২০১৭ সালের ৬ মে প্রধানমন্ত্রী মেরিন ড্রাইভ সড়কের ইনানী সৈকত পরিদর্শন করে এক জনসভায় বলেছিলেন, মেরিন ড্রাইভ পর্যটনের নতুন দুয়ার খুলে দেবে।
সেই স্বপ্নের মেরিন ড্রাইভ কিছুদিনের মধ্যে পরিণত হয় আতঙ্কের ‘ক্রসফায়ারের’ নিরাপদ এলাকা হিসেবে। পুলিশ ও র্যাবের হাতে মেরিন ড্রাইভে এত ব্যাপক হারে কথিত বন্দুকযুদ্ধের ঘটনা ঘটেছে যে মেরিন ড্রাইভ এখন যেন ‘রোড টু ডেথ’-এর সমার্থক হয়ে উঠেছে। গত দুই বছরে শুধু মেরিন ড্রাইভেই অর্ধশতাধিক ‘ক্রসফায়ারের’ ঘটনা ঘটেছে।
কক্সবাজার এলাকায় এখন কেউ কাউকে হুমকি দিতেও ‘মেরিন ড্রাইভ দেখিয়ে দেওয়ার’ কথা বলে। টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ চালু করেন মেরিন ড্রাইভে ‘ক্রসফায়ারের’ ব্যাপক প্রচলন। অবশ্য এর আগে ২০১৭ সালে টেকনাফ পৌরসভার কাউন্সিলর একরামের ‘ক্রসফায়ারে’ মৃত্যুর ঘটনাটিও মেরিন ড্রাইভে ঘটেছিল।
সেনাবাহিনীর অক্লান্ত পরিশ্রমে নির্মিত মেরিন ড্রাইভে সর্বশেষ কয়েক দিন আগে পুলিশের সরাসরি গুলিতে লুটিয়ে পড়েন সেনাবাহিনীরই অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান।
শুরুর দিকে বড় বড় অপরাধী ও মাদক কারবারিরা ক্রসফায়ারে নিহত হওয়ায় সাধারণ মানুষ কিছুটা অনুমোদনের মানসিকতায় বিষয়টি দেখেছে। কয়েক বছর ধরে মানুষের মনে ভয়ের কাঁপন ধরিয়েছে ক্রসফায়ারে হত্যার ভয় দেখিয়ে চাঁদাবাজি। পুলিশের কিছু অসাধু সদস্যের টাকার চাহিদা মেটাতে না পেরে অনেকের জীবনও গেছে—এমন অভিযোগও আছে।
টেকনাফের সীমান্ত এলাকায় ইয়াবাবিরোধী সাঁড়াশি অভিযান শুরুর আগে থানার কিছু পুলিশ সদস্যের বিরুদ্ধেই ইয়াবা কারবারিদের কাছ থেকে নিয়মিত মাসোহারা আদায়ের অভিযোগ ছিল। চলছিল ‘গ্রেপ্তার বাণিজ্য।’ রাতবিরাতে ইয়াবা কারবারের অভিযোগ তুলে লোকজনকে আটক করে থানায় আনা হতো। এরপর তাদের ইয়াবার পুঁটলি দেখিয়ে চালান দেওয়ার নামে আদায় করা হতো টাকা।
পুলিশের সেই গ্রেপ্তার বাণিজ্য নিয়ে ২০১৭ সালের ৭ জুলাই ‘টেকনাফ পুলিশের গ্রেপ্তার বাণিজ্য’ শীর্ষক অসাধু পুলিশ সদস্যের ইয়াবা কানেকশন সংক্রান্ত একটি প্রতিবেদন প্রকাশের পর কর্তৃপক্ষের নির্দেশে এক সপ্তাহের মধ্যেই সাত পুলিশ সদস্যকে একযোগে অন্যত্র বদলি করা হয়েছিল।
ইয়াবা কারবারের বিরুদ্ধে বেশ কিছু ইতিবাচক অভিযান চলার পর টেকনাফে গ্রেপ্তার বাণিজ্যের স্থলে জায়গা নেয় লোমহর্ষক ‘ক্রসফায়ার বাণিজ্য’। এতে কৌশলেরও রদবদল হয়েছে। যেমন—এখন প্রকাশ্যে কোনো পুলিশ সদস্যকে মাসোহারা আদায়ের কাজে লাগানো হয় না। পথেঘাটে কোনো পুলিশ সদস্য চাঁদাবাজিতে নেই। কিন্তু ভেতরে চলছে ভয়ংকর কারবার। অভিযোগ উঠেছে, যারা ‘ক্রসফায়ারের’ শিকার হয়, মৃত্যুর আগে তাদের কাছ থেকেও বিপুল চাঁদা আদায় করা হয়।
গত ২৪ জুলাই উখিয়ার রোহিঙ্গা শিবিরকেন্দ্রিক ইয়াবা গডফাদার মৌলভি বখতিয়ার নামের একজন ইউপি সদস্যকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ নিজেই অভিযান চালিয়ে মৌলভি বখতিয়ারসহ তাহের নামের আরো একজন রোহিঙ্গাকে গ্রেপ্তার করেন ওই রাতে। এক দিন পর দুজনের ভাগ্যে জোটে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধ’। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় উল্লেখ করা হয়, মৌলভি বখতিয়ারের ঘর থেকে ১০ লাখ নগদ টাকা এবং ২০ হাজার ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে।
জানা গেছে, ঘটনার পর একটি বিশেষ সংস্থার কাছে দেওয়া জবানিতে নিহত মৌলভি বখতিয়ারের স্ত্রী জানিয়েছেন, সেই রাতে ওসি প্রদীপ কুমারের নেতৃত্বে পুলিশি অভিযানে নগদ ৫১ লাখ টাকা ও বিপুল পরিমাণ স্বর্ণালংকার নিয়ে যাওয়া হয়। পরে মৌলভি বখতিয়ারের এক ছেলেকে ডেকে নিয়ে হাতিয়ে নেওয়া হয় আরো বিপুল অঙ্কের টাকা।
অভিযোগে বলা হয়েছে, টেকনাফের হোয়াইক্যং ৫ নম্বর ওয়ার্ডের আওয়ামী লীগ সহসভাপতি মুফিদ আলমকে ক্রসফায়ারের নামে ধরে নিয়ে পাঁচ লাখ টাকা আদায় করা হয়। একই ইউনিয়নের ৯ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাকের আলমকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে ক্রসফায়ারের ভয় দেখিয়ে সাড়ে তিন লাখ টাকা নিয়ে কারাগারে পাঠানো হয় ২০০টি ইয়াবা দিয়ে।
সেন্ট মার্টিন দ্বীপের পূর্ব পাড়ার বাসিন্দা মোহাম্মদ আজিম ও মোহাম্মদ জুবায়েরকে দ্বীপের পুলিশ ঈদুল আজহার তিন দিন আগে আটক করে ইয়াবা কারবারের অভিযোগে। তাঁদের দ্বীপ থেকে চালান করা হয় টেকনাফ থানায়। অভিযোগ উঠেছে, তাঁদের ক্রসফায়ারে দেওয়ার ভয় দেখিয়ে বিপুল অঙ্কের টাকা দাবি করা হয়। আটক হওয়া আজিমকে লেনদেনের মাধ্যমে ক্রসফায়ার থেকে রেহাই দিয়ে চার হাজার ইয়াবা দিয়ে চালান দেওয়া হয় আদালতে। আর জুবায়েরকে অজ্ঞাত স্থানে আটকে রাখা হয় চাহিদামাফিক টাকার জন্য।
পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, শুধু টেকনাফেই গত ২২ মাসে ওসি প্রদীপ কুমার দাশের হাতে ১৪৪টি ‘বন্দুকযুদ্ধের’ ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় মারা গেছে ২০৪ ব্যক্তি। তাদর অর্ধেকের লাশ পড়ে মেরিন ড্রাইভে।
২০১৭ সালের অক্টোবরে টেকনাফে ব্যবসায়ীদের করা অভিযোগের ভিত্তিতে সেনাবাহিনী ১৭ লাখ টাকাসহ গোয়েন্দা পুলিশের বেশ কয়েকজন সদস্যকে আটক করার পর তা নিয়ে তোলপাড় হয়। এর আগে ২০১৭ সালের জুনে টেকনাফের একটি গ্রামের আওয়ামী লীগের এক তৃণমূল কর্মী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পুলিশের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। ওই অভিযোগের তদন্তের পর টেকনাফ থেকে আট পুলিশ সদস্যকে বদলি করা হয়েছিল।
মাদকবিরোধী অভিযানে ২০১৮ সালের মে মাস থেকে কক্সবাজারের টেকনাফে পুলিশের কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ‘ক্রসফায়ারে’ ১৬১ জন নিহত হয়েছে। এর বেশির ভাগ ঘটনাই ঘটে মেরিন ড্রাইভ এলাকায়। টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের পরিদর্শক লিয়াকত আলীর নেতৃত্বে এলাকাটি ‘ক্রসফায়ার জোন’ হয়ে উঠলেও থামেনি ইয়াবার কারবার। ওসি প্রকাশ্যে মাদক কারবারিদের নির্মূল করার ঘোষণা দিলেও তাঁর এই মিশনে শীর্ষ কারবারি হাজি সাইফুল ছাড়া উল্লেখযোগ্য কেউ নিহত হয়নি।
নিহতদের বেশির ভাগই ইয়াবার খুচরা বিক্রেতা। স্থানীয় ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, আত্মসমর্পণের নামে শীর্ষ কারবারিদের রেহাইয়ের সুযোগ দিয়ে এবং চুনোপুঁটিদের দমন করে চলছে ‘ক্রসফায়ার বাণিজ্য’।
গত ৩১ জুলাই মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদের মৃত্যুর পর ওসি প্রদীপ ও পরিদর্শক লিয়াকতের ‘ভিন্ন রকম ত্রাসের’ অভিযোগ মিলছে। সূত্রগুলো জানায়, বিশেষ অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে টেকনাফে এসে ‘আস্থাভাজন ওসি’ বলে নিজেকে পরিচয় দিয়ে প্রভাব বিস্তার করেন প্রদীপ।
গোপালগঞ্জে বাড়ি এবং ছাত্রলীগ করতেন বলে পরিচয় দেন লিয়াকত। এসব কারণে সাধারণ মানুষ তো দূরের কথা, পুলিশও তাঁদের বিরুদ্ধে কথা বলে না। বিচার-বিশ্লেষণ ছাড়া অনেক ব্যক্তিকে ‘ক্রসফায়ার’ দিয়ে বড় ইয়াবা কারবারি বলে প্রচারের অভিযোগ উঠেছে তাঁদের বিরুদ্ধে। কিছু পরিবার টাকা আদায়েরও অভিযোগ করছে।
ওসি প্রদীপ কুমারের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভেসে বেড়াচ্ছে। এই ভিডিওতে তিনি বলেছেন, টেকনাফের প্রতিটি পাড়া-মহল্লার ইয়াবা কারবারিদের গ্রেপ্তার করা হবে। যাদের পাওয়া যাবে না তাদের ঘরবাড়ি, দোকানপাট, যানবাহন সমূলে উৎপাটন করা হবে। তাদের বাড়িতে গায়েবি হামলা হবে। কোনো কোনো বাড়ি ও গাড়িতে গায়েবি অগ্নিসংযোগও হতে পারে। ওসির এই ভীতিকর ভিডিও বার্তা নিয়ে কক্সবাজারে ব্যাপক আলোচনা চলে।
পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে এক জনপ্রতিনিধি বলেন, গত দেড় বছরে টেকনাফে ১৫০টি বাড়িঘরে হামলার ঘটনা ঘটেছে। সরকারের ইয়াবা নির্মূলের জন্য বিশেষ অভিযান চালানোর সুযোগ নিয়ে ওসি প্রদীপ ও পরিদর্শক লিয়াকত বাহারছড়া, মেরিন ড্রাইভসহ কিছু এলাকাকে কিলিং জোন বানিয়েছেন। গরিব ‘বহনকারীদের মেরে’ তাঁরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের বাহবা কুড়িয়েছেন।
আর শীর্ষ কারবারিদের সঙ্গে আঁতাত করেছেন। তাঁদের সমঝোতায় অনেকে আত্মসমর্পণ করেছে। অনেকে আত্মসমর্পণ না করেও তাঁদের ‘ম্যানেজ করে’ এলাকায় ফিরেছে। যারা ম্যানেজ করছে না তাদের বাড়িতেই হামলা হচ্ছে বলেও অভিযোগ দেন ওই জনপ্রতিনিধি।
পুলিশ ও মানবাধিকার সংস্থার তথ্য মতে, ২০১৮ সালের মে মাস থেকে গত ৩০ জুলাই পর্যন্ত শুধু কক্সবাজারে পুলিশ, বিজিবি ও র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে ২৮৭ জন নিহত হয়। এ সময় পুলিশের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয় ১৭৪ জন, বিজিবির সঙ্গে ৬২ জন এবং র্যাবের সঙ্গে ৫১ জন। শুধু টেকনাফেই পুলিশের গুলিতে নিহত হয়েছে ১৬১ জন। কিন্তু ইয়াবা চোরাচালান থেমে নেই।
২০১৮ সালেই টেকনাফে বন্দুকযুদ্ধে নিহতদের মধ্যে ১০ জনের পরিবার কাছে দাবি করে, নিহতরা কারবারে জড়িতই ছিল না। তাদের সাতজনের নাম কারবারিদের তালিকায় নেই। ছিল না মামলাও। তবে স্থানীয় লোকজনের সন্দেহ, ওই নিহতরা খুচরা বিক্রেতা। ২০১৮ সালের ২৮ অক্টোবর অভিযানে নিহত হন নাজিরপাড়ার কামাল হোসেন। কামালের মা নূরুন্নাহার বিলাপ করে বলেন, ‘গরুর ব্যবসা করে কোনোমতে সংসার চালাত কামাল। তার নিজের ঘরও নেই। অভিযানের সময় কৌতূহলে এগিয়ে গেলে পুলিশ কামালকে আটক করে। পরে বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার খবর পাই।’ তাঁর মায়ের দাবি, পুলিশের এক সদস্য ১০ লাখ টাকা চেয়েছিলেন। দিতে পারেননি তাঁরা।
সাবরাংয়ের সিকদারপাড়ার সুলতান আহমেদের ছেলে সাদ্দাম হোসেন নিহত হন ওই বছরের ২৭ অক্টোবর। সাদ্দামের মা জোহরা বেগম ও ভাই শামসুল আলম বলেন, তাঁদের এলাকায় কালামের ছেলে সাদ্দাম ইয়াবা কারবার করেন। নিহত সাদ্দাম মাছের ব্যবসা করতেন। স্থানীয় দফাদারের সঙ্গে বিরোধের কারণে ভুল তথ্য দিয়ে তাঁদের সাদ্দামকে ‘হত্যা’ করা হয়েছে।
স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, টেকনাফ থানার পুলিশ এখন মাঠ পর্যায়ে কারবারিদের কাছ থেকে টাকা তোলার দায়িত্ব দিয়েছে ইউনিয়ন পরিষদের চৌকিদার-দফাদারদের। প্রতি লাখে ২০ হাজার টাকা আদায়কারী চৌকিদার (গ্রাম পুলিশ) পেয়ে থাকেন। চৌকিদার-দফাদাররা ইয়াবা কারবারিদের কাছ থেকে মাসিক চুক্তির কমিশন বাবদ আয় দিয়ে সবাই এখন বড়লোক বনে গেছেন।
সূত্র মতে, থানায় বসে সব দিক সামলান ওসি। আর ক্রসফায়ারসহ প্রভাব বিস্তারের কাজটি করেন পরিদর্শক লিয়াকত।
ডাকাত গ্রেপ্তারে পাহাড়ে অভিযান, ইয়াবা ধরাসহ কিছু ভালো কাজ করে লিয়াকতও ওসি প্রদীপের মতো ‘আস্থাভাজন’ তকমা লাগিয়েছেন। ফলে তাঁর অভিযান নিয়েও কেউ প্রশ্ন তোলে না। সাবেক সেনা কর্মকর্তা সিনহা মো. রাশেদ নিহতের পর তাঁকেসহ বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রের সব সদস্যকে প্রত্যাহার করা হয়েছে। এবার তাঁদের ‘ক্রসফায়ার’ বাণিজ্যের তথ্য বের হবে বলে মনে করছে স্থানীয় লোকজন।
অভিযোগের ব্যাপারে টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ বলেন, ‘এসব ডাহা মিথ্যা। আমি টেকনাফে আসার পর ইয়াবা কারবারিদের সাইজ করেছি। এসব কারণে তারা আমার ওপর ক্ষীপ্ত। তাই তারা বানোয়াট অভিযোগ তুলে আমাকে সরাতে চায়।’ তিনি বলেন, ‘কক্সবাজারের সাংবাদিকরাও জানেন আমি কোনো অন্যায় করিনি। আমি দুর্নীতির আশ্রয় নিইনি।’
Posted ২:৩৪ পূর্বাহ্ণ | বুধবার, ০৫ আগস্ট ২০২০
coxbangla.com | Chanchal Chy