহিনী। কেউ বৃদ্ধ বাবাকে নিয়ে এসেছেন, কেউ কাঁধে করে নিয়ে এসেছেন প্রতিবন্ধি বোনকে। সবার মুখে হতাশা ও আতংকের ছাপ।
স্থানীয় জনগন নতুন আসা রোহিঙ্গাদের শুকনো খাবার দিয়েও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। পরিদর্শনকালে লম্বাবিল সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশ করা রোহিঙ্গাদের বর্ণনায় যা উঠে আসে তা হৃদয়বিদারক, লোমহর্ষক। দুই শিশু সন্তান নিয়ে সীমান্ত পেরিয়ে আসা ফাতেমা বেগম(২৫) জানান, তার স্বামী বাড়ির পার্শ্বে লুকিয়ে ছিল। এসময় সেনাবাহিনী ও রাখাইন সম্প্রদায়ের একটি দল তাকে ধরে নিয়ে যায়।
কেরোসিনের আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয় তার ঘর। জীবন বাঁচাতে দু’টি সন্তান কে নিয়ে পালিয়ে এসেছে, স্বামীর কি অবস্থা এখনো জানেনা সে। তার ভাষায়,মিয়ানমারে মুসলিম রোহিঙ্গা নিধনে ধ্বংসলীলা চালাচ্ছে সে দেশের সেনাবাহিনী ও পুলিশ,পাশাপাশি স্থানীয় রাখাইন সম্প্রদায়ও হামলা চালাচ্ছে গ্রামে গ্রামে। পুরুষ যুবকদের হত্যা করা হচ্ছে,ধরে নিয়ে গিয়ে রোহিঙ্গা যুবতীদের উপর চালাচ্ছে পাশবিক নির্যাতন।
বসতবাড়ীতে আগুন দেওয়া হচ্ছে, মিয়ামমারে প্রকাশ্যে জুলুম হচ্ছে,কিন্তু কেউ প্রতিবাদ করছেনা এ কথা বলতে বলতে ফাতেমা কান্নায় ভেঙ্গে পড়েন।মংন্ডু পোয়াখালী গ্রামের জমিলা খাতুন (৪৫) জানায়,তারা মিয়ানমার বাহিনীর আক্রমনে দিশেহারা হয়ে সেদেশের সীমান্ত এলাকার খেয়াবনে কিছু না খেয়ে ৫ দিন লুকিয়ে আত্মগোপন করেছিলেন। পরিবর্তিতে ৭ দিন পায়ে হেটে সীমান্ত পেরিয়ে অবশেষে বাংলাদেশে এসছেন।
সে আরো জানায়,তার পাশের বাড়ীটি লুটপাট করে আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দিলে তার বাড়ীটিও পুড়ে যায়। মংন্ডু পোয়াখালী গ্রামের সব হারিয়ে নিঃস্ব মমতাজ বেগম (৪০) জানায়,সেনা সদস্যরা তাদের গ্রামে লুটপাট চালিয়ে মেয়েদের ইজ্জত লুন্ঠন করছে। ছেলেদের ধরে নিয়ে জবাই করে মারছে। ছোট ছোট ছেলেদের আগুনে নিক্ষেপ করছে। নৃশংস এ বর্বরতার হাত থেকে রেহায় পাওয়ার জন্য ছেলে মেয়ে নিয়ে এখানে চলে এসেছি।
সে দুঃখ করে বলেন,এত সহায় সম্পদ থাকা সত্ত্বেও আজ এক কাপড়ে অনাহারে দিন কাটাতে হচ্ছে। স্বামী হারা সাজু বেগম(২৫) জানায়,পুলিশ তার স্বামী ইউনুছ কে ধরে নিয়ে গেছে।পরে শুনেছি তাকে মেরে ফেলে লাশ আগুন দিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়েছে।শিশু সন্তান ফায়সাল (৫), রাশেদ (৩) ও আনোয়ার (২) এই তিন সন্তানকে নিয়ে কোন রকমে বেচে পালিয়ে এসেছি।
খেয়ারীপাড়ার আব্দুল হামিদ (২৬) জানায়,ঘরে আগুন দিয়ে পুড়ে দেওয়ার সময় তার চোখের সামনে বয়োবৃদ্ধ পিতা শফিউল্লাহকে (৫৫) মারা যায়। উপান্তুর না দেখে বাবার লাশ ফেলে মাকে নিয়ে সীমান্ত পার হয়ে বাংলাদেশে চলে এসেছি। নাগপুরা থেকে পালিয়ে আসা আব্দুল গফুর (৪০) জানায়, গত এক সপ্তাহ ধরে মগসেনারা সীমান্তের ঢেকিবনিয়া, কুমিরখালী,শিলখালী,বলিবাজার ও নাগপুরা সহ ২০টি গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে। এখনো গ্রামের পর গ্রাম জ¦লছে।
বয়োবৃদ্ধ মরিয়ম খাতুন (৫৫) জানায়,তার ছেলে ইমাম শরীফ (২৮) ও তার পুত্র বধু মনোয়ারা (২২) ৩ জনের সংসার তছনছ করে দিয়েছে মগসেনারা। এভাবেই প্রবেশকৃত রোহিঙ্গাদের বর্ননায় ভারী হয়ে উঠেছে সীমান্ত এলাকার পরিবেশ। প্রতিদিনই আসছে রোহিঙ্গার ¯্রােতা। প্রতিদিনই শোনা যাচ্ছে মন সেনাদের নির্মমতার কাহিনী। কিন্তু বিশ^ বিবেক এখনো নিবর।
৯৭ বছরে এমন বর্বরতা দেখিনি’
নাজির হোসেন। বয়স ৯৭ বছর। বাপ-দাদার ভিটেমাটি ছেড়ে কখনোই বাংলাদেশে আসতে চাননি। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অত্যাচার সহ্য না করতে পেরে তিন ছেলে আগেই বাংলাদেশে এসেছেন। শুধু একাই বাড়িতে রয়ে গিয়েছিলেন তিনি। কারণ সেখানে তার দাদা-দাদি থেকে শুরু বাবা-মা ও স্ত্রীর কবর। সেই জন্মভূমিতেই প্রিয়জনদের পাশে চিরনিন্দ্রায় শায়িত হওয়ার শেষ ইচ্ছা ছিল তার। কিন্তু মিয়ানমার সেনাবাহিনী তাকে নিজের ভিটেমাটিতে থাকতে দেয়নি। বাধ্য করেছে বাংলাদেশে পালিয়ে আসতে। তিনি বলেন, ‘ভারত-পাকিস্তান স্বাধীন হতে দেখছি, বাংলাদেশ স্বাধীন হতে দেখছি। আমার ৯৭ বছর বয়সে এত বর্বরতা দেখিনি।’
নাজির হোসেন জানান, ‘আমার বাবার নাম আব্দুল খালেক। দাদার নাম ওয়াজ উদ্দিন। আমার পূর্বপুরুষ রাইখাইনের বাসিন্দা। আমরা খুব ধনী ছিলাম। ভারত-পাকিস্তান ভাগ হওয়ার আগে ভারতের একটি মাদ্রাসায় পড়াশোনা করেছি। মিয়ানমারের বলিবাজার থানার নাগপুরায় থাকতাম। ওই এলাকায় ১৬ কানি আবাদি জমি আছে।’
মিয়ানমার সেনাবাহিনী গত ২৪ আগস্ট তার বাড়িতে যায়। তখন তার ছেলেরা কেউ বাড়িতে ছিলেন না। সেনাসদস্যরা তাকে ছেলেদের কথা জিজ্ঞাসা করে। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘মিলিটারিরা আমাকে প্রশ্ন করে, বাংলাদেশে যাবি, নাকি তোর ছেলেদের গুলি করে মারব? আমি বলি, ছেলেরা যাবে। আমি যাব না। এরপর মিলিটেরিরা ঘরে তল্লাশি চালায়। কিন্তু তখন কেউ ছিল না। ছেলেরা সবাই পাহাড়ে পালিয়ে ছিল।’ নাজির হোসেনের তিন ছেলে। বড় ছেলে মো. ইয়াহিয়া (৭০), মেঝ ছেলে মো. ইসলাম (৫৫) ও ছোট ছেলে মো. তাসকিন (৪৫)। তিন ছেলেই তাদের পরিবার নিয়ে ২৫ আগস্ট রাতে সীমান্তে আসেন। নাফ নদী নৌকায় পার হয়ে বাংলাদেশে আসেন তারা।
২৭ আগস্ট রাতে নাজির হোসেন ফোন করেন ছেলেদের। ওই দিন রাতে তার গ্রামে আগুন দেয় সেনাবাহিনী। তখন ছেলেরা তাকে ঘর থেকে বের হয়ে যেতে বলেন। এ সময় তাদের পাশের বাড়িতে আগুন জ্বলতে থাকে। তিনি ঘর থেকে বের হয়ে বাইরে দাঁড়িয়ে থাকেন। এক নাতি (মেয়ের ছেলে) মিয়ানমারে চিংড়ির ব্যবসা করেন। তাকেও ফোন দেন। তখন ওই নাতি এসে রাত ১টার দিকে নাফ নদীর তীরে নিয়ে আসেন। চিংড়ির ঘেরের নৌকায় গভীর রাতে নাজির হোসেনকে পার করে বাংলাদেশ সীমান্তে আনা হয়। সেখান থেকে হেঁটে টেকনাফ আসেন।
২৮ আগস্ট সকালে উখিয়ায় তার ছেলেরা নিয়ে আসেন। বর্তমানে সে বালুখালী পাহাড়ের ঢালে নতুন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ছেলেরা যে ঘর তৈরি করেছেন, সেখানে আশ্রয় নিয়েছেন। উঁচু এই পাহাড় থেকে মংডু দেখা যায়। বৃহস্পতিবার বিকালেও মংডুতে ধোঁয়া উড়তে দেখা গেছে। তা দেখে কান্নায় ভেঙে পড়েন নাজির হোসেন। তিনি বলেন, ‘আমি এমন দৃশ্য আর দেখিনি। এত বর্বরতা! ভারত-পাকিস্তান স্বাধীন হতে দেখছি, বাংলাদেশ স্বাধীন হতে দেখছি। তখনও এমন দেখিনি। কারা হামলা করে চৌকিতে? তা আমরা কি জানি? আমাদের কেন মিলিটারি গুলি করে?’
বৃদ্ধ এই রোহিঙ্গা বলেন, ‘আমার মেয়ে আনোয়ারা বেগম (৫৫)। তার ছেলে জিন্নাহ এখনও মিয়ানমারে। সেখানে সে মাছের ব্যবসা করে। ভালোই ছিল তারা। কত কষ্ট করে বড় হয়েছে। সব শেষে হয়ে যাবে।’ নাজির হোসেন আবারও মিয়ানমারে যেতে চান। তিনি বাড়ি তালা মেরে রেখে এসেছেন। তার আশে-পাশের বাড়ি পোড়ালেও তার বাড়ি এখনও আছে। পোড়ালেও যেতে চান, পোড়া বাড়িটি কেমন আছে, তাও তার দেখতে ইচ্ছা।
Posted ১:৫০ পূর্বাহ্ণ | শনিবার, ০৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭
coxbangla.com | Chanchal Chy