কক্সবাংলা রিপোর্ট(৯ নভেম্বর) :: বসতির জন্য কক্সবাজারে প্রায় সাড়ে চার হাজার একর সংরক্ষিত বন ধ্বংস করেছে রোহিঙ্গারা। ৫ নভেম্বর পর্যন্ত এ পরিমাণ বন উজাড় করেছে তারা। বন বিভাগের হিসাবে, এর আর্থিক মূল্য প্রায় ৫০০ কোটি টাকা। তবে প্রাকৃতিক বনের গাছ হিসাবে নিলে ক্ষতির পরিমাণ আরো বাড়বে।
বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের চিহ্নিতকরণসংক্রান্ত সর্বশেষ বিভাগীয় সভা অনুষ্ঠিত হয় গত রোববার। চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনারের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত ওই সভায় রোহিঙ্গাদের কারণে বনের ক্ষতির একটি চিত্র তুলে ধরে বন বিভাগ।
বন বিভাগের প্রতিবেদন অনুযায়ী, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা বসতি গড়ে তুলতে ১৯ অক্টোবর পর্যন্ত বন বিভাগের উখিয়া, টেকনাফ ও হোয়াইকং রেঞ্জের ১ হাজার ৬৪৫ একর সামাজিক বনাঞ্চলের গাছ কেটে ফেলেছে। ধ্বংস করা এ বনের আর্থিক মূল্য প্রায় ১৫১ কোটি টাকা।
আর সর্বশেষ ৫ নভেম্বর পর্যন্ত হিসাবে বসতির জন্য উজাড় হয়েছে ৪ হাজার ৪০৭ একর বন। এতে আর্থিক ক্ষতি ৫০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে বলে জানান বন সংরক্ষক (চট্টগ্রাম অঞ্চল) ড. মো. জগলুল হোসেন।
তিনি বলেন, মিয়ানমার থেকে অনুপ্রবেশকারী রোহিঙ্গাদের কারণে বন ও পরিবেশের অতুলনীয় ক্ষতি হয়েছে। ১৯ অক্টোবরের হিসাব অনুযায়ী ১ হাজার ৬৪৫ একর সামাজিক বন ধ্বংস হয়েছে। তবে ৫ নভেম্বর পর্যন্ত বন ধ্বংসের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় সাড়ে চার হাজার একর। এতে আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ ৫০০ কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে।
তিনি আরো বলেন, এটা শুধু রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে উজাড় হওয়া সামাজিক বনায়ন ধ্বংসের ক্ষতি। প্রাকৃতিক বন ও পরিবেশের বিষয়টি বিবেচনায় নিলে ক্ষতির পরিমাণ কয়েক গুণ বাড়বে। বসতি স্থাপন ও জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারের জন্য সবচেয়ে বেশি বন ধ্বংস করা হচ্ছে। অবশিষ্ট বনাঞ্চল রক্ষা করতে তাই রোহিঙ্গাদের জন্য বিকল্প জ্বালানির ব্যবস্থা করতে হবে।
১৯ অক্টোবর পর্যন্ত বন বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, রোহিঙ্গারা বন বিভাগের প্রায় আড়াই হাজার একর জায়গা দখল করে বসতি গড়ে তুলেছে। এর মধ্যে উখিয়া ও টেকনাফ উপজেলার সংরক্ষিত বনাঞ্চল দখল করা হয়েছে ২ হাজার ৪১৭ একর। বাকি ৮১ একর রক্ষিত বনাঞ্চল। তবে গাছ কাটা হয়েছে শুধু সংরক্ষিত বনাঞ্চলের। বন বিভাগের তিনটি রেঞ্জে বর্তমানে ৫ লাখ ২২ হাজার রোহিঙ্গা বসবাস করছে।
রোহিঙ্গাদের বসতি স্থাপনে সবচেয়ে বেশি বন ধ্বংস হয়েছে উখিয়া রেঞ্জে। প্রায় সাড়ে চার লাখ রোহিঙ্গা এরই মধ্যে এ রেঞ্জের ২ হাজার ৩৩৬ একর সংরক্ষিত বনাঞ্চল দখল করে বাস করছে। এতে ধ্বংস হয়েছে প্রায় ১ হাজার ৬০০ একর বন। বন বিভাগের হিসাবে এর আর্থিক ক্ষতি ১৪৭ কোটি টাকা।
কুতুপালংয়ে ১ লাখ ৮৬ হাজার রোহিঙ্গার বসতির জন্য ধ্বংস করা হয়েছে এ এলাকার ৫২৫ একর বাগান। বালুখালী এলাকায় ধ্বংস করা হয়েছে ৪৫০ একর বাগান। বর্তমানে সেখানে ৭০ হাজার রোহিঙ্গা বসবাস করছে।
এছাড়া উখিয়া রেঞ্জের মক্কারবিল-হাকিমপাড়া-জামতলী-বাগমারা সংরক্ষিত বনাঞ্চলে ৮০ হাজার রোহিঙ্গা বাস করছে। এসব এলাকায় বসতি গড়তে ধ্বংস করা হয়েছে ২০৬ একর বাগান। একই রেঞ্জের তাজনিমা খোলা এলাকায় ১৬২ একর, বালুখালী ঢালা-ময়নারঘোনায় ১৫০ ও শফিউল্লা কাটা এলাকায় সাড়ে ৯২ একর বাগান ধ্বংস করা হয়েছে। এসব এলাকায় বসবাস করছে ১ লাখ ১২ হাজার রোহিঙ্গা।
বন বিভাগের হোয়াইকং রেঞ্জের পুটিবুনিয়া, কেরনতলী-চাকমারপুল এলাকায় ৪৪ হাজার রোহিঙ্গা বসবাস করছে। এ রেঞ্জের সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ৪৯ একর বাগান ধ্বংস করেছে রোহিঙ্গারা। রোববারের সভায় উজাড় হওয়া বনের রেঞ্জভিত্তিক হিসাব দেয়া না হলেও মোট পরিমাণ প্রায় সাড়ে চার হাজার একর বলে জানায় বন বিভাগ।
বন বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়া রোহিঙ্গাদের দেশী-বিদেশী বিভিন্ন সংস্থা ত্রাণসহায়তা দিচ্ছে। এর মধ্যে খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সামগ্রী থাকলেও জ্বালানি নেই। তাই সাড়ে আট লাখ বাড়তি জনসংখ্যা রান্নার জ্বালানি হিসেবে প্রতিনিয়ত গাছ কাটছে। উজাড় করা এ গাছ বন বিভাগের সামাজিক বনায়ন প্রকল্পের।
রোহিঙ্গা স্রোতের কারণে বন ধ্বংস এখনো অব্যাহত রয়েছে বলে জানান পরিবেশবাদী সংগঠন বাপার সহসভাপতি অধ্যাপক ইদ্রিচ আলী। তিনি বলেন, রোহিঙ্গারা কক্সবাজারের যে অঞ্চলে আশ্রয় নিয়েছে, তা পরিবেশের জন্য অত্যন্ত সংবেদনশীল একটি এলাকা। গত আড়াই মাসে টেকনাফ ও উখিয়ার প্রচুর পাহাড় ও বন উজাড় হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও প্রশাসনকে দ্রুত এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অন্যথায় জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের মাধ্যমে প্রতিবেশের মারাত্মক ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।
উল্লেখ্য, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সেনা অভিযানের ঘটনায় গত ২৫ আগস্ট থেকে সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে থাকে রোহিঙ্গারা।
আন্তর্জাতিক অভিবাসী সংস্থার (আইওএম) হিসাবমতে, মিয়ানমার থেকে নতুন করে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গার সংখ্যা এরই মধ্যে ছয় লাখ ছাড়িয়েছে। তবে এ সংখ্যা আট লাখের বেশি বলে দাবি স্থানীয়দের। এসব রোহিঙ্গা কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফের সাত হাজার একর জায়গায় বসতি গড়ে তুলেছে। রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ অব্যাহত থাকায় জায়গার বিস্তৃতি দিন দিন বাড়ছে।
Posted ১১:১২ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ০৯ নভেম্বর ২০১৭
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta