শনিবার ১৪ই জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ | ৩১শে জ্যৈষ্ঠ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

শিরোনাম

শনিবার ১৪ই জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

শিরোনাম

তক্ষশীলা : ইতিহাসের অতলে হারানো এক আধুনিক নগর

শনিবার, ১০ মে ২০২৫
40 ভিউ
তক্ষশীলা : ইতিহাসের অতলে হারানো এক আধুনিক নগর

কক্সবাংলা ডটকম(৯ মে) :: ভারতীয় উপমহাদেশের প্রাচীন সভ্যতার ইতিহাস ঘটলে যে ক’টি নাম পাওয়া যাবে, তাদের মধ্যে তক্ষশীলা অন্যতম। বিস্ময়কর হলেও সত্য—এক সময়ের বৌদ্ধধর্মের প্রাণকেন্দ্র তক্ষশীলা, আজকেরই ইসলামি রাষ্ট্র পাকিস্তানের অংশ। খ্রিস্টপূর্ব ৬ষ্ঠ শতক থেকে খ্রিস্টীয় ৫ম শতক পর্যন্ত, প্রায় এক সহস্রাব্দ ধরে তক্ষশীলা ছিল সভ্যতা, সংস্কৃতি, শিল্প-সাহিত্য ও বিদ্যাচর্চার এক অনন্য কেন্দ্র। মধ্য ও পশ্চিম এশিয়ার সঙ্গে ভারতীয় উপমহাদেশের অন্যতম প্রধান বাণিজ্যিক রুট হিসেবে পরিচিত এই নগরীর ওপর দিয়েই গিয়েছে ঐতিহাসিক প্রাচীন সিল্ক রুট।

তবে সময়ের স্রোতে হারিয়ে যায় বহু প্রাসঙ্গিকতা। এক সময়ের গুরুত্বপূর্ণ তক্ষশীলার বাণিজ্যপথগুলোরও গুরুত্ব কমে যেতে থাকে। অবশেষে হুনদের আক্রমণে পতন ঘটে প্রাচীন এই নগরীর। ধীরে ধীরে তলিয়ে যায় সে সময়কার সমৃদ্ধ সভ্যতা। তবুও ইতিহাস তো আর নিছক কোনো গল্প নয়—একবার রচিত হলে তা মুছে ফেলা যায় না। ইতিহাসের সাক্ষ্য বহন করে আজও পাকিস্তানের পাঞ্জাব প্রদেশের রাওয়ালপিন্ডিতে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে প্রায় আড়াই হাজার বছরের পুরনো তক্ষশীলার স্মৃতি নিদর্শন।

সিরকাপের ধ্বংসাবশেষ।

প্রাচীন ভারতবর্ষের ষোড়শ মহাজনপদের মধ্যে অন্যতম গান্ধার-এর রাজধানী ছিল এই তক্ষশীলা। ক্ষয়ে যাওয়ার দেড় হাজার বছর পর, সম্প্রতি প্রাচীন এ শহর ঘুরে দেখার সুযোগ হয় আমাদের।

সময়টা ছিল চলতি বছরের ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি। তপ্ত দুপুরে বেলা ১টার দিকে আমরা পৌঁছে গেলাম তক্ষশীলার ‘সেকেন্ড সিটি’ হিসেবে পরিচিত প্রাচীন নগরী সিরকাপে। তার আগে সকালে অবশ্য ঘুরে এসেছি তক্ষশীলা জাদুঘর, যেখানে মাটির নিচ থেকে উদ্ধার করা পুরাতন নিদর্শনগুলো সাজিয়ে-গুছিয়ে রাখা হয়েছে নিখুঁতভাবে। এসব নিদর্শনের মধ্যে রয়েছে গৌতম বুদ্ধের বিভিন্ন সময় ও অবস্থানের ভাস্কর্য, প্রাচীন কৃষি যন্ত্রপাতি, দরজার তালা-চাবি, থালা-বাসন, চিকিৎসা সরঞ্জাম, টেরাকোটা, নারী-পুরুষের গয়নাসহ অনেককিছু। এমনকি, সেখানে পাওয়া গেল প্রাচীন তক্ষশীলার পূর্ণাঙ্গ মানচিত্রও।

সিরকাপে যাওয়ার আগে চলুন জেনে নিই তক্ষশীলার সংক্ষিপ্ত ইতিহাস।

ডান দিক থেকে ছবিতে দেখা যাচ্ছে টেরাকোটা পাত্র, ধর্মচাকা বা ‘হুইল অব ল’, মন্দিরের ঘণ্টা, সিলভার তৈরি গয়না ইত্যাদি।

আমাদের মিউজিয়াম গাইডের বর্ণনা, রামায়ণ ও বিভিন্ন এনসাইক্লোপেডিয়ার তথ্য অনুযায়ী—তক্ষশীলা নগরী প্রতিষ্ঠা করেন দশরথের দ্বিতীয় পুত্র ও রামচন্দ্রের ছোট ভাই ভরত। প্রাচীন এ নগরীর নামকরণ করা হয়েছিল ভরতের সন্তান ‘তক্ষ’ এর নামানুসারে। খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতাব্দী থেকেই তক্ষশীলা পরিচিত ছিল জ্ঞান, শিক্ষা ও গবেষণার এক দীপ্ত কেন্দ্র হিসেবে। জনশ্রুতি অনুযায়ী, এখানে জ্ঞান সাধনা করেছেন সংস্কৃত ব্যাকরণবিদ পাণিনি, রাষ্ট্রনীতি ও কূটনীতির গুরু আর্য্য চাণক্য ও চিকিৎসাবিদ জীবক।

তক্ষশীলার ইতিহাসে বিভিন্ন যুগে একাধিক শাসকের আগমন ঘটেছে। প্রথমে এটি ছিল পারস্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত। পরে খ্রিস্টপূর্ব ৩২৬ সালে আলেকজান্ডার দ্য গ্রেট এই নগরীর দখল নেন। এরপর একে একে ব্যাকট্রিয়ান, শক, পার্থিয়ান ও কুষাণ শাসকেরা এখানে শাসন প্রতিষ্ঠা করেন। সর্বশেষ মধ্য এশিয়ার হুনদের হাতে সমৃদ্ধ প্রাচীন তক্ষশীলা তার সভ্যতা-সংস্কৃতি ও বাণিজ্যিক গুরুত্ব হারায়। তবে দীর্ঘ এ শাসনকালগুলো তক্ষশীলার ইতিহাসকে করেছে বৈচিত্র্যময় এবং প্রতিটি শাসনামলই এখানে রেখে গেছে তাদের নিজস্ব সাংস্কৃতিক ছাপ।

তক্ষশীলা জাদুঘরে সিরকাপের ধ্বংসাবশেষ থেকে উদ্ধার করা বিভিন্ন কৃষি যন্ত্রপাতি।

সম্রাট অশোকের শাসনামলে তক্ষশীলা পরিণত হয়েছিল গুরুত্বপূর্ণ এক বৌদ্ধ তীর্থস্থানে। ধর্মপ্রচারের উদ্দেশ্যে তিনি এখানে নির্মাণ করেন ধর্মরাজিকা স্তূপ—যেখানে গৌতম বুদ্ধের দেহাবশেষের অংশবিশেষ সংরক্ষিত ছিল বলে বিশ্বাস করা হয়। শুধু বৌদ্ধ ধর্মই নয়—জনশ্রুতি অনুযায়ী, খ্রিস্টীয় প্রথম শতকে খ্রিস্টান ধর্মপ্রচারক সেন্ট থমাসও তক্ষশীলা ভ্রমণ করেছিলেন। ফলে এই নগরী হয়ে ওঠে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের কাছে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ এক পবিত্র স্থান।

তক্ষশীলার সেকেন্ড সিটি সিরকাপে আমাদের গাইড ছিলেন আসাদ আব্বাস। পাকিস্তানের প্রত্নতত্ত্ব মন্ত্রণালয়ের অধীনে ১৮ বছর ধরে কর্মরত অভিজ্ঞ এই কর্মচারী জানালেন, প্রাচীন তক্ষশীলার তিনটি প্রধান নগরীর মধ্যে রয়েছে ভির মাউন্ড, সিরকাপ এবং সিরসুখ। এরমধ্যে সিরকাপ ছিল মূলত তক্ষশীলার প্রধান বাণিজ্যিক কেন্দ্র, একসময় যেখানে গড়ে উঠেছিল সুপরিকল্পিত নগরব্যবস্থা—বাড়িঘর, দোকানপাট, রাস্তাঘাট এবং উপাসনালয়।

সিরকাপের ধ্বংসাবশেষ।

সিরকাপ কতটা সমৃদ্ধ ও আধুনিক ছিল তা বোঝা গেল সাইটটিতে প্রবেশের চওড়া হাইওয়ে দেখেই। প্রায় সাড়ে ১৮ ফুট চওড়া গ্রিড প্যাটার্নে নির্মিত এই হাইওয়ে বা মহাসড়কের শুরুতেই রয়েছে প্রহরীদের জন্য আলাদা ঘর। এরপরে একে একে রয়েছে বিভিন্ন জিনিসপত্রের দোকান। আর এই দোকানপাটের পেছনে রয়েছে মানুষের বসত বাড়ি। তবে এগুলোর কোনোটিই এখন আর জীবন্ত নয়—দেড় হাজার বছরেরও বেশি সময় আগে ধ্বংস হয়ে যাওয়া পরিকল্পিত এক নগরীর স্মৃতি চিহ্নটুকু কেবল রয়েছে বর্তমান তক্ষশীলায়।

সিরকাপে ঢুকতেই হাতের ডানে প্রহরীদের জন্য কক্ষ।

১৮৬৩ সালে প্রাচীন তক্ষশীলার ধ্বংসাবশেষ সর্বপ্রথম চিহ্নিত ও প্রত্নতাত্ত্বিকভাবে আবিষ্কার করেন তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার প্রতিষ্ঠাতা মহাপরিচালক স্যার আলেকজান্ডার কানিংহ্যাম। এরপর ১৯১৩ থেকে ১৯৩৪ সালের মধ্যে তক্ষশীলার ধ্বংসাবশেষে খননকাজ পরিচালনা করেন আরেক ব্রিটিশ প্রত্নতাত্ত্বিক স্যার জন মার্শাল; তিনি এ সময় আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার মহাপরিচালক ছিলেন। আধুনিক যুগে এসে জন মার্শালের হাত ধরেই উন্মোচিত হয় প্রাচীন এ নগরীর ইতিহাস।

তক্ষশীলার প্রধান তিন শহর ভির মাউন্ড, সিরকাপ ও সিরসুখের মানচিত্র।

“এই প্রাচীন শহরে অন্তত ২৫ হাজার মানুষের বসবাস ছিল,” জানালেন গাইড আসাদ আব্বাস। “তক্ষশীলা ছিল সিল্ক রুটের ওপর অবস্থিত একটি কমার্শিয়াল হাব। এখানকার মানুষ মূলত স্বর্ণ, টেরাকোটা ও চামড়ার ব্যবসা করতেন। রেশম (সিল্ক) আমদানি করা হতো সরাসরি চীন থেকে।”

তবে তক্ষশীলা থেকে চীনের সীমান্তবর্তী শহর কাশগারের আনুমানিক দূরত্ব প্রায় ১,২০০ কিলোমিটার হলেও আফগানিস্তান ও চীনের মাঝে সংযোগের কেন্দ্রবিন্দু ছিল এই শহর।

সিরকাপের ধ্বংসাবশেষ।

আব্বাস জানালেন, সিরকাপের আয়তন প্রায় ৫ লাখ বর্গমিটার; তবে ত্রিশের দশক পর্যন্ত এই জায়গার মাত্র দেড় লাখ বর্গমিটার খননের মাধ্যমে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে। বাকি অন্তত এক-তৃতীয়াংশের বেশি এখনও রয়ে গেছে মাটির নিচে।

আব্বাসের ভাষ্যে, প্রাচীন এই শহরে মোট প্রত্নতাত্ত্বিক সাইটের সংখ্যা ২০০ এর অধিক। তবে এখন পর্যন্ত খনন হয়েছে মাত্র ২৩টি।

সিরকাপের ধ্বংসাবশেষ।

সাইটগুলো আবিষ্কারের শত বছর পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত কেন মাত্র ২৩টি সাইট খনন হয়েছে জানতে চাইলে আব্বাস বললেন, “আসলে এই জমিগুলো ব্যক্তি মালিকানাধীন। ফলে এখানে খনন কাজ চালাতে হলে প্রথমে সরকারকে জমিটি কিনতে হয় এবং এরপর খনন কাজের জন্য বাজেট ঘোষণা করা হয়। ফলে পুরো প্রক্রিয়াটি বেশ ব্যয়বহুল ও জটিল। এ কারণে এখন পর্যন্ত খুব অল্প সংখ্যক সাইটই মাটির নিচ থেকে উদ্ধার করা গেছে।”

সিরকাপের ধ্বংসাবশেষ।

সিরকাপ ছিল এক সময়ের প্রাণবন্ত ও সমৃদ্ধ নগরী। এর গোড়াপত্তন গ্রিকদের হাতে হলেও পরবর্তী সময়ে নগরীটি আরও বিকশিত হয় সিথিয়ান (শক), পার্থিয়ান এবং সর্বশেষ কুষাণদের শাসনামলে। তবে সময়ের সঙ্গে বদলাতে থাকে নগরীর ভাগ্যও। কুষাণ সম্রাট কণিষ্ক সিরকাপের পাশেই নতুন শহর ‘সিরসুখ’ প্রতিষ্ঠা করলে, ধীরে ধীরে গুরুত্ব হারাতে থাকে সিরকাপ। বাণিজ্য, বসতি ও কৌশলগত অবস্থান—সবই সরে যেতে থাকে নতুন শহরের দিকে; সবশেষে হয় হুনদের আক্রমণ, আর সিরকাপ হারিয়ে যায় ইতিহাসের অতলে।

সিরকাপে জৈন ধর্মাবলম্বীদের উপাসনালয়।

তবে আজকের ধ্বংসস্তূপে দাঁড়িয়ে বোঝা যায়, সিরকাপ কেবল একটি নগরীই ছিল না; এটি ছিল বহু ধর্ম ও সংস্কৃতির মিলনস্থল। গাইড আসাদ আব্বাস জানালেন, প্রাচীন এই শহরে একসঙ্গে বসবাস করতেন হিন্দু, বৌদ্ধ, জৈনসহ নানা ধর্মের অনুসারীরা।

সাইটে কিছুদূর এগোতেই চোখে পড়লো জৈন ধর্মাবলম্বীদের একটি উপাসনালয়ের ধ্বংসাবশেষ। ধারণা করা হয়, তক্ষশীলায় প্রাচীনকাল থেকেই জৈন ধর্মাবলম্বীরা বসবাস করতেন। খননকালে এখানে পাওয়া গেছে জৈন ধর্মের ঐতিহাসিক দলিল, মূর্তি ও প্রতীকচিহ্ন।

আর খানিকটা এগোতেই হাতের ডানে দেখা গেল সূর্য মন্দির। আব্বাস জানালেন, “তৎকালীন হিন্দু অধিবাসীরা সূর্যদেবের উপাসক ছিলেন। তাদের বিশ্বাস ও ভক্তির প্রতীক হিসেবেই এই সূর্য মন্দিরটি নির্মিত হয়।”

হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সূর্য মন্দির বা সান ডায়াল।

তবে এই সূর্য মন্দির কেবল হিন্দুদের উপাসনালয়ই ছিল না, বরং মন্দিরে সূর্যের আলো পড়লে তা পর্যবেক্ষণ করে প্রাচীন মানুষেরা দিন, সময় ও ঋতুকালের ধারণা পেতেন। এই সান ডায়াল আধুনিক ঘড়ির মতো না হলেও, এটি প্রাচীন জ্যোতির্বিদ্যার একটি উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হত বলে বিশ্বাস করেন অনেক প্রত্নতত্ত্ববিদ।

সিরকাপের ধ্বংসাবশেষের ওপর দাঁড়িয়ে যতদূর চোখ গেল, চারিদিকে কেবল ছোট-বড় পাহাড়। পাহাড়ে ঘেরা নিঃসঙ্গ প্রাচীন এ শহর নাকি প্রাণ ফিরে পায় বর্ষায়। বৃষ্টির দিনে তখন ধ্বংসস্তূপের ওপর ঘাসগুলো সবুজ হয়ে ওঠে। আব্বাস জানালেন, সাধারণত মার্চ-এপ্রিল এবং জুলাই-আগস্ট—এই দুটি সময়ে পর্যটকদের আনাগোনা বেশি হয়।  সপ্তাহে ৭ দিনই পর্যটকদের জন্য উন্মুক্ত থাকে সিরকাপ।

সিরকাপে দাঁড়িয়ে যতদূর চোখ যায় কেবল ছোট-বড় পাহাড়।

সিরকাপের অধ্যায় শেষ করে বেলা সোয়া ২টার দিকে রওনা দিলাম তক্ষশীলার আরেক গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন—ধর্মরাজিকা স্তূপের উদ্দেশে। সিরকাপ থেকে প্রায় ৩ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত এই সাইটে পৌঁছাতে গাড়িতে আমাদের সময় লাগলো ১২ মিনিটের মতো।

বেশ উঁচু কিছুটা পাহাড়সদৃশ জায়গায় অবস্থিত ধর্মরাজিকা স্তূপ। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে হলো বেশ খানিকটা উপরে।

ধর্মরাজিকা স্তূপ। ধারণা করা হয়, এখানে গৌতম বুদ্ধের দেহাবশেষের অংশ সংরক্ষণ করেছিলেন সম্রাট অশোক।

ধর্মরাজিকা স্তূপের পেছনে রয়েছে এক গভীর ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট। খ্রিস্টপূর্ব ২৬১ সালে সংঘটিত কলিঙ্গ যুদ্ধের ভয়াবহতা সম্রাট অশোকের জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিল। ঐতিহাসিক তথ্যমতে, রক্তক্ষয়ী এই যুদ্ধে এক লাখেরও বেশি মানুষের প্রাণহানিতে অশোক গভীর অনুশোচনায় পড়ে যান এবং হিন্দু ধর্ম (তৎকালীন বৈদিক ধর্ম) ত্যাগ করে বৌদ্ধ ধর্মে দীক্ষিত হন। যুদ্ধজর্জর সমাজের পরিবর্তে তিনি বিশ্বাস করতে শুরু করেন অহিংসা, করুণা ও শান্তির দর্শনে। সেই বিশ্বাস থেকেই শুরু হয় তার বৌদ্ধ ধর্মপ্রচারের পথযাত্রা, যার এক গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন হলো এই ধর্মরাজিকা স্তূপ।

ধারণা করা হয়, গৌতম বুদ্ধের দেহাবশেষের অংশবিশেষ এখানে সংরক্ষণ করেছিলেন অশোক। আমাদের গাইড জানালেন, খননকালে এখান থেকে উদ্ধার করা হয় একটি ‘গোল্ডেন রেলিক ক্যাসকেট’—যেখানে বুদ্ধের দেহাবশেষ রাখা ছিল বলে মনে করেন অনেক প্রত্নতত্ত্ববিদ।

ধর্মরাজিকায় বুদ্ধের স্তূপ।

ব্রিটানিকা এনসাইক্লোপিডিয়ার তথ্যমতে, গৌতম বুদ্ধের ইচ্ছা অনুযায়ী, তার দেহাবশেষ দাহ করা হয় এবং পরে সেই অস্থি ও ছাই ভাগ করে পাঠানো হয় বিভিন্ন রাজ্যে।

জনশ্রুতি রয়েছে, বুদ্ধের মৃত্যুর বহু বছর পরে সম্রাট অশোক তার দেহাবশেষ সংগ্রহ করে ৮৪,০০০ স্তূপ নির্মাণ করেছিলেন—তার মধ্যেই একটি হলো তক্ষশীলার এই ধর্মরাজিকা স্তূপ।

ধারণা করা হয়, ধর্মরাজিকায় বুদ্ধের অস্থি বা দন্তের অংশবিশেষ সংরক্ষণ করে রেখেছিলেন অশোক।

ধর্মরাজিকায় বুদ্ধের ক্ষয়ে যাওয়া মূর্তি।

এদিকে আমাদের ট্যুর গাইড জানালেন, এখন পর্যন্ত ধর্মরাজিকায় ৭৫টি স্তূপ খনন করে উদ্ধার করা হয়েছে। এরমধ্যে বুদ্ধের স্তূপটি হলো প্রধান—এটিই মূলত বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারীদের উপাসনালয় ও তীর্থস্থান। এছাড়া, আরও দুই ধরনের স্তূপ এখানে রয়েছে। এরমধ্যে একটি হলো—বৌদ্ধ ভিক্ষু, গুরু বা পূর্ণাঙ্গ ভক্তদের স্মরণে নির্মিত স্তূপ; তারা মারা গেলে স্তূপ কমপ্লেক্সের নির্দিষ্ট এই অংশে তাদের দেহাবশেষ সংরক্ষণ করে রাখা হত। তৃতীয়টি হলো—ভোটিভ বা শ্রদ্ধাঞ্জলি স্তূপ, যা মূলত ভক্তরা ব্যক্তিগতভাবে উপাসনার জন্য নির্মাণ করতেন। এগুলো আকারে তুলনামূলক ছোট এবং মূল স্তূপের চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে। এগুলো প্রার্থনা, পূজা বা দানবৃত্তি পালনে ব্যবহার করা হতো।

সিরকাপের মন্দিরে দুই মাথাযুক্ত ঈগলের প্রতিকৃতি।

বুদ্ধের দেহাবশেষকে ঘিরে গঠিত এই ধর্মীয় স্তূপ কমপ্লেক্সের আশেপাশে বৌদ্ধ ভিক্ষুদের জন্য তৈরি অনেকগুলো কক্ষ বা মঠ রয়েছে। এখানে ধ্যান, ধর্মচর্চা ও ধর্মশিক্ষা অনুশীলন হতো বলে ধারণা করা হয়। কিছু প্রত্নতাত্ত্বিকের বিশ্বাস, এখানে প্রাচীন বৌদ্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ও ছিল। কিন্তু এই ধারণার সঙ্গে একমত নন স্যার জন মার্শাল। ১৯৫১ সালে তার লেখা ‘তক্ষশীলা’ গ্রন্থে তিনি একে বিশ্ববিদ্যালয় বলেননি, বরং ধর্মীয় প্রশিক্ষণ ও উপাসনার স্থান হিসেবেই চিহ্নিত করেছেন।

বুদ্ধের প্রতি শ্রদ্ধা জনাতে আজও ধর্মরাজিকায় আসেন তার ভক্তরা। এমনই এক ভক্তকে দেখা গেল আমাদের ভ্রমণের দিনে। গেরুয়া রঙের চাদর গায়ে জড়িয়ে একটি উঁচু স্থানে উঠে তিনি বুদ্ধের প্রতি সম্মান জানালেন।

সিরকাপে ভোটিভ স্তূপ।

ধারণা অনুযায়ী, খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতাব্দীতে সম্রাট অশোকের হাতে নির্মিত হলেও, বিভিন্ন সময়ে এই ধর্মরাজিকা বহুবার সম্প্রসারিত ও পুনর্নিমিত হয়েছে—বিশেষত কুষাণ যুগে (১ম–২য় শতাব্দী খ্রিস্টাব্দ)।

নির্মাণের একেবারে সুনির্দিষ্ট সময়কালের উল্লেখ না থাকলেও, এর প্রধান ও আশপাশের গৌণ স্তূপ এবং মঠগুলো নির্মাণে বহু বছর সময় লেগেছে বলে মনে করেন প্রত্নতাত্ত্বিকরা। এই সাইট থেকে সে সময়ের ইট-পাথরের নির্মাণশৈলী এবং অশোকীয় শিলালিপি উদ্ধার করা হয়েছে। আর ঐতিহাসিক এসব অমূল্য জিনিসের স্থান হয়েছে তক্ষশীলা জাদুঘরে।

সিরকাপে অপসিডাল মন্দির।

প্রাচীন শহরের ধ্বংসাবশেষের ওপর হাঁটতে হাঁটতে মনে হলো, তক্ষশীলা কেবল একটি পুরনো শহরের নাম নয়—এটি ছিল জ্ঞান, সংস্কৃতি আর সভ্যতার এক মহামঞ্চ। গ্রিক নগর পরিকল্পনা, পারস্যের শাসন, বৌদ্ধ ধর্মের প্রসার আর প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের মিলনে গড়ে ওঠা এই নগরে যুদ্ধ নয়, হয়েছিল জ্ঞানের আদান-প্রদান, ঘটেছিল সংস্কৃতির মেলবন্ধন।

১৯৮০ সালে ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পেলেও, তক্ষশীলা নিয়ে বিশ্বমাধ্যমে তেমন আলোচনা বা প্রচার হতে দেখা যায় না। যথাযথ প্রচার-প্রসার ও সংরক্ষণ হলে প্রাচীন এই নগরীও পেতে পারে ইতালির পম্পেই কিংবা পেরুর মাচু পিচুর মতো বিশ্বখ্যাতি।

40 ভিউ

Posted ২:২৪ পূর্বাহ্ণ | শনিবার, ১০ মে ২০২৫

coxbangla.com |

এ বিভাগের সর্বাধিক পঠিত

এ বিভাগের আরও খবর

Editor & Publisher

Chanchal Dash Gupta

Member : coxsbazar press club & coxsbazar journalist union (cbuj)
cell: 01558-310550 or 01736-202922
mail: chanchalcox@gmail.com
Office : Shaheed sharanee road, cox’sbazar municipalty
coxsbazar-4700
Bangladesh
মোবাইল অ্যাপস ডাউনলোড করুন
বাংলাদেশের সকল পত্রিকা সাইট
Bangla Newspaper

ABOUT US :

coxbangla.com is a dedicated 24x7 news website which is published 2010 in coxbazar city. coxbangla is the news plus right and true information. Be informed be truthful are the only right way. Because you have the right. So coxbangla always offiers the latest news coxbazar, national and international news on current offers, politics, economic, entertainment, sports, health, science, defence & technology, space, history, lifestyle, tourism, food etc in Bengali.

design and development by : webnewsdesign.com