কক্সবাংলা ডটকম(২৬ জুলাই) :: যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসনের প্রত্যাশায় ২০১৪ সালে নোয়াখালী থেকে যাত্রা করেন কিশোর সুজন আলম। লাতিন আমেরিকায় তার পথ শুরু হয় বলিভিয়া থেকে। এরপর পেরু, একুয়েডর, কলম্বিয়া ও পানামা হয়ে পৌঁছেন মেক্সিকোয়। এর মধ্যে একুয়েডর ও পানামার রেইনফরেস্টের পুরোটাই তাকে পাড়ি দিতে হয় হেঁটে। ১১টি দেশ পাড়ি দেয়ার পর মেক্সিকো সীমান্ত পার হওয়ার সময় ধরা পড়তে হয় তাকে।
সুজন আলমের মতোই যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন প্রত্যাশায় বাংলাদেশ থেকে পাড়ি জমাচ্ছেন অনেকে। বাংলাদেশ থেকে আকাশপথে তাদের নিয়ে যাওয়া হয় প্রথমে দুবাই, ইস্তাম্বুল অথবা তেহরানে। সেখান থেকে তাদের নেয়া হয় ভেনিজুয়েলা, বলিভিয়া অথবা স্প্যানিশ গায়ানায়। এরপর ব্রাজিল-কলম্বিয়া-পানামা-কোস্টারিকা-নিকারাগুয়া-এল সালভাদর-গুয়াতেমালা হয়ে তাদের পৌঁছে দেয়া হয় মেক্সিকোয়। পরবর্তীতে সুযোগ বুঝে মেক্সিকো সীমান্ত অতিক্রম করে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছার প্রয়াস নেন অভিবাসন প্রত্যাশীরা। গোটা পথ প্রদর্শকের দায়িত্বে থাকে মানব পাচারকারী চক্রের সদস্যরা। খরচ হিসেবে জনপ্রতি আদায় করা হয় ২৫-৩০ হাজার ডলার।
অভিবাসন প্রত্যাশীদের ক্ষেত্রে কখনো কখনো ১০-১২টি দেশ পাড়ি দেয়ার ঘটনাও ঘটে। এ যাত্রাপথের পুরোটাই পাড়ি দিতে হয় সড়কপথে অথবা হেঁটে। দুর্গম ও বিপত্সংকুল পথ পাড়ি দিতে গিয়ে প্রাণও হারান অনেকে। যারা বেঁচে যান, তাদের ঠিকানা হয় ভেনিজুয়েলা, বলিভিয়া, পানামা অথবা মেক্সিকোর মতো লাতিন আমেরিকা অঞ্চলভুক্ত কোনো দেশের বন্দিশালায়। বিশেষ করে মেক্সিকোর কারাগারগুলোয় অবৈধ পথে যাওয়া যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন প্রত্যাশী বাংলাদেশীর সংখ্যা প্রতিনিয়তই বাড়ছে।
ইউএস কাস্টমস অ্যান্ড বর্ডার প্রটেকশন এজেন্সির তথ্য অনুযায়ী, ২০১১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন প্রত্যাশী ১৪৯ জন বাংলাদেশী লাতিন আমেরিকা, বিশেষ করে মেক্সিকোয় আটক হয়েছেন। ২০১২ সালে আটকের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ১৬৭। পরের বছরগুলোয়ও মেক্সিকোর কারাগারগুলোয় যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধ পথে গমনের দায়ে আটক অভিবাসন প্রত্যাশীর সংখ্যা বেড়ে চলেছে। ২০১৩ সালে আটক হয়েছিলেন ৩২৮ জন, ২০১৪ সালে ৬৯০, ২০১৫ সালে ৬৪৮ ও ২০১৬ সালে ৬৯৭ জন। চলতি বছর এখন পর্যন্ত ১২০ জন আটক হওয়ার কথা জানা গেছে। এরা সবাই বর্তমানে মেক্সিকোর কারাগারে বন্দিদশা পার করছেন।
খাত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, অভিবাসন প্রত্যাশীদের যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছে দেয়ার ক্ষেত্রে পাচারকারীরা সাধারণত জনবহুল এলাকা এড়িয়ে মরুভূমি, পাহাড় কিংবা জঙ্গলপথ বেছে নেয়। কারণ এসব স্থানে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারি কম। দুর্গম এসব পথ পাড়ি দিতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেন অনেকেই। কেউ কেউ অসুস্থও হয়ে পড়েন। ১৯৯০ সালের পর থেকে শুধু মেক্সিকোর সীমান্ত এলাকায়ই ছয় হাজারের বেশি মরদেহ উদ্ধার করেছে মার্কিন সীমান্তরক্ষী বাহিনী। এর মধ্যে কতজন বাংলাদেশী, তার সুনির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যানও নেই।
বাংলাদেশীদের ক্ষেত্রে লাতিন আমেরিকা পাড়ি দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের চেষ্টা সংখ্যার দিক দিয়ে তুলনামূলক কম হলেও এরই মধ্যে বিষয়টি বেশ উদ্বেগের কারণ হয়ে উঠেছে বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ও রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) পরিচালক ড. সি আর আবরার।
তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করতে গিয়ে প্রতি বছরই বিভিন্ন সীমান্তে বাংলাদেশীরা ধরা পড়ছেন। কিন্তু বিষয়টি সম্পর্কে সচেতনতা তৈরিতে তেমন কোনো উদ্যোগ নেই। লাতিন আমেরিকার কারাগারগুলোয় যারা বন্দি অবস্থায় রয়েছেন, তাদের ফিরিয়ে আনার বিষয়ে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে। একই সঙ্গে তাদের সঙ্গে কথা বলে দালাল চক্রকে শনাক্ত করতে হবে। না হলে এ ধরনের ভয়ঙ্কর যাত্রা চলতেই থাকবে।
সম্প্রতি স্থানীয় বাংলাদেশ দূতাবাসের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে মেক্সিকোর জাতীয় অভিবাসন সংস্থা আইএনএমের কর্মকর্তারা এক বৈঠকে বসেন। বৈঠকে এ বিষয়ে সে দেশে নিযুক্ত বাংলাদেশ দূতাবাসের কাছে উদ্বেগ প্রকাশ করে আইএনএম। বৈঠকে সংস্থাটির পক্ষ থেকে বলা হয়, সাম্প্রতিক সময়ে দক্ষিণ এশিয়া থেকে মেক্সিকোয় অবৈধ অভিবাসীর সংখ্যা উদ্বেগজনক হারে বেড়েছে। এসব অভিবাসীর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক বাংলাদেশী রয়েছেন, যাদের মূল লক্ষ্য হলো সুযোগ বুঝে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করা।
প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, অবৈধভাবে বিদেশে পাড়ি জমানো অভিবাসন প্রত্যাশীরা আন্তর্জাতিক মানব পাচারকারী চক্রের কবলে পড়ে হয়রানির শিকার হচ্ছেন। সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, অনেক ক্ষেত্রে তারা মৃত্যুর মুখে পতিত হচ্ছেন।
অধিকাংশ ক্ষেত্রেই যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন প্রত্যাশীদের জিম্মি করে মোটা অংকের অর্থ আদায় করা হয়। অর্থ আদায়ের কৌশল হিসেবে অভিবাসন প্রত্যাশী দু-একজনকে হত্যা করে বাকিদের ভয় দেখায় অপরাধী চক্র। মৃত্যুর ভয়ে ভীত হয়ে অনেকেই তাদের স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ করে টাকার সংস্থান করতে বাধ্য হন।
জাতিসংঘের মানবাধিকার-বিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচআইসির সাম্প্রতিক শুনানিতে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ২০১৪ সাল পর্যন্ত বিদেশের বিভিন্ন কারাগারে বন্দি বাংলাদেশী শ্রমিকের সংখ্যা ২৩ হাজার ৩৬৭।
প্রসঙ্গত, স্বাধীনতার অল্প কিছুদিন পর থেকেই বাংলাদেশের মানুষ যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দিতে শুরু করে। শুরুর দিকে রাজনৈতিক আশ্রয়ের পাশাপাশি শিক্ষাগত কারণে কিছু মানুষ যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার সুযোগ পায়। এরপর ১৯৯০ সালের দিকে এসে ডাইভারসিটি ভিসা তথা ডিভি লটারির সূত্র ধরেও অনেক মানুষ দেশটিতে যাওয়ার সুযোগ পান। ডিভি লটারি প্রোগ্রামের আওতায় গ্রিন কার্ড পেয়ে দেশটির নাগরিকত্বও পেয়েছেন অনেকে।
যুক্তরাষ্ট্রের আদমশুমারি অনুযায়ী, ১৯৮০ সালের দিকে দেশটিতে বাংলাদেশী জনসংখ্যা ছিল ৫ হাজার ৮০০। ২০০০ সালের দিকে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৭ হাজার ৪১২ জনে। সর্বশেষ ২০১০ সালে এ সংখ্যা দাঁড়ায় ১ লাখ ৪৭ হাজার ৩০০।
Posted ২:৪২ পূর্বাহ্ণ | বুধবার, ২৬ জুলাই ২০১৭
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta