চলতি মাসের প্রথম দিকে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী মার্ক এস্পার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফোন করে প্রতিরক্ষা বাহিনী আধুনিকায়নের প্রস্তাব দেন
কক্সবাংলা ডটকম(২৪ সেপ্টেম্বর) :: যুক্তরাষ্ট্র সাম্প্রতিক সময়ে তার কাছ থেকে আরো বেশি সামরিক সম্ভার কেনার জন্য বাংলাদেশকে প্রলুব্ধ করার চেষ্টা জোরদার করেছে। বাংলাদেশে চীন তার অর্থনৈতিক প্রভাব বাড়াতে থাকায় যুক্তরাষ্ট্র দক্ষিণ এশিয়ার ‘উদীয়মান’ মিত্রটির উপর জয়ী হওয়ার আশা করছে।
বিরল এক উদ্যোগে মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী মার্ক এস্পার চলতি মাসের প্রথম দিকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে (তিনি প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ও তদারকি করেন) ফোন করে ২০৩০ সাল নাগাদ দেশটির সামরিক বাহিনীকে আধুনিকায়নের প্রস্তাব করেন।
দুই দেশ গত বছর অ্যাপাচি হেলিকপ্টার ও ক্ষেপণাস্ত্রের মতো অত্যাধুনিক সামরিক সরঞ্জাম বিক্রি নিয়ে আলোচনা শুরু করে। এ ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করা হয়নি। মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরের উপসহকারী মন্ত্রী লরা স্টোন বলেন, বিষয়টি এখনো কংগ্রেসকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হয়নি। যেকোনো চুক্তি অবশ্যই অপেক্ষাকৃত সস্তা সরঞ্জামের বৃহত্তর সরবরাহকারী চীনকে হতাশ করবে।
সম্প্রতি নিক্কি এশিয়ান রিভিউর এক প্রশ্নের ই-মেইল জবাবে স্টোন বলেন, আমরা বাংলাদেশের সাথে আমাদের নিরাপত্তা সহযোগিতা জোরদারের চেষ্টা করছি। এটি পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট, বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতার প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধার সাথে সম্পর্কিত।
তিনি বলেন, বাংলাদেশে প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম বিক্রির ব্যাপারে আমরা ‘পার্টনার অব চয়েজ’ হিসেবে কাজ করতে প্রস্তুত। উল্লেখ্য, তিনি মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরে দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক ডেস্কে ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, ভুটান ও মালদ্বীপের সাথে সম্পর্কিত বিষয়গুলো তদারক করেন।
বাংলাদেশ ১৯৯০-এর দশক থেকে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে অনেক বেশি অস্ত্র ক্রয় করছে। ২০১৯ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে এই ক্রয়ের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১১০ মিলিয়ন ডলার। তবে স্টকহোম পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউটের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১০ সাল থেকে চীনের কাছ থেকে ২.৫৯ বিলিয়ন ডলারের সামরিক সরঞ্জাম কেনার তুলনায় এটি খুবই কম।
ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির রাজনীতি বিজ্ঞানের ডিস্টিনিঙগুইশড প্রফেসর আলী রীয়াজ বলেন, মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর মধ্যকার ফোন কলের সময়টি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই সময় ঢাকার সাথে বেইজিংয়ের সম্পর্ক উষ্ণ হচ্ছে।
বস্তুত, বাংলাদেশে চীনা প্রভাব বাণিজ্য ও অবকাঠামো বিনিয়োগের ঊর্ধ্বে চলে গেছে। কোভিড-১৯ মহামারী ছড়িয়ে পড়লে চীন মাস্ক ও গাউনের মতো সরঞ্জাম সরবরাহ করে, বাংলাদেশে একটি মেডিক্যাল টিম পাঠায়। এছাড়া চীনা বেসরকারি কোম্পানি সিনোভ্যাক বায়োটেকের উদ্ভাবিত টিকা বাংলাদেশে স্টেজ থ্রি-এর ট্রায়াল চালিয়েছে।
বেইজিং সম্প্রতি বাংলাদেশের ওপর থেকে ৯৭ ভাগ আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করে নিয়েছে। ভারত সীমান্তের কাছে সিলেট নগরীতে ২৫০ মিলিয়ন ডলারের একটি বিমানবন্দর টার্মিনাল নির্মাণের চুক্তি লাভের পর চীন এই ছাড় দেয়।
বাংলাদেশ এখন তিস্তা নদী ব্যবস্থাপনার জন্য চীনের কাছ থেকে এক বিলিয়ন ডলার ঋণ পাওয়ার চেষ্টা করছে। এর আগে ভারতের সাথে কয়েক বছর ধরে এই নদীর পানি বণ্টন নিয়ে সমঝোতার চেষ্টা করে আসছিল বাংলাদেশ। মূলত পশ্চিমবঙ্গের বিরোধিতার কারণে সমঝোতা হতে পারেনি।
ভারত ও চীনের মধ্যে সতর্ক সম্পর্ক রক্ষা করে চলছিল বাংলাদেশ। এর মধ্যেই এখন যুক্তরাষ্ট্র সক্রিয়ভাবে এগিয়ে এলো।
রীয়াজ নিক্কিকে এক ই-মেইলে বলেন, বাংলাদেশ সরকারকে সাংঘর্ষিক প্রত্যাশাগুলোর মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে। যদি জাতীয় স্বার্থ প্রধান বিবেচ্য বিষয় হয়, তবে বাংলাদেশ তা করতে পারবে।
ওয়াশিংটনের বৃহত্তর ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশলের অংশ হলো প্রতিরক্ষা কূটনীতি। ২০১৯ সালের জুনে প্রতিরক্ষা দফতর ওই কৌশল প্রশ্নে তার প্রথম প্রতিবেদনে দক্ষিণ এশিয়ায় শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মালদ্বীপের পাশাপাশি বাংলাদেশকে উদীয়মান অংশীদার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
নিক্কিকে স্টোন বলেন, আমাদের ইন্দো-প্যাসিফিক ভিশনের মূল হলো এই বাস্তবতা যে বাংলাদেশের মতো যুক্তরাষ্ট্রও ইন্দো-প্যাসিফিক দেশ। সব জাতির কল্যাণের লক্ষ্যে অবাধ, উন্মুক্ত, শান্তিপূর্ণ ও সমৃদ্ধ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল নিশ্চিত করার জন্য দক্ষিণ এশিয়ার সামুদ্রিক ও আঞ্চলিক নিরাপত্তা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর এ কারণেই নিরাপত্তা জোরদার করাকে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে।
ওয়াশিংটনভিত্তিক থিঙ্ক ট্যাঙ্ক আটলান্টা কাউন্সিলের সিনিয়র ফেলো হিসেবেও সক্রিয় রীয়াজ বলেন, এই অঞ্চলে চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাব ও চীনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিঙের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভে বাংলাদেশের অংশগ্রহণের ফলে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্দো-প্যাসিফিক এজেন্ডা প্রবলভাবে অনুসরণ করা ওয়াশিংটনের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়েছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই ২০০৫ সালে শুরু হওয়া বিদেশী সামরিক বাহিনী অর্থায়ন পরিকল্পনা আওতায় সন্ত্রাসদমন, শান্তিরক্ষা মিশনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযোগিতার বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। ২০১৮ সাল থেকে বাংলাদেশের সামুদ্রিক নিরাপত্তা ও গুরুত্বপূর্ণ অন্যান্য উদ্বেগ দূর করতে যুক্তরাষ্ট্র অতিরিক্ত ৬০ মিলিয়ন ডলার প্রদান করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক আমিনা মোহসিন জানান, চীনের বিআরআই থেকে বের করে ইন্দো-প্যাসিফিক বলয়ে বাংলাদেশকে নিয়ে যেতে মার্কিন প্রশাসন আগ্রাসী প্রয়াস চালাচ্ছে। তিনি নিক্কিকে বলেন, যুক্তরাষ্ট্র সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অংশীদারিত্ব ও অস্ত্র বিক্রি প্রশ্নে অংশীদারিত্ব চায়।
ঢাকার থিঙ্ক ট্যাঙ্ক বাংলাদেশ এন্টারপ্রাইজ ইনস্টিটিউটের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ও যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবীর বলেন, এটি বাংলাদেশকে কুশলী অবস্থানে ফেলে দিয়েছে। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও চীন উভয়ের বন্ধু বাংলাদেশ। ফলে দেশটির জন্য কাজটি কঠিন হবে।
সরকারি তথ্য অনুযায়ী, ২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে প্রায় ৭ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত উপভোগ করেছে বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্র হলো বাংলাদেশী রফতানি পণ্যের বৃহত্তম গন্তব্য। ১৭ কোটি লোকের দেশটি ২০১৯ সালে চীনের সাথে বাণিজ্য ঘাটতির মুখে পড়েছে ১২ বিলিয়ন ডলার। চীন এখন বাংলাদেশের বৃহত্তম আমদানি উৎস।
রীয়াজ ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে নভেম্বরে জো বাইডেন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে দক্ষিণ এশিয়ার ব্যাপারে মার্কিন নীতি আরো পরিবর্তন হয়ে আরো বেশি সম্পৃক্ততা ঘটবে। তবে তিনি বিশ্বাস করেন যে তা চীনের ক্রমবর্ধমান প্রভাবের সাথে আরো বেশি সমন্বয় সাধনমূলক হবে না।
Source : নিক্কি এশিয়ান রিভিউ
Posted ১:৫২ অপরাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২০
coxbangla.com | Chanchal Chy