কক্সবাংলা ডটকম(২৯ নভেম্বর) :: রাজধানী ও পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলার মধ্যে রেল যোগাযোগ বাড়ানোর লক্ষ্যে ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার দীর্ঘ ডাবল-লাইন ডুয়েল-গেজ বিশিষ্ট বঙ্গবন্ধু রেলসেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
রোববার সকালে প্রধানমন্ত্রী গণভবন থেকে ভার্চুয়ালি এই ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। খবর ইউএনবির
যমুনা নদীর ওপরে বঙ্গবন্ধু সেতুর ৩০০ মিটার উজানে নির্মিত হচ্ছে ডাবল লেনের এই রেললাইন সেতু। নির্মিত হলে এটি হবে দেশের বৃহত্তম রেল সেতু।
প্রায় ১৭ হাজার কোটি টাকায় ব্যয়ে বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতুর ৩০০ মিটার উজানে এই রেলসেতু নির্মাণ করা হচ্ছে। প্রকল্প পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২৪ সালের আগস্টে নির্মাণ কাজ শেষ হবে।
প্রকল্প সূত্র জানিয়েছে, রেলসেতুর দৈর্ঘ্য হবে চার দশমিক আট কিলোমিটার। নদীর দুই তীর থেকে দুটি পৃথক প্যাকেজে নির্মাণ কাজ চলবে। ২০১৬ সালের ডিসেম্বরে যমুনায় পৃথক রেলসেতু নির্মাণের প্রকল্প অনুমোদন পায়। সে সময় ব্যয় ধরা হয়েছিল নয় হাজার ৭৩৪ কোটি টাকা। গত মার্চে প্রকল্প সংশোধন করে ব্যয় নির্ধারণ করা হয় ১৬ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা। কাজ শুরুর আগেই ব্যয় বেড়েছে সাত হাজার ৪৬ কোটি টাকা।
বঙ্গবন্ধুর নামে রেলসেতু নির্মাণে জাইকা ১২ হাজার ১৪৯ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে। বাকি চার হাজার ৬৩১ কোটি টাকা জোগান দেবে সরকার।
বঙ্গবন্ধু রেলসেতুতে ডাবল লাইন ডুয়েল গেজ রেললাইন থাকবে। দুই প্রান্তে আধা কিলোমিটার করে ভায়াডাক্ট এবং সাড়ে সাত কিলোমিটার সংযোগ লাইন নির্মাণ করা হবে। লুপ ও সাইডিংসহ প্রায় ৩০ কিলোমিটার রেললাইন নির্মাণ করা হবে।
যমুনা নদীর ওপর ১৯৯৮ সালে বহুমুখী সেতু নির্মাণ করা হয়। এতে সড়কের পাশাপাশি সিঙ্গেল লাইন রেলপথ রয়েছে। এ কারণে সেতু পারাপারে ট্রেনগুলোকে ক্রসিংয়ের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। নতুন রেলসেতু নির্মাণের পর ক্রসিংয়ের অপেক্ষা থাকবে না। ট্রেনের রানিং টাইম ২০ মিনিট কমবে। ব্রডগেজ ট্রেন ১২০ কিলোমিটার, মিটারগেজ ট্রেন ১০০ কিলোমিটার গতিতে চলতে পারবে। দিনে ৮৮টি ট্রেন চলতে পারবে।
দেশব্যাপী রেল যোগাযোগ আরও সম্প্রসারণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার: প্রধানমন্ত্রী
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, স্বল্প মূল্যে পণ্য ও জন পরিবহন নিশ্চিত করতে সারাদেশে শক্তিশালী যোগাযোগ নেটওয়ার্ক প্রতিষ্ঠার অংশ হিসেবে সরকার দেশব্যাপী রেল যোগাযোগ আরও সম্প্রসারিত করার উদ্যোগ নিয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘রেলকে আরও শক্তিশালী করার আমাদের পরিকল্পনা রয়েছে। সারাদেশে অভ্যন্তরীণ যোগাযোগের জন্য রেল নেটওয়ার্ক আমরা সৃষ্টি করব। যাতে অল্প খরচে পণ্য পরিবহন এবং মানুষের যাতায়াতের অনেক সুবিধা হয়।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যমুনা নদীর ওপরে বঙ্গবন্ধু সেতুর উজানে ১৬ হাজার ৭৮১ কোটি টাকা ব্যয়ে ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের পৃথক ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রেলওয়ে সেতু’র ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনকালে এ কথা বলেন।
তিনি আজ রোববার সকালে গণভবন থেকে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিমপাড় সিরাজগঞ্জের সয়দাবাদে আয়োজিত মূল অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি অংশগ্রহণ করেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সারা বাংলাদেশে আমরা রেলের নেটওয়ার্ক তৈরি করতে চাচ্ছি। একেবারে ঢাকা থেকে বরিশাল, পটুয়াখালী হয়ে পায়রা বন্দর পর্যন্ত রেললাইন নিয়ে যাব। তার সমীক্ষা শুরুর ব্যাপারে আমরা উদ্যোগ নিয়েছি। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম, সেখান থেকে কক্সবাজার ও টেকনাফ পর্যন্ত যাবে রেললাইন।’
তিনি বলেন, ‘রেলপথ, সড়ক পথ, আকাশ পথ এইসবগুলোর উন্নয়নেই আমরা ব্যাপক কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে যাচ্ছি। তাতে আমাদের দেশের অর্থনীতি আরও শক্তিশালী হবে ও মজবুত হবে।’
‘তাছাড়া ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে যখন আমরা সংযুক্ত হয়ে যাব, এটাও আমাদের জন্য বিরাট কাজ হবে’, যোগ করেন তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘জাতির পিতা বলেছিলেন, বাংলাদেশ হবে প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড। অর্থাৎ বাংলাদেশ হবে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে একটা সেতুবন্ধন। আর সেই সেতুবন্ধন করতে গেলে আমাদের ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের সঙ্গে সংযোগ করতে হবে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘তিস্তা নদীর ওপর যে রেল সেতু, সেখানে গাড়ি চলার কোনো সেতু ছিল না। তিনি সরকারে আসার পর সেখানে পৃথক সড়ক সেতু করে দেন। নইলে আগে রেলসেতুর ওপর দিয়েই ঝুঁকিপূর্ণভাবে গাড়ি পারাপার চলতো।’
তিনি বলেন, ‘ভৈরবে রেললাইনের ওপর দিয়েই অপেক্ষমাণ থেকে একটা করে গাড়ি পার হতো। সেখানেও পৃথক সড়ক সেতু করেছেন। কালুরঘাটেও রেল সেতুর পাশাপাশি পৃথক সড়ক সেতু হয়েছে।’
সরকার প্রধান বলেন, ‘এভাবে সারা বাংলাদেশে রেল যোগাযোগকে উন্নত করা, আধুনিক করা এবং বহুমুখী করা, যাতে মানুষের আর্থসামাজিক উন্নয়নে ব্যাপক অবদান রাখতে পারে। সেদিকে লক্ষ্য রেখেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি।’
শেখ হাসিনা দেশের উন্নয়নে সবাইকে আন্তরিকতার সঙ্গে স্ব-স্ব দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি করোনাভাইরাস থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলার বিষয়টিও স্মরণ করিয়ে দেন।
অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন রেলপথমন্ত্রী নুরুল ইসলাম সুজন। বাংলাদেশে জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকী অনুষ্ঠানে বক্তৃতা করেন। রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব সেলিম রেজা স্বাগত বক্তৃতা করেন।
মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস গণভবন প্রান্ত থেকে অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন।
গণভবন প্রান্তে এবং মূল অনুষ্ঠানস্থলে বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি, স্থানীয় সংসদ সদস্যবৃন্দ, উন্নয়ন সহযোগী জাপানের জাইকার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, রেলপথ মন্ত্রণালয় ও স্থানীয় প্রশাসনের কর্মকর্তাবৃন্দ, স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ এবং সাধারণ জনগণ উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু রেলওয়ে সেতুর ওপর একটি ভিডিওচিত্র প্রদর্শিত হয়।
যমুনা নদীর ওপরে বঙ্গবন্ধু সেতুর ৩০০ মিটার উজানে নির্মিত হচ্ছে ডাবল লেনের ৪ দশমিক ৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের বঙ্গবন্ধু রেলওয়ে সেতু। জাপান ও বাংলাদেশ সরকারের যৌথ অর্থায়নে ১৬ হাজার ৭৮০ কোটি টাকা ব্যয়ে এই রেল সেতুটি নির্মাণ করা হবে। প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে জাইকা। ২০২৫ সাল নাগাদ এর নির্মাণ কাজ শেষ হওয়ার কথা রয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘করোনাভাইরাস যাতে আমাদের দেশের মানুষের ক্ষতি করতে না পারে, তার জন্য যা যা করা দরকার আমরা প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। তবে, আমি আবারও দেশবাসীকে আহ্বান জানাব, সকলেই স্বাস্থ্য সুরক্ষার নিয়মগুলো মেনে চলবেন।’
শেখ হাসিনা মাস্ক ব্যবহারের প্রতি গুরুত্বারোপ করে বলেন, ‘নিজেকেও সুরক্ষিত করেন এবং অপরকেও সুরক্ষিত রাখেন। যাতে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাব আমাদের ক্ষতিগ্রস্ত করতে না পারে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আজকে আমি খুবই আনন্দিত, কেননা রেল সেতু করার ব্যাপার নিয়ে আমাকে অনেক তর্ক করতে হয়েছে, অনেক দেন দরবার করতে হয়েছে। আজকে একটা আলাদা সেতু হয়ে যাচ্ছে, যার ফলে আমি মনে করি দেশের অভ্যন্তরীণ আর্থসামাজিক উন্নয়ন তো হবেই, তেমনি আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিকভাবেও আমরা আরও সমৃদ্ধ হব, যা আমাদের দেশকে ভবিষ্যতে আরও উন্নত করবে।’
তিনি বলেন, ‘জাতির পিতা আমাদের স্বাধীনতা দিয়ে গিয়েছেন। তার কাঙ্ক্ষিত উন্নত সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ আমরা গড়ে তুলতে সক্ষম হব ইনশাল্লাহ।’
প্রধানমন্ত্রী এসময় দাতাগোষ্ঠীর প্রেসক্রিপশনে বিএনপির রেল বন্ধ করে দেওয়ার প্রচেষ্টার উল্লেখ করে বলেন, ‘অথচ তিনি নিজের উদ্যোগে বঙ্গবন্ধু সেতুর সঙ্গে রেল সংযোগ প্রদান করেন। আর এখন দাতাগোষ্ঠীরাই সেখানে পৃথক একটি রেলসেতু করারও প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছেন।’
একের পর এক রেলস্টেশন বন্ধ করে দিয়ে রেল কর্মচারীদের কর্মচ্যুতি ঘটানোর প্রসঙ্গ টেনে শেখ হাসিনা বলেন, ‘রেলকে প্রায় গলা টিপে হত্যা করতে গিয়েছিল বিএনপি সরকার। আমরা ক্ষমতায় এসে তাকে জীবিত করেছি। এখন রেলই মানুষের সব থেকে বড় ভরসা। আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, রেল সবকিছুতেই মানুষকে সুযোগটা করে দিচ্ছে, যা অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রাখবে বলে আমি মনে করি।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘জাতির পিতাকে হত্যা করে যারা অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করেছিল, তারা দেশ ও দেশের মানুষের কথা কখনও চিন্তা করেনি। তাদের কোনো দায়বদ্ধতা ছিল না। তারা নিজেদের সম্পদ গড়ার কাজে ব্যস্ত ছিল। তারা রেলকে ধ্বংসের পথে নিয়ে গেছে।’
তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৮ সালে দ্বিতীয় দফায় ক্ষমতায় এসে সারাদেশে রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নে কাজ করে নতুন রেল, বগি, ক্যারেজ, ইঞ্জিন আমদানির পাশাপাশি নতুন রেলপথে সৃষ্টি করলেও ২০১৩, ১৪ ও ১৫ সালে অগ্নিসন্ত্রাসের নামে বিএনপি-জামায়াত সবচেয়ে বড় আঘাতটা হানে এই রেলের উপরেই।’
প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতার অবদান শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করে বলেন, ‘জাপান আমাদের সত্যিকার পরীক্ষিত বন্ধু এবং জাতির পিতা ১৯৭৩ সালে জাপান সফরের সময়ই যমুনা নদীর ওপর সেতুর জন্য জাপানকে অনুরোধ করেছিলেন।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘১৯৯৬ সালে জাপান যাওয়ার পর জাপানের প্রধানমন্ত্রীর জানতে চাওয়ার প্রেক্ষিতে খুলনা ও বাগেরহাটের মধ্যে সংযোগ স্থাপনকারী রূপসা সেতু এবং পদ্মা সেতু নির্মাণে জাপানের সহযোগিতা চান তিনি।’
তিনি বলেন, ‘এসময় জাপানের প্রধানমন্ত্রী রাজী হয়ে জানতে চান প্রথম কোনটা করা হবে।’
যেহেতু রূপসাটা তাড়াতাড়ি হবে, আর পদ্মা খরস্রোতা নদী, এটার সমীক্ষায় সময় লাগবে, ব্রীজ বানাতেও সময় লাগবে, তাই রূপসা সেতুর কথাই আগে বলেন বলে জানান প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জাপান সরকার পদ্মা সেতুর বর্তমান স্থলে ফিজিবিলিটি স্টাডি শেষ করার পর তার সরকার ২০০১ সালে সেখানে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেও পরবর্তী খালেদা জিয়া সরকার সে সেতুর নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেয়।’
তিনি বলেন, ‘দুর্ভাগ্য যে বিএনপি ক্ষমতায় এসে সেটা বন্ধ কওে দেয়। খালেদা জিয়া বলল এখানে সেতু করা যাবে না।’
২০০৮ সালে আওয়ামী লীগ সরকারে আসার পর থেকে এ পর্যন্ত নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতুর নির্মাণ কাজ আল্লাহর রহমতে প্রায় শেষ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
তিনি বলেন, ‘আমি যখনই জাপান গিয়েছি তখন সবসময়ই জাপান সরকার আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। এজন্য বিশেষভাবে আমি জাপান সরকারকে ধন্যবাদ জানাই।’
সর্বশেষ তিনি যখন জাপান সফর করেন, তখন শিনজো আবে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী। যিনি দুহাত খুলেই বাংলাদেশকে সহযোগিতা করেছেন উল্লেখ করে সরকার প্রধান বলেন, ‘তাকে এবং জাপানের বর্তমান প্রধানমন্ত্রীকেও আমি ধন্যবাদ জানাই, তারা সবাই বাংলাদেশের অকৃত্রিম বন্ধু।’
Posted ১১:৩৯ পূর্বাহ্ণ | রবিবার, ২৯ নভেম্বর ২০২০
coxbangla.com | Chanchal Chy