বিশেষ প্রতিবেদক :: কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত–সংলগ্ন হোটেল সি গালের সামনের ফুটপাতে খুলনা সিটি করপোরেশনের অপসারিত কাউন্সিলর গোলাম রব্বানী টিপুর (৫৪) খুন হওয়ার পেছনে উঠে আসছে চাঞ্চল্যকর তথ্য।
টিপুর বড় ভাই গোলাম রসুল বলেছেন, ‘কাউন্সিলর ইফতেখার ওরফে চালুসহ কয়েকজন টোপ দিয়ে পরিকল্পিতভাবে টিপুকে কক্সবাজার নিয়ে যায়। শুটার ভাড়া করে সেখানে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে তারা। সে কখন হোটেলে উঠলো, কখন ফাঁকা জায়গায় গেল এগুলো ভেতর থেকে না বললে কীভাবে জানবে খুনি।’
কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতে গোলাম রব্বানী টিপুকে গুলি করে হত্যার ঘটনার পর শুক্রবার (১০ জানুয়ারি) এসব কথা বলেন তিনি।
৮ জানুয়ারি ১৬নং ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ইফতেখার ওরফে চালুসহ কয়েকজন রব্বানীকে টোপ দিয়ে কক্সবাজারে নিয়ে যায়। ব্যবসা বা অন্য কোনো কথা বলে হয়তো নিয়ে যায়। ওখানে আগে থেকেই শুটার সেট করা ছিল।’
তিনি আরও বলেন, বেশ কিছুদিন ধরে রব্বানীকে হত্যার চেষ্টা চলছে। বাড়িতে বোমা হামলা হয়েছে। যেভাবেই হোক, তারা সফল হয়েছে। তবে আমি কারও নাম বলব না। যেটাই হোক, এটা আমাদের এলাকাভিত্তিক দ্বন্দ্ব। তাকে পূর্বপরিকল্পিতভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। কক্সবাজারে তার (টিপু) শত্রু ছিল না। খুলনা, দৌলতপুর, পাবলা, দেয়ানা এখান থেকেই এটার সূত্রপাত। অন্য বিষয়ের চেয়ে এটার পেছনে এলাকার দ্বন্দ্ব, এলাকার রাজনৈতিক প্রতিহিংসা কাজ করেছে।
তবে টিপুর স্ত্রী সাবিহা আক্তার বলেন, গোলাম রব্বানী টিপুর (৫৪) খুন হওয়ার পেছনে সাবেক চরমপন্থী নেতাকে দায়ী করেছেন ।
টিপুর স্ত্রী অভিযোগ, চরমপন্থী নেতা গাজী কামরুল ফোনে টিপুকে নিয়মিত হুমকি দিতেন এবং তাঁর জনপ্রিয়তা সহ্য করতে পারতেন না।
গত মঙ্গলবার সাবেক কাউন্সিলর গোলাম রব্বানী টিপু, ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক আরেক কাউন্সিলর শেখ হাসান ইফতেখারের সঙ্গে কক্সবাজারে যান।
গত বুধবার সকালে তাঁরা কক্সবাজারে পৌঁছে একটি হোটেলে ছিলেন। সেদিনই স্ত্রীর সঙ্গে শেষ কথা হয়।
গতকাল বৃহস্পতিবার (৯ জানুয়ারি) রাত ৮টা ২০ মিনিটের দিকে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত–সংলগ্ন হোটেল সি গালের সামনের ফুটপাতে দুর্বৃত্তের গুলিতে নিহত হন গোলাম রব্বানী টিপু।
অভিযুক্ত গাজী কামরুল দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের নিষিদ্ধঘোষিত চরমপন্থী দল বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির কামরুল বাহিনীর প্রধান।
টিপুর পরিবার সূত্র জানায়, কক্সবাজারে অনেক আগে থেকেই টিপুর মাছের ব্যবসা ছিল। এর আগে লবণের ব্যবসাও ছিল টিপুর।
এ ব্যবসার কারণে টিপুর কক্সবাজারে নিয়মিত যাতায়াত ছিল। তবে বর্তমানে তিনি জমিজমার ব্যবসা করতেন।
স্থানীয়রা জানান, টিপু সব সময় অস্ত্রসহ দলবল নিয়ে চলাফেরা করতেন। আধিপত্য বিস্তার ও জমিজমা–সংক্রান্ত বিরোধসহ বিভিন্ন কারণে তাঁর অনেক শত্রু ছিল।
এ ছাড়া তিনি জমির ব্যবসার আড়ালে এলাকায় ইয়াবার কারবার করতেন। এ ছাড়া একসময় তিনি গাজী কামরুল দলের সক্রিয় সদস্য ছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি সেখান থেকে বের হয়ে আলাদা বাহিনী গড়ে তোলেন।
শুক্রবার সকাল সাড়ে ১০টার দিকে খুলনা মহানগরীর দেয়ানার হোসেন শাহ রোডের ২১২ নম্বর রোডের সাবেক কাউন্সিলরের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, বহু মানুষের জটলা। সেই জটলার মধ্যে টিপুর ছেলে তাসিন রব্বানি রাহাতকে (১৩) পাশে নিয়ে বসে আছেন টিপুর বৃদ্ধ বাবা গোলাম আকবর।
ছেলের শোকে তিনি তখন কাতর। যেন কান্নাও ভুলে গেছেন। খুলনা সরকারি ল্যাবরেটরি স্কুলের সপ্তম শ্রেণির ছাত্র রাহাতও বাকরুদ্ধ। তারা যেন কথা হারিয়ে ফেলেছেন।
এ সময় আর্তনাদ করতে করতে স্ত্রী সাবিহা আক্তার বলেন, গুলিতে হত্যাকাণ্ডের শিকারের আগের দিন স্বামীর সঙ্গে কথা হয়েছিল। সে সময় দুই সন্তানের খোঁজ নিয়েছিলেন।
সাবিহা আক্তার বলেন, ‘গত বুধবার মাগরিবের নামাজের পর আমাকে ফোন দিয়ে বলে, ‘‘নামাজ পড়েছ, বাচ্চারা কোথায়?” তখন আমি বললাম, বাচ্চারা আছে, চা খেয়ে আমি বাচ্চাদের পড়তে বসাব।’ এই ছিল টিপুর সঙ্গে তাঁর শেষ কথা।
টিপুর স্ত্রী সাবিহা আক্তার বলেন, ‘আমার স্বামীর এলাকায় অনেক জনপ্রিয়তা ছিল। মানুষের সালিস-দরবার করতেন। এটা ভালো চোখে দেখতেন না একসময়ের শীর্ষ চরমপন্থী দল নেতা গাজী কামরুল।
সে বিভিন্ন সময়ে আমার স্বামীকে হত্যার হুমকি দিত। গাজী কামরুলই মেইন। সেই আমার স্বামীকে হত্যা করেছে। সে কারও ভালো চায় না।’
টিপুর বড় ভাই গোলাম রসুল বাদশা বলেন, ‘খুলনার দৌলতপুর, পাবলাকেন্দ্রিক শত্রুরাই আমার ভাই টিপুকে সুকৌশলে কক্সবাজারে নিয়ে হত্যা করেছে।
আর এর পেছনে সাবেক কাউন্সিলর শেখ হাসান ইফতেখারের হাত রয়েছে। তারা বহুদিন ধরে চেষ্টা চালিয়ে অবশেষে সফল হয়েছে।’
নিহত টিপুর বৃদ্ধ বাবা গোলাম আকবর কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘আমার ছেলে খুব ভালো ছিল। সে মানুষের উপকার করত। কারও কোনো ক্ষতি করেনি।
আমার সেই ছেলেকে বাড়ি থেকে দূরে নিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আমি এই কষ্ট কীভাবে সহ্য করব। আমার সামনে আমার ছেলের গুলিবিদ্ধ লাশ আনবে, তা সহ্য করতে পারব না।’
নগরীর দৌলতপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মীর আতাহার আলী বলেন, ‘গোলাম রব্বানী টিপুর বিরুদ্ধে দৌলতপুর থানায় হুজি শহীদ হত্যা মামলাসহ দুটি মামলা ছিল। বর্তমানে তাঁর নামে কোনো মামলা নেই।
এ ছাড়া ৫ আগস্টের পর খালিশপুর থানায় তাঁর নামে মামলা হয়েছে বলে শুনেছি। তবে তার লাশ, এখনো কক্সবাজারে রয়েছে (সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত)।’
উল্লেখ্য, গোলাম রব্বানী খুলনা সিটির ৪ নম্বর ওয়ার্ডের সদ্য সাবেক কাউন্সিলর এবং মহানগর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহসভাপতি।গত ২৬ সেপ্টেম্বর দেশের ১২টি সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলরদের সঙ্গে তাঁকেও অপসারণ করে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর থেকে তিনি আত্মগোপনে ছিলেন।
এদিকে কক্সবাজার সদর মডেল পুলিশ জানিয়েছে, টিপু খুনের ঘটনায় অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে হত্যা মামলা (১৮/১৮-২০২৫) দায়ের করেছেন নিহতের ভগিনীপতি মো. ইউনুস আলী সেখ (৫৯)।
শুক্রবার দুপুরে নথিভুক্ত হওয়া মামলার এজাহারে তিনি উল্লেখ করেন- ভিকটিম গোলাম রব্বানী টিপু (৫৫) আমার স্ত্রী নুরজাহান বেগম হ্যাপির আপন মেজো ভাই।
শুক্রবার বিকেলে ময়নাতদন্ত শেষে নিহত গোলাম রব্বানী টিপুর মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। হতভাগা টিপুর ভগ্নিপতি ইউনুস আলীর নেতৃত্বে স্বজনরা কক্সবাজার জেলা সদর হাসপাতাল মর্গ থেকে মরদেহ গ্রহণ করে খুলনার উদ্দেশ্যে রওনা দেন।
সর্বশেষ র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটেলিয়ান র্যাব-১৫ বৃহস্পতিবার রাতে গোলাম রব্বানী টিপুকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় সন্দেহভাজন দুইজনকে আটক করেছে । তারা হলেন- খুলনা সিটি করপোরেশনের ১৬নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর শেখ হাসান ইফতেখার ওরফে সালু (৫৩)। তিনি ওই ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। তাকে বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে হোটেল সীহিল থেকে আটক করে র্যাব। পরে শুক্রবার ভোরে র্যাব কক্সবাজার শহরের টেকপাড়ার বাসিন্দা মেজবাহ হক ভুট্টোকে আটক করে।
পুলিশ ও প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, গোলাম রব্বানী টিপু সৈকত তীরের হোটেল সীগাল সংলগ্ন ঝাউবনের ভেতরে গতকাল রাতে কাঠের তৈরি সেতুর পাশে হাঁটছিলেন। এ সময় মোটরসাইকেলে দুই ব্যক্তি এসে টিপুর মাথায় গুলি করে দ্রুত পালিয়ে যান। পূর্বশত্রুতার জেরে এ হত্যাকাণ্ড বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।
র্যাব-১৫ কক্সবাজার ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল এইচএম সাজ্জাদ হোসেন বলেন, খুলনা সিটি করপোরেশনের সাবেক কাউন্সিলর গোলাম রব্বানী টিপু, শেখ ইফতেখার বৃহস্পতিবার সকালে কক্সবাজারে আসেন। তারা সকাল ৭টার দিকে শহরের কলাতলী এলাকার হোটেল গোল্ডেন হিলে ওঠেন। হোটেলের অতিথি লিপিবদ্ধ বইয়ে দেখা গেছে, আটক ইফতেখার ও নিহত গোলাম রব্বানী টিপুর সঙ্গে রুমি (২৭) নামে এক নারীও ছিলেন। ওই নারী পলাতক রয়েছেন। সূত্র জানায়, পলাতক রহস্যময়ী নারী রুমি খুলনা মেডিকেল কলেজের ছাত্রী।
এইচএম সাজ্জাদ হোসেন আরও জানান, হোটেলের সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, গতকাল সন্ধ্যা ৬টা ৩১ মিনিটে ওই নারীসহ নিহত কাউন্সিলর টিপু হোটেল থেকে বের হন। এরপর রাত ৮টা ২০ মিনিটের দিকে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত সংলগ্ন হোটেল সীগালের সামনের ফুটপাতে দুর্বৃত্তের গুলিতে নিহত হন গোলাম রব্বানী টিপু।
কক্সবাজারের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহাম্মদ জসিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, খুলনা সিটি করপোরেশনের সাবেক কাউন্সিলর হত্যার রহস্য উন্মোচনে পুলিশের পাশাপাশি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর একাধিক টিম কাজ করছে। এর মধ্যে দুজনকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
অন্যদিকে পর্যটনেএলাকায় এ হত্যাকাণ্ড সমুদ্র সৈকতের নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রতি বড় প্রশ্ন তুলেছে। এলাকাবাসী ও পর্যটকদের মধ্যে এ ঘটনায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে।বৃহস্পতিবার রাতেই সৈকতে পর্যটক খুনের চাঞ্চল্যকর ঘটনার পর পরই ভয়ে পর্যটকরা হোটেল ছেড়ে দিয়ে কক্সবাজার শহর ছাড়তে শুরু করেছেন।অনেক পর্যটক নিরাপত্তার অভাবে রাতেই হোটেলের বুকিং বাতিল করে দিয়েছেন।
প্রসঙ্গত, কক্সবাজার সৈকতের অন্ধকারাচ্ছন্ন ঝাউবিথী সন্ত্রাসীদের অভয়ারণ্য হয়ে উঠেছে। প্রতিনিয়ত ছিনতাই, রাহজানি সৈকতে লেগে থাকায় চরম নিরাপত্তাহীনতার কারণে দিন দিন পর্যটকের সংখ্যা কমে যাচ্ছে।
Posted ৯:২১ অপরাহ্ণ | শুক্রবার, ১০ জানুয়ারি ২০২৫
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta