কক্সবাংলা রিপোর্ট(২ নভেম্বর) :: আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কড়াকড়ির কারণে দেশের বিভিন্ন স্থানে ইয়াবা পাচারের নিরাপদ মাধ্যম হিসেবে পরিবহন খাতকে বেছে নিয়েছে মাদক ব্যবসায়ীরা। গোড়াতে ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান, মাইক্রোবাস, পিকআপে ইয়াবা পরিবহন হলেও সাম্প্রতিক সময়ে এ অপতত্পরতায় বেড়েছে যাত্রীবাহী বাসের ব্যবহার। অর্থের লোভে একশ্রেণীর গাড়িচালক ও সহকারী বহন করছে ইয়াবা। আর এ অসাধু তত্পরতা ধরা পড়ায় আলামত হিসেবে জব্দ হচ্ছে যানবাহন। আটকা পড়ছে সংশ্লিষ্ট পরিবহন ব্যবসায়ীর মোটা অংকের বিনিয়োগ।
সর্বশেষ গত শনিবার রাজধানীর মালিবাগে নবাবী খানাপিনা রেস্তোরাঁর সামনে থেকে আনিসুল হক দুলাল নামে সোহাগ পরিবহনের এক চালককে গ্রেফতার করে র্যাব। তার হেফাজত থেকে উদ্ধার হয় ২০ হাজার পিস ইয়াবা। গ্রেফতারকৃত দুলাল ঢাকা-কক্সবাজার রুটে সোহাগ পরিবহনের স্ক্যানিয়া বাস চালান।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের বরাতে র্যাব-২ এর সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ সাইফুল মালিক জানান, ৮০ হাজার টাকা চুক্তিতে দুলাল এ চালানটি কক্সবাজার থেকে ঢাকায় এনেছেন। আরেকজনের কাছে চালান বুঝিয়ে দিলে তার টাকা পাওয়ার কথা ছিল। তার আগে দুলালকে গ্রেফতার করে র্যাব।
ইয়াবা পাচারে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ শুধু সোহাগ পরিবহনের চালক ও সহকারীর বিরুদ্ধে নয়। একই অভিযোগে গ্রেফতার হয়েছেন হানিফ পরিবহন, শ্যামলী পরিবহন, সৌদিয়া, তুবা লাইন, দেশ ট্রাভেলস ও গ্রীনলাইনের চালক-সহকারীরাও। এসব ঘটনায় জব্দ হয়েছে অন্তত দেড় ডজন বিলাসবহুল বাস।
এর আগে গত মঙ্গলবার (১৬ অক্টোবর) যাত্রাবাড়ীর গোলাপবাগ থেকে ৩০ হাজার পিস ইয়াবা ট্যাবলেটসহ কক্সবাজার থেকে আসা লন্ডন এক্সপ্রেস বাসের চালক আবদুল হামিদ ও তার সহযোগী রেজওয়ানকে গ্রেফতার করে র্যাব-১০।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আবদুল হামিদ জানান, কক্সবাজার থেকে আসা প্রতিটি বাসেই কম-বেশি মাদকের চালান ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পাচার হয়ে থাকে।
পরিবহন মালিকরা বলছেন, বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ব্যাংক ও অর্থায়নকারী প্রতিষ্ঠানের ঋণের টাকায় ব্যয়বহুল বাসগুলো কেনা হয়। ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানের পাওনা কিস্তি পরিশোধ করা হয় গাড়িগুলোর আয় থেকে। এ অবস্থায় চালক ও সহকারীদের অসততার জেরে গাড়ি জব্দ হলে প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ আটকা পড়ে। থেমে যায় আয়ের চাকাও।
র্যাব সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, চলতি বছরের প্রথম আট মাসে পাচারের সময় ছোট, মাঝারি ও ভারী যানবহন থেকে ১১ লাখ ৪২ হাজার ৪০৫ পিস ইয়াবা উদ্ধার হয়েছে। জব্দ করা হয়েছে ৪৪টি যানবাহন।
এর মধ্যে শ্যামলীর তিনটি, হানিফের একটি, সৌদিয়া পরিবহনের একটি ও তুবা লাইনের একটি বিলাসবহুল শীততাপ নিয়ন্ত্রিত গাড়ি রয়েছে। ইয়াবা বহনের দায়ে গ্রেফতার হয়েছে ৩৫ মোটর শ্রমিক। যাত্রীবাহী বাস ছাড়াও ইয়াবা বহনের দায়ে জব্দ করা হয়েছে ১৭টি ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান। এর বাইরে বিলাসবহুল পাজেরো জিপ, মাইক্রোবাস, কারসহ বেশকিছু যানবাহন ইয়াবা বহনের সময় ধরা পড়েছে।
জুলাইয়ের প্রথম সপ্তাহ থেকে দেশব্যাপী মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযান শুরু করে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। যানবাহন থেকে ইয়াবা জব্দে র্যাবের পরিসংখ্যান পর্যালোচনা করে দেখা যায়, অভিযান শুরুর আগের ছয় মাসে ছোট, মাঝারি ও বড় পরিবহন থেকে ৭ লাখ ২ হাজার ৩৯৫ পিস ইয়াবা উদ্ধার করা হয়। আর অভিযান চলাকালে প্রথম ৪০ দিনেই বিভিন্ন আকারের যানবাহন থেকে উদ্ধার হয়েছে ৪ লাখ ৪০ হাজার ১০ পিস ইয়াবা। এর বেশির ভাগই উদ্ধার হয়েছে শ্যামলী, সৌদিয়া, তুবা লাইন ও হানিফ পরিবহনের মতো অভিজাত গাড়ি থেকে।
সম্প্রতি রাজধানীতে মাদকবিরোধী এক অনুষ্ঠানে র্যাবের মহাপরিচালক (ডিজি) বেনজীর আহমেদ দাবি করেন, পরিবহনে মাদক বহনের জন্য দায় এড়াতে পারেন না মালিক বা শ্রমিকরা। তাদের যোগসাজশ ছাড়া কখনই গাড়ির ইঞ্জিন বা সাইলেন্সারের মতো স্থানে মাদক বহন সম্ভব নয়। এজন্য পরিবহন খাতে বিশেষ নজর রাখার পাশাপাশি মালিক ও শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনা করা হবে বলেও জানান তিনি।
সূত্র জানায়, গত বুধবার ফেনী শহরের পশ্চিম রামপুরে ঢাকাগামী সৌদিয়া পরিবহনের (রেজি: নং- চট্ট মেট্টো- ব- ১১-১০৫৯) একটি বিলাসবহুল বাস থেকে ৩৯ হাজার পিস ইয়াবা উদ্ধার করেছে র্যাব-৭। এর আগের রাতে রাজধানীর বসিলায় ইয়াবা বহনের সময় একটি কাভার্ড ভ্যান জব্দ করে র্যাব।
কক্সবাজার থেকে লবণ বোঝাই করে আসা ওই কাভার্ড ভ্যানের পেছনের দুই চাকায় পাওয়া যায় ২ লাখ ১০ হাজার পিস ইয়াবা। এ ঘটনায় গ্রেফতার হয় কাভার্ড ভ্যানের চালক মানিক মিয়া ও হেলপার মো. আরিফ।
জিজ্ঞাসাবাদে তারা জানান, আগে যেখানে ১০ হাজার ইয়াবা বহন করতে দেয়া হতো ১০ হাজার টাকা, এখন সেখানে দেয়া হচ্ছে ৫০ হাজার টাকা। এ চক্রটি গত এক মাসে ইয়াবার ১২টি চালান রাজধানীতে এনেছে। চালানগুলোর প্রত্যেকটিতেই দুই থেকে পাঁচ লাখ পিস ইয়াবা ছিল বলেও জিজ্ঞাসাদে স্বীকার করেছেন দুই মোটর শ্রমিক।
এ বিষয়ে র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার মুফতি মাহমুদ খান বলেন, চলমান অভিযানের ফলে মাদক ব্যবসায়ীরা অসাধু কিছু পরিবহন চালক ও সহকারীর সঙ্গে আঁতাত করে গাড়ির চাকায় ও ইঞ্জিনের ভেতরে ইয়াবা বহন করছেন। এজন্য তারা মোটা অংকের কমিশনও পাচ্ছেন। কিন্তু আমাদের কাছে ধরা পড়ার ফলে চালকের পাশাপাশি পরিবহন মালিকরাও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। কারণ কয়েক কোটি টাকা দামের এসব গাড়ি জব্দ হয়ে থাকায় তারা বাণিজ্যিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। পরিবহনে ইয়াবা বহন বন্ধ করতে দ্রুততম সময়ের মধ্যেই পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের সঙ্গে আলোচনা করা হবে বলে জানান র্যাবের এ কর্মকর্তা।
বাংলাদেশ বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি ও সোহাগ পরিবহনের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফারুখ তালুকদার বলেন, একটা গাড়ি ট্রিপে গেলে তার সঙ্গে তো মালিকের থাকা সম্ভব হয় না। গাড়িটা চালক ও সুপারভাইজারের দায়িত্বে ছেড়ে দেয়া হয়। এখন তারা যদি ইয়াবার চালান বহন করেন, সেক্ষেত্রে মালিকের কিছু করার থাকে না। গাড়িগুলো দীর্ঘদিন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজতে থাকায় লোকসানের মাত্রাও বাড়তে থাকে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সহযোগিতা পেলেই কেবল পরিবহনে মাদক পাচার বন্ধ করা সম্ভব বলে তিনি জানান।
বাস-ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি বলেন, আমরা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে বলেছি যাত্রা শুরুর মুহূর্তে আপনারা একবার পুরো গাড়ি তল্লাশি করার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। যখনই আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী গাড়িগুলো নিয়মিত তল্লাশি করবে, তখন আর চালক বা তার সহযোগীরা মাদক বহনে সাহস পাবে না।
Posted ৩:১৫ পূর্বাহ্ণ | শনিবার, ০৩ নভেম্বর ২০১৮
coxbangla.com | Chanchal Chy