কক্সবাংলা ডটকম(২৭ জানুয়ারী) :: একদিকে করোনা মহামারি, অন্যদিকে সংঘাতের আশঙ্কা—এই দুই চ্যালেঞ্জকে সামনে রেখেই বুধবার (২৭ জানুয়ারি) অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে বহুল প্রতীক্ষিত চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশন (চসিক) নির্বাচন। আগামী পাঁচ বছর চট্টগ্রামের নগরপিতা কে হবেন, তা নির্ধারিত হবে আজ। ভোটের মাধ্যমে চূড়ান্ত হবে ৪১টি সাধারণ ওয়ার্ড ও ১৪টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডের কাউন্সিলর। এবারের নির্বাচনে ভোট দেবেন ১৯ লাখ ৩৮ হাজার ৭০৬ জন ভোটার। মেয়র পদে সাতজন ও কাউন্সিলর পদে ২২৯ জন প্রার্থী আছেন ভোটের মাঠে। নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ করতে সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
৭৩৫ ভোটকেন্দ্রের প্রতিটিতে মঙ্গলবার নির্বাচনসামগ্রীও পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। নির্বাচনের দায়িত্বে থাকবে মোট ১৪ হাজার ৩৭০ জন র্যাব, পুলিশ, বিজিবি ও আনসার সদস্য। ২৫ প্লাটুন বিজিবি সোমবার থেকে টহলও দিচ্ছে নগরীর বিভিন্ন সড়কে।
ভোটের আগের দিন আওয়ামী লীগ দলীয় মেয়র প্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরী বলেছেন, ‘নগরপিতা হয়ে একটিবার সেবা করার সুযোগ চাই। উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে আস্থা রাখুন নৌকায়।’
অন্যদিকে, বিএনপি দলীয় মেয়র প্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেন ভোটারদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘ভয়ভীতি উপেক্ষা করে ভোটকেন্দ্রে আসুন। ধানের শীষে আস্থা রাখুন।’
নগরের ৪১টি ওয়ার্ডে নির্বাচন হলেও প্রশাসনের টেনশন বেশি ১২টি ওয়ার্ড নিয়ে। দলীয় সমর্থন না পেয়ে এসব ওয়ার্ডের নয়টিতে বর্তমান কাউন্সিলররাই বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করছেন। অপর তিনটি ওয়ার্ডের একটিতে এককভাবে সবচেয়ে বেশি ভোটার আছে। বর্তমান কাউন্সিলররা দলীয় সমর্থন পেলেও অন্য দুটি আলোচনায় আছে একাধিক বিদ্রোহী নিয়ে। ত্রিমুখী লড়াই হওয়া এই ১২টি ওয়ার্ডের দিকে তাকিয়ে আছে প্রধান দুই দলের মেয়র প্রার্থীরাও। কারণ জয়-পরাজয় নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করবে এই ওয়ার্ডগুলো। এসব ওয়ার্ডে নিরাপত্তাকর্মীর সংখ্যাও বেশি রাখছে নির্বাচন কমিশন। গতকাল সংবাদ সম্মেলন করে উৎসবের আমেজেই ভোটারদের কেন্দ্রে যেতে বলেছেন চসিক নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মোহাম্মদ হাসানুজ্জামান।
আগ্রহের কেন্দ্রে রেজাউল ও শাহাদাত : চসিক নির্বাচনে মেয়র পদে লড়ছেন সাত প্রার্থী। তবে আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন আওয়ামী লীগের রেজাউল করিম চৌধুরী ও বিএনপির ডা. শাহাদাত হোসেন। গণসংযোগেও নগরীর ৪১ ওয়ার্ডের প্রতিটিতে ছুটেছেন তারা। অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগে ভোটের মাঠ গরমও রেখেছেন এ দুই প্রার্থী। ৭৩৫ ভোটকেন্দ্রের প্রতিটিতে আজ এজেন্ট থাকবে নৌকা ও ধানের শীষের। জিততে মরিয়া রেজাউল ও শাহাদাতের ভাগ্য নির্ধারণ করবেন আজ ১৯ লাখ ৩৮ হাজার ভোটার।
১২ ওয়ার্ড নিয়ে টেনশন : সদ্য সাবেক হওয়া ৯ কাউন্সিলর বিদ্রোহী প্রার্থী হয়ে ভোটের মাঠে থাকায় টেনশন বেড়েছে প্রশাসনের। আওয়ামী লীগের সিনিয়র নেতৃবৃন্দ, প্রশাসন ও দলীয় মনোনয়ন পাওয়া প্রার্থীদের চরম চাপ, হুমকি-ধমকি উপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত ভোটের মাঠ থেকে সরে যাননি তারা। এখনও লড়াইয়ে আছেন ৯ সাবেক কাউন্সিলর। তারা হলেন- ১ নম্বর দক্ষিণ পাহাড়তলী ওয়ার্ডের তৌফিক আহমেদ চৌধুরী, ২ নম্বর জালালাবাদে সাহেদ ইকবাল বাবু, ৯ নম্বর উত্তর পাহাড়তলীতে জহুরুল আলম জসীম, ১১ নম্বর দক্ষিণ কাট্টলীতে মোরশেদ আক্তার চৌধুরী, ১২ নম্বর সরাইপাড়া ওয়ার্ডে সাবের আহমেদ, ১৪ নম্বর লালখান বাজারে এফ কবির মানিক, ২৭ নম্বর দক্ষিণ আগ্রাবাদে এইচএম সোহেল, ২৮ নম্বর পাঠানটুলীতে আব্দুল কাদের ও ৩৩ নম্বর ফিরিঙ্গীবাজারে হাসান মুরাদ বিপ্লব।
নির্বাচনের শুরু থেকে আলোচনায় থাকা এই ৯ বিদ্রোহী প্রার্থী এবারের ভোটে আলাদা করে নজর কেড়েছেন সবার। এর বাইরেও আলোচনায় আছে তিনটি ওয়ার্ড। ৪ নম্বর চান্দগাঁও ওয়ার্ডে সাবেক কাউন্সিলর সাইফুদ্দিন খালেদ সাইফু দলীয় মনোনয়ন পেলেও তাকে ঠেকাতে মাঠে আছেন আওয়ামী লীগের চার বিদ্রোহী। ৩৭ নম্বর মুনিরনগর ওয়ার্ডে এবার আওয়ামী লীগ থেকে আব্দুল মান্নানকে মনোনয়ন দেওয়া হলেও স্থানীয় নেতাকর্মীরা তাকে দলীয় প্রার্থী হিসেবে মানছেন না। এখানে মান্নানের বিরুদ্ধে নির্বাচন করছেন কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সাবেক সহসম্পাদক মেজবাহ উদ্দিন মোর্শেদ ও সাবেক ছাত্রলীগ নেতা মো. সালাউদ্দিন। আবার ভোটার সংখ্যা বেশি হওয়ায় বেশি ভাবাচ্ছে নগরের ইপিজেড থানার ৩৯ নম্বর দক্ষিণ হালিশহর ওয়ার্ডটি। শুধু এই ওয়ার্ডেই ভোটার এক লাখ ২১ হাজার ৭৩৮ জন। বুথ ৩০১টি। কেন্দ্র ৪১টি। নগরীর অন্য কোনো ওয়ার্ডে নেই এত বেশিসংখ্যক ভোটার। জয়-পরাজয় নির্ধারণে তাই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকায় থাকবে আজ এই ওয়ার্ডের ভোটাররাও।
৭৩৫ কেন্দ্রে পাঠানো হয়েছে সরঞ্জাম :
চসিক নির্বাচনের ৭৩৫টি কেন্দ্রে নির্বাচনী সরঞ্জাম গতকাল বিতরণ করেছে কমিশন। নগরের এমএ আজিজ স্টেডিয়ামের জিমনেশিয়াম হল, আগ্রাবাদ বালিকা উচ্চবিদ্যালয়, নাসিরাবাদ বালক উচ্চবিদ্যালয়, বন্দর স্কুল অ্যান্ড কলেজ থেকে সরঞ্জাম বিতরণ করা হয়। এবারের নির্বাচনে ৭৩৫টি কেন্দ্রে চার হাজার ৮৮৬টি কক্ষে ৯ হাজার ৭৭২ জন পোলিং অফিসার দায়িত্ব পালন করবেন। সরঞ্জাম বিতরণস্থল পরিদর্শন করে নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মুহাম্মদ হাসানুজ্জামান সাংবাদিকদের বলেন, ‘নির্বিঘ্নে ভোটকেন্দ্রে যান। আমরা আপনাদের নিরাপত্তা দেব। কেউ যদি নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র করেন, কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না। নিরাপত্তার সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছি আমরা।’
দুই ইপিজেডের সব কারখানায় ছুটি : সাধারণ ছুটি না থাকলেও নির্বাচন উপলক্ষে নগরের দুটি রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকার (ইপিজেড) সব কারখানায় ছুটি ঘোষণা করেছে কর্তৃপক্ষ।
সিইপিডেজের মহাব্যবস্থাপক মশিউদ্দিন বিন মেজবাহ বলেন, আমাদের ১৫৪টি কারখানার মধ্যে ১৩৪টি অপারেশনে রয়েছে। এসব কারখানায় প্রায় পৌনে দুই লাখ কর্মী কাজ করেন। চসিক নির্বাচনের দিন বুধবার সব কারখানা বন্ধ থাকবে। কর্ণফুলী রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ এলাকার মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ এনামুল হক বলেন, আমাদের ৫১টি কারখানার মধ্যে ৪৩টি অপারেশনে রয়েছে। চসিক নির্বাচনের দিন কর্তৃপক্ষের নির্দেশনা অনুযায়ী আমরা সব কারখানায় ছুটি ঘোষণা করেছি। তিনি জানান, এ ইপিজেডের বিভিন্ন কারখানায় ৭০ হাজার কর্মী চাকরি করেন।
প্রস্তুত প্রশাসন : রিটার্নিং কর্মকর্তা মোহাম্মদ হাসানুজ্জামান জানিয়েছেন, চসিক নির্বাচনে সাত হাজার ৭৭২ জন পুলিশ সদস্য মোতায়েন থাকবে। সেই সঙ্গে ২৫ প্লাটুন বিজিবি এবং র্যাবের ৪১টি টিম থাকবে। পুলিশের রিজার্ভ টিম ও আনসার সদস্য মোতায়েন থাকবে নির্বাচনী এলাকায়। গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে ৪১৬টি কেন্দ্রকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসব কেন্দ্রে ১৮ জন করে এবং সাধারণ কেন্দ্রগুলোতে ১৬ জন করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য নিয়োজিত থাকবেন। প্রথমবারের মতো চসিক নির্বাচনে সব কেন্দ্রে ইভিএমের মাধ্যমে ভোট গ্রহণ হবে। আশা করছি ভোট গ্রহণে কোনো ধরনের অসুবিধা হবে না। ৩১ নম্বর ওয়ার্ডে কাউন্সিলর প্রার্থী তারেক সোলেমান সেলিমের মৃত্যুতে ওই ওয়ার্ডে শুধু কাউন্সিলর পদে নির্বাচন স্থগিত করা হয়েছে। প্রার্থী না থাকায় ১৮ নম্বর পূর্ব বাকলিয়া ওয়ার্ডে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হতে যাচ্ছেন কাউন্সিলর প্রার্থী মো. হারুনুর রশিদ।
আমাকে একটিবার সেবা করার সুযোগ দিন- রেজাউল করিম :নগরবাসীর কাছে একটিবার সেবা করার সুযোগ চেয়েছেন নৌকার প্রার্থী রেজাউল করিম চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘রাজনীতির ৫০ বছরে আমি কখনোই দুর্নীতিতে জড়াইনি। আমাকে নিয়ে কোথাও কোনো বিতর্ক নেই। উন্নয়নের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখতে নৌকার ওপর আস্থা রাখুন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ওপর আস্থা রাখুন। চট্টগ্রামের দায়িত্ব যিনি নিজের কাঁধে নিয়েছেন, আসুন তাকেই বিশ্বাস করি মনেপ্রাণে।’
গণসংযোগে সন্তোষ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘নির্বাচনে এবার সব দল সমানভাবে প্রচারের সুযোগ পেয়েছে। এমন নির্বাচনী পরিবেশ ছিল না অতীতের কোনো নির্বাচনে। বিক্ষিপ্ত দু-একটি ঘটনা ছাড়া বড় ধরনের কোনো সহিংসতা হয়নি কোথাও।’ ভোটের আগের দিন রেজাউল করিম আরও বলেন, ‘নৌকার ওপর আস্থা রাখুন। সত্যিকারের বাণিজ্যিক রাজধানী পাবেন। আমার ওপর আস্থা রাখুন। একজন সত্যিকারের সেবক পাবেন। আমার আর চাওয়া-পাওয়ার কিছু নেই। জীবনের বাকি সময়টা নগরবাসীর সেবাতেই কাটিয়ে দিতে চাই।’
ভয়ভীতি উপেক্ষা করে ভোটকেন্দ্রে যান- ডা. শাহাদাত :
নির্বাচনকে কেন্দ্র করে বিএনপির ৫৬ নেতাকর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে দাবি করেছেন ধানের শীষের প্রার্থী ডা. শাহাদাত হোসেন। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের এক দিন আগে আমার ৫৬ জন নির্বাচনী এজেন্টকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। যেহেতু এজেন্টরা নির্বাচনের একটি অংশ। তাই তাদের ছাড়িয়ে আনতে কমিশনকে অনুরোধ জানিয়েছি। কমিশন এতে বিফল হলে ব্যর্থতার দায়ভার নিয়ে তাদের নির্বাচনী দায়িত্ব থেকে সরে আসা উচিত।’
তিনি বলেন, ‘ভোট ডাকাতির যে মহড়া দিয়েছে আওয়ামী লীগ, তার জবাব দিতে ভোটকেন্দ্রে যেতে হবে ভোটারদের। ভয়ভীতি উপেক্ষা করে ভোটকেন্দ্রে যান। চট্টগ্রামে ভোটবিপ্লব করুন।’ নির্বাচনের প্রস্তুতিতে সন্তোষ প্রকাশ করে ডা. শাহাদাত বলেন, ‘গণসংযোগে গিয়ে অভূতপূর্ব সাড়া পেয়েছি। মানুষ যদি কেন্দ্রে যাওয়ার সুযোগ পায়, তবে ইতিহাস হবে চট্টগ্রামে।’
Posted ৪:১৫ পূর্বাহ্ণ | বুধবার, ২৭ জানুয়ারি ২০২১
coxbangla.com | Chanchal Chy