কক্সবাংলা রিপোর্ট(১৯ অক্টোবর) :: মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের বোঝা আর বইতে পারছে না সীমান্তবর্তী কক্সবাজার জেলা।রাখাইন রাজ্যে বর্তমানে কোন সহিংসতা না থাকলেও প্রতিদিন হাজার হাজার রোহিঙ্গার ঢল অব্যাহত থাকায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে কক্সবাজারের সীমান্ত এলাকার মানুষ। সীমান্তঞ্চলে রোহিঙ্গাদের কারণে ইতিমধ্যে জনজীবনে ব্যয়ভার বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি সামাজিক অস্তিরতা দেখা দিয়েছে।এরমধ্যে অধিক হারে এইডস রোগী প্রবেশ করায় আতংকে রয়েছে জেলার মানুষ।
এত বিপুল বিপন্ন মানুষ যেখানেই থাকবে, সেখানেই বড় ধরনের পরিবেশ বিপর্যয় হবে। সামাজিকভাবে কিছু সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে, যেমন স্থানীয় শ্রমিকদের মজুরি কমে যাচ্ছে, যেহেতু চাহিদার তুলনায় শ্রমিকের সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে, সেখানে একটি অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি হতে পারে। আর সীমান্ত এলাকায় রোহিঙ্গাদের প্রবেশের ধারা অব্যাহত থাকলে কক্সবাজারে বড়ধরনের মানবিক বিপর্যয় নেমে আশার আশংকা করছেন সংশ্লিষ্ঠরা।
স্থানীয়রা জানিয়েছে,বাড়তি খাদ্যের চাপে স্থানীয় বাজারগুলোতে দ্বিগুণ হারে বেড়েছে নিত্যপণ্যের দাম। বেড়েছে পরিবহন ভাড়াও। আর উখিয়া ও টেকনাফে বাড়তি মানুষের চাপের কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বেড়ে দ্বিগুণ হয়েছে। কুতুপালংয়ের স্থানীয়রা জানিয়েছে উখিয়া ও টেকনাফে স্থানীয় বাসিন্দা প্রায় ৪ লাখ। পুরনো ও নতুন রোহিঙ্গা মিলে ১০ লাখের ওপরে। সব মিলিয়ে সেখানে এখন প্রায় ১৪ লাখ জনসংখ্যা দাঁড়িয়েছে। ফলে অতিরিক্ত খাদ্য চাহিদার কারণে বেড়েছে পণ্যের দামও। সেখানে প্রতি কেজি কাঁচা মরিচ ও টমেটো ১৫০ টাকা, ছড়া, ঢেঁড়স, ৭০ টাকা, বেগুন, মুলা, করলা ৬০ টাকা কেজি, বরবটি ৪৫ টাকা, ঝিঙ্গা ৪৫ টাকা, পেঁয়াজ ৪০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। ক্রেতাদের মতে, সবজির দাম ২০ টাকা কেজিতে বিক্রি হয়েছে। এক মাসের ব্যবধানে নিত্যপণ্যের দাম দ্বিগুণ হয়েছে।তবে সেনাবাহিনী এ অঞ্চলে কাজ শুরুর পর ব্যবসায়ীরা দাম কিছুটা কমিয়েছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, কক্সবাজারে সাড়ে ৪ হাজার একর পাহাড়ি জমিতে রোহিঙ্গারা বসতি স্থাপন করেছে। যার মধ্যে সামাজিক ও প্রাকৃতিক বনভূমি রয়েছে। এসব জমির মধ্যে উখিয়া রেঞ্জেই আছে তিন হাজার একর। বাকি জমি রয়েছে টেকনাফ, পুটিবুনিয়া ও শিলখালী রেঞ্জে।
কক্সবাজারের বন বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, কুতুপালং রেজিস্টার্ড ক্যাম্পসহ পুরনো রোহিঙ্গারা আগের থেকেই দখলে নিয়েছে প্রায় ৬ হাজার একর। আর সম্প্রতি আসা নতুন রোহিঙ্গারা নিজেদের দখলে নিয়েছে সাড়ে ৪ হাজার একর। মোট সাড়ে ১০ হাজার একর বনভূমি এখন রোহিঙ্গাদের দখলে। নতুন রোহিঙ্গারা এ পর্যন্ত ৪৫০০ একর বনভূমিতে বসতি গড়ে তুলেছে। প্রতিদিন জ্বালানি সংকট মেটাতে গাছ পুড়ছে ৫০০ টন।
কক্সবাজারের দক্ষিণ বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা মো. আলী কবির বলেন, প্রতিদিন ৫ লাখ কেজি বা ৫০০ টন বনের গাছ জ্বালানি পুড়ছে।গত ৪৫ দিনে বনজসম্পদের ক্ষতি হয়েছে ১৫০ কোটি টাকা।
বিশেষজ্ঞদের মতে,টেকনাফ ও কক্সবাজার হচ্ছে পর্যটন অঞ্চল। নভেম্বর থেকে মার্চ পর্যন্ত দেশি ও বিদেশি হাজার হাজার পর্যটক এ অঞ্চলে ভিড় জমান। এ খাতের আয়ের বড় একটি অংশ এ অঞ্চল থেকে আসছে। কিন্তু রোহিঙ্গাদের কারণে পর্যটন শিল্পে প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ইতিমধ্যে টেকনাফ ও সেন্ট মার্টিন দ্বীপে ছড়িয়ে পড়েছে। এর ফলে পর্যটন খাতে এর বিরূপ প্রভাব পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
তাদের মতে, অতিরিক্ত রোহিঙ্গার কারণে নিরাপত্তা সংকট তৈরি হলে ওই জোনে (চট্টগ্রাম, কক্সবাজার) বিদেশি বিনিয়োগ হ্রাস পাওয়ার আশঙ্কা থাকবে। পাশাপাশি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে বাণিজ্য বাড়ানোর একমাত্র পথ মিয়ানমার। রোহিঙ্গা ইস্যুত দু’দেশের সম্পর্কে অবনতির জেরে এ সম্ভাবনাও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।
এ প্রসঙ্গে কক্সবাজার বাচাঁও আন্দোলনের সভাপতি এডভোকেট আয়াছুর রহমান বলেন, বলেছেন, ‘অল্প সময়ের মধ্যে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন সম্ভব না হলে কক্সবাজারের মতো গুরুত্বপূর্ণ এলাকায় তাদের রাখা ঠিক হবে না। এতে কক্সবাজার সৌন্দর্যহীন ও পর্যটকশূন্য হয়ে পড়ার আশঙ্কা আছে। তিনি বলেন, কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে রোহিঙ্গাদের কারণে স্থানীয় বাসিন্দাদের যে কী ক্ষতি হচ্ছে এটি আমরা এখন আন্দাজ করতে না পারলেও দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতির ঝুঁকি এবং অপরাধ দুটোই বাড়াবে। কক্সবাজার ও সীমান্ত অঞ্চলে পর্যটন খাত ঝুঁকিতে পড়বে। স্বাস্থ্যসেবার ওপরও চাপ বাড়বে। যে পরিবেশে তারা থাকবেন, সেখানে পর্যাপ্ত পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা ও অবকাঠামো সুবিধা না থাকায় স্বাস্থ্যসেবায় ঝুঁকি বাড়বে।
এদিকে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে বলপ্রয়োগে বাস্তুচ্যুত মায়ানমার নাগরিকদের বাংলাদেশী পরিচয়ে জন্ম নিবন্ধন প্রতিরোধ বিষয়ক এক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় বাস্তুচ্যুত মায়ানমার নাগরিকরা বাংলাদেশী পরিচয়ে কেহ যাতে জন্ম নিবন্ধন করতে না পারে সে দিকে সনতর্ক থাকতে হবে। এ ব্যাপারে জনপ্রতিনিধিদের শতভাগ সততা ও নিষ্ঠার সাথে পালন করতে হবে এবং এর জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে। কিছু স্বার্থান্বেষী মহল জনপ্রতিনিধিদের প্রভাবিত করতে না পারে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৫ আগস্ট থেকে সাত সপ্তাহে প্রায় পাঁচ লাখ ৮২ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকেছে।
সরকারের তথ্য অনুযায়ী, ২৫ আগস্টের আগে থেকে বিভিন্ন সময় মিয়ানমার থেকে অনুপ্রবেশ করে এ দেশে অবস্থান করা রোহিঙ্গার সংখ্যা ছিল চার লাখ। সে হিসাবে এরই মধ্যে রোহিঙ্গার সংখ্যা ১০ লাখ অতিক্রম করেছে। এর ফলে সৃষ্টি হয়েছে ভয়াবহ মানবিক সংকট।
জানা গেছে, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা এখন ১৫ লাখেরও অধিক। এর মধ্যে প্রায় ৫ লাখ রোহিঙ্গা ১৯৭৮,১৯৯২,২০১২ এবং ২০১৫ সালে থেকে কয়েক ধাপে কক্সবাজারের উখিয়া, টেকনাফ ও নাইক্ষ্যংছড়িতে আশ্রয় নেয়। এরপর কিন্তু ২৪ আগস্ট থেকে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ‘রোহিঙ্গা নিধন’ অভিযান শুরু করলে ২৫ আগস্ট থেকে স্রোতের মতো বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে থাকে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা।
Posted ৮:২৬ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৯ অক্টোবর ২০১৭
coxbangla.com | Chanchal Chy