মোসলেহ উদ্দিন/শহিদুল ইসলাম,উখিয়া(১৯ ডিসেম্বর) :: কোন প্রকার সিদ্ধান্ত ছাড়াই শেষ হয়েছে মিয়ানমারের প্রতিনিধি দলের সাথে রোহিঙ্গাদের তৃতীয় দফার সংলাপ। বৃহস্পতিবার দুপুর ২টার দিকে এ সংলাপের সমাপ্তি হয়। রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনের বিষয়ে তৃতীয়বারের মতো কথা বলতে বুধবার কক্সবাজারের এসেছেন মিয়ানমার ও আসিয়ানের উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধিদল। দুইদিনের সফরে আসা প্রতিনিধিদলটি শতাধিক রোহিঙ্গাদের সাথে আলাপ করেন।দলটি এমন সময়ে কক্সবাজার রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সংলাপ করতে এলো যখন হেগের আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে মিয়ানমার সরকারের বিরুদ্ধে রোহিঙ্গা গণহত্যা ও নির্যাতনের বিচার চলছে।
সংলাপ শেষে সাংবাদিকদের এক সংক্ষিপ্ত ব্রিফিংয়ে মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্তর্জাতিক সংস্থার মহা পরিচালক চ্যান অ্যায়ে বলেছেন, ‘আমরা দীর্ঘ দুইদিন ধরে সংলাপ করেছি। বরাবরই তারা (রোহিঙ্গা শব্দ ব্যবহার করে নেই) আমাদের বিভিন্ন দাবি দেওয়া দিয়েছেন। আমরা শুনেছি, বিষয়টি মিয়ানমারের ফেরত গিয়ে সরকারের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে ধরব এবং দ্রুত সমাধানের চেষ্টা করব’।
সংলাপে অংশ নেয়া রোহিঙ্গা কমিউনিটি নেতারা বলেছেন, সংলাপে রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফিরে যেতে প্রতিনিধিদলটি বার বার অনুরোধ করেছেন। বিদেশী পরিচয়ে প্রথমে ন্যাশনাল ভেরিফিকেশন কার্ড (এনভিসি) নিতে হবে। এরপর মিয়ানমার যাচাই-বাচাই করে নাগরিকত্ব প্রদান করা হবে। এতে আমরা বরাবরের মতো প্রত্যাখান করেছি। কারণ সেখানে গিয়ে পুনরায় নির্যাতনের শিকার হওয়ার চেয়ে বাংলাদেশে মৃত্যু বরণ করা অনেক শ্রেয় হবে।বুধবার ও বৃহস্পতিবার ২ দিন উখিয়ার কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পের এক্সটেনশন-৪ ক্যাম্পে রোহিঙ্গা কমিউনিটি নেতাদের সঙ্গে মিয়ানমার ও আসিয়ান প্রতিনিধিদলের প্রথম দিনের সংলাপ হয়। উক্ত সংলাপে অংশ নিয়েছেন ৪১জন রোহিঙ্গা কমিউনিটি নেতা ও ৬ জন কমিউনিটি নারী নেত্রী অংশ নেয়।
মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্তর্জাতিক সংস্থা ও অর্থনীতিক বিভাগের পরিচালক চ্যান অ্যায়ের নেতৃত্বে ৯ সদস্য বিশিষ্ট প্রতিনিধি দলে মিয়ানমারের পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসন, শ্রম ও অভিবাসন এবং তথ্য মন্ত্রণালয়ের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাগণ রয়েছেন। একইভাবে ৭ সদস্যেও আসিয়ান প্রতিনিধিদলে ছিলেন আসিয়ানভুক্ত রাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তাগণ।
কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন অতিরিক্ত সচিব শামশুদ্দোজা নয়ন জানিয়েছেন, বৃহস্পতিবার সকালে একই স্থানে পুনরায় সংলাপ শুরু হয়ে ২ টার দিকে শেষ হয়। মিয়ানমারের ৯ সদস্য বিশিষ্ট ও আসিয়ানের ৭সদস্যের প্রতিনিধিদলটি দুইদিনের সফর শেষে বিকালে ঢাকার উদ্দেশ্যে কক্সবাজার ত্যাগ করেছেন।
এদিন বৃহস্পতিবার তৃতীয় দফা সংলাপে রোহিঙ্গাদের রাখাইনে ফিরে যেতে মিয়ানমারের প্রতিনিধিদল বার বার অনুরোধ করলে রোহিঙ্গা নেতারা তা প্রত্যাখ্যান করে পূর্ণ নাগরিকতাসহ নানা সুযোগ-সুবিধা দিলেই তারা ফিরবেন, এর আগে নয়।
মিয়ানমারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্তর্জাতিক সংস্থা ও অর্থনীতিক বিভাগের পরিচালক চ্যান অ্যায়ের নেতৃত্বে নয় সদস্য বিশিষ্ট প্রতিনিধিদলে মিয়ানমারের পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসন, শ্রম ও অভিবাসন এবং তথ্য মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ছিলেন। একইভাবে সাত সদস্যের আসিয়ান প্রতিনিধিদলে আসিয়ানভুক্ত রাষ্ট্রের উচ্চপর্যায়ের কর্মকর্তা।
বৈঠকে অংশ নেয়া রোহিঙ্গা কমিউনিটি নেতা মুহিব উল্লাহ জানান,এটি মিয়ানমারের নাটক। আন্তর্জাতিক আদালতে চলমান মামলা ভিন্নখাতে নিতে মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলাকে কৌশল হিসেবে নিয়েছে। এতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি অন্যদিকে ফেরানো ছাড়া আমি কিছুই দেখছি না।তিনি আরও বলেন,সেই পুরনো কথা বার বার বলছেন।‘এনভিসি’ কার্ড নিয়ে আমরা কোনোভাবেই মিয়ানমারে ফিরব না। এ কথা বলার পরও দীর্ঘদিন পরে এসে সেই সেই কথা নতুন করে শুরু করছে মিয়ানমার। সংলাপে নতুনত্ব বলতে কিছুই নেই।
অপরদিকে সংলাপে অংশ নেয়া কুতুপালংয়ের হিন্দু শরনার্থী নেতা শিশু শীল,জানান, মিয়ানমার প্রতিনিধিদলের সাথে তাদের ফলপ্রসু আলোচনা হয়েছে।তাদের ফিরে নিয়ে যেতে মিয়ানমার সরকার রাজী।দ্রুত সময়ের মাধ্যমে তারা ফিরতে পারবেল বলে প্রতিনিধি দল আস্বস্ত করেছেন।তিনি আরও জানান,তাদের ফিরে নিয়ে যেতে মিয়ানমার সরকারকে কোন শর্ত দেননি।
মিয়ানমারের পক্ষ থেকে আলোচনায় অংশ নেন মিয়ানমার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ইন্টারন্যাশনাল অর্গানাইজেশন অ্যান্ড ইকোনমিক ডিপার্টমেন্টের মহাপরিচালক চ্যান আইয়ে, সামাজিক কল্যাণ ত্রাণ এবং পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিভাগের মহাপরিচালক ড. কো কো নাইং, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক বিভাগের উপমহাপরিচালক থেট উইন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম বিভাগের পুলিশ কর্নেল জ থি হ, শ্রম, অভিবাসন এবং জনসংখ্যা মন্ত্রণালয়ের পরিচালক ইন তোয়ে, রাখাইন প্রদেশের জেলা প্রশাসক সোয়ে অং, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের রাজনৈতিক বিভাগের উপপরিচালক ওয়ে উই মিন, তথ্য মন্ত্রণালয়ের সাংবাদিক নে লিন ও ল লিন অং।তাদের সাথে সংযুক্ত ছিলেন দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ান ১০ রাষ্ট্রভিত্তিক জোট আসিয়ানের সামাজিক ও মানবিক সংস্থা – ইরাতে প্রতিনিধি দলের সদস্য নাগুইন কি আন, আবদুল আলিম সিদ্দিক বিন আবদুল হাদি, আমেল কপেল কপিলি, গ্যারেক ইনদিনা, নুরা মো. ইউসুফ, মিয়াস রাসমি ও মেথাউই থে চুন উয়ান।
আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. মাহবুব আলম তালুকদার, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার আদনান তাহিয়ান, অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার মো. শামসুদ দৌজা, উখিয়া থানার ওসি মো. আবুল মনসুরসহ সরকারি বিভিন্ন কর্মকর্তারা।
কক্সবাজার শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসনের অতিরিক্ত সচিব শামসুদ্দোজা জানান, মিয়ানমারের নয় সদস্যের ও আসিয়ানের সাত সদস্যের প্রতিনিধিদল দুই দিনের সফরে প্রথম দিনে উখিয়ার কুতুপালং এক্সটেনশন-৪ ক্যাম্পে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে সংলাপ শেষ করেন। বৃহস্পতিবার সকালে একই স্থানে পুনরায় সংলাপ শুরুর হয়ে দুপুর ২টার দিকে শেষ হয়।বৃহস্পতিবার বিকেলে প্রতিনিধিদলটি ঢাকার উদ্দেশে কক্সবাজার ত্যাগ করেন।
উল্লেখ্য,২০১৭ সালের আগস্টে রাখাইনের কয়েকটি নিরাপত্তা চৌকিতে হামলার ঘটনার পর পূর্বপরিকল্পিত ও কাঠামোগত সহিংসতা জোরালো করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। হত্যা-ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধরনের সহিংসতা ও নিপীড়ন থেকে বাঁচতে নতুন করে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে সাত লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা। তাদের সঙ্গে রয়েছেন ১৯৮২ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত নানা অজুহাতে নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচার জন্যে বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নেওয়া আরও অন্তত সাড়ে তিন লাখ রোহিঙ্গা। সব মিলে বাংলাদেশে ১১ লাখের বেশি রোহিঙ্গা অবস্থান করছে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে আন্তর্জাতিক চাপের মুখে বাংলাদেশ-মিয়ানমার প্রত্যাবাসন চুক্তি সম্পন্ন হয়। একই বছরের ৬ জুন নেপিদোতে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে মিয়ানমার ও জাতিসংঘের সংস্থাগুলোর মধ্যেও সমঝোতা চুক্তি হয়।
চুক্তি অনুযায়ী, গত বছরের ১৫ নভেম্বর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের তারিখ নির্ধারণ করা হয়। তবে আবারও হামলার মুখে পড়ার আশঙ্কায় রোহিঙ্গারা নিজ দেশে ফিরতে অস্বীকৃতি জানানোয় ব্যর্থ হয় ওই উদ্যোগ। সর্বশেষ চলতি বছরের জুলাই মাসে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে নতুন করে উদ্যোগের অংশ হিসেবে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শিবির পরিদর্শন করে মিয়ানমারের পররাষ্ট্র সচিব মিন্ট থোয়ের নেতৃত্বাধীন একটি প্রতিনিধি দল। ১৫ সদস্যের দলটি দুই দিন ধরে রোহিঙ্গাদের সঙ্গে আলোচনা ও বৈঠক করে। এসব বৈঠকে রোহিঙ্গাদের তরফে ফিরে যাওয়ার ক্ষেত্রে মিয়ানমারের নাগরিকত্ব ও চলাফেরায় স্বাধীনতার দাবি পুনর্ব্যক্ত করা হয়।
এর নপরিপ্রেক্ষিতে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে দ্বিতীয় দফা ২২ আগস্ট প্রত্যাবাসনের দিন ধার্য করে ৩৪৫৫ রোহিঙ্গা নাগরিকের তালিকা পাঠায় মিয়ানমার সরকার। প্রত্যাবাসনের তালিকাভুক্তরা ছিল টেকনাফের ২৩, ২৪, ২৬ ও ২৭ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ১০৩৭টি পরিবারের। তাদের মধ্যে ২৬ নম্বর শালবাগান ক্যাম্প থেকে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক রোহিঙ্গার নাম ছিল তালিকায়। আর ১৯ থেকে ২১ আগস্ট পর্যন্ত তিনদিনে ৩১৬ রোহিঙ্গা পরিবারের মতামত নেওয়া হয়।কিন্তু ৫টি দাবী না মানা পর্যন্ত মিয়ানমারে ফেরার ব্যাপারে কোনও আগ্রহ দেখা যায়নি তাদের মধ্যে। সাক্ষাৎকারদাতারা জানান, রোহিঙ্গা স্বীকৃতি ও ভিটেমাটি ফিরে না পেলে ফেরত যাবেন না তারা।
Posted ৭:৪০ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৯ ডিসেম্বর ২০১৯
coxbangla.com | Chanchal Chy