কক্সবাংলা রিপোর্ট(১৮ অক্টোবর) :: বাংলাদেশে এখন রোহিঙ্গার সংখ্যা কত তা নিয়ে স্থানীয়দের সঙ্গে বিস্তর ফারাক জাতিসংঘের। ইউএনএইচসিআরের মতে ২৪ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশে ৫ লাখ ৮২ হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে।কিন্তু স্থানীয় প্রশাসন, জনপ্রতিনিধি ও এনজিও প্রতিনিধিরা বলছেন, নতুন করে অনুপ্রবেশ করা রোহিঙ্গার সংখ্যা গত সপ্তাহেই ১০ লাখ ছাড়িয়েছে। তাদের যুক্তি হলো, ইউএনএইচসিআর তাঁবু ধরে যে প্রক্রিয়ায় রোহিঙ্গার সংখ্যা নির্ধারণ করছে, বাস্তবতা তার ভিন্ন। রোহিঙ্গাদের একটি অংশ তাঁবুর বাইরে অবস্থান করছে।
বিশেষ করে কক্সবাজারের উখিয়া, টেকনাফ ও নাইক্ষ্যংছড়ির বিভিন্ন স্থানে গভীর অরণ্যেও নিজেদের মতো করে রোহিঙ্গারা বসবাস করছে। সেখানে কোনো জরিপ চালানো হয়নি। এ ছাড়া একটি অংশ কক্সবাজারে আত্মীয়স্বজনদের বাসায়ও উঠেছে। এগুলোও গণনার বাইরে।
জানা গেছে, মিয়ানমার থেকে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীর সংখ্যা এখন ১৫ লাখেরও অধিক। এর মধ্যে প্রায় ৫ লাখ রোহিঙ্গা ১৯৭৮,১৯৯১,২০১২ এবং ২০১৫ সালে থেকে কয়েক ধাপে কক্সবাজারের উখিয়া, টেকনাফ ও নাইক্ষ্যংছড়িতে আশ্রয় নেয়। এরপর কিন্তু ২৪ আগস্ট থেকে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী ‘রোহিঙ্গা নিধন’ অভিযান শুরু করলে ২৫ আগস্ট থেকে স্রোতের মতো বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করতে থাকে বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা।
এদিকে ১৮ অক্টোবর পর্যন্ত নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ১২ হাজার ১৩৬ জনে। বায়োমেট্রিক পদ্ধতিতে রোহিঙ্গাদের নিবন্ধন কার্যক্রমে গতি ফিরে এসেছে। এখন প্রতিদিন সাতটি বুথে গড়ে ১১ হাজার রোহিঙ্গা নারী-পুরুষ-শিশুর নিবন্ধন করা সম্ভব হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা জানান, লজিস্টিক সাপোর্টের অভাবে প্রথমে একটি মাত্র বুথেই কাজ করতে হয়েছে। এ কারণে বেশিসংখ্যক নিবন্ধন সম্ভব হয়নি। এখন সাতটি বুথে কাজ চলবে। কয়েক দিনের মধ্যে মোট ২৫টি বুথে কাজ শুরু হবে। তখন প্রতিদিন অন্তত ৩০ হাজার রোহিঙ্গাকে নিবন্ধনের আওতায় আনা যাবে। শুরুর দিকে নিবন্ধিত হতে রোহিঙ্গারা অনীহা দেখান। নিবন্ধিত হলে নতুন কোনো সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হওয়ার মতো অজানা শঙ্কাও তাদের ভিতর কাজ করেছে। তাছাড়া সরকার নিবন্ধন করে বাংলাদেশ থেকে তাদের বিতাড়ন করবে কিনা, তা নিয়েও কারও কারও মধ্যে ভয় কাজ করছে।
এদিকে রাখাইন থেকে পালিয়ে আসা ৩০ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা উখিয়া উপজেলার আঞ্জুমানপাড়ায় গত তিনদিন ধরে বাংলাদেশে প্রবেশের সুযোগের অপেক্ষায় আছে। ওই এলাকায় আশ্রয়ের স্থান না থাকায় ধানক্ষেতের মাঝখানে ছোট ছোট বাঁধের ওপর তাঁবু টাঙিয়ে তারা মানবেতর জীবনযাপন করছে। অচিরেই তাদের বাংলাদেশে ঢোকার সুযোগ না দিলে খাদ্য ও নিরাপদ পানির অভাবে রোগশোক ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা।
গত ২৫ আগস্ট থেকে শুরু হওয়া রোহিঙ্গা ঢল গত কিছুদিন ধরে কমে আসলেও একদিনে হঠাত্ ৫০ হাজার রোহিঙ্গা উখিয়ার আঞ্জুমানপাড়া দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে। পরে আরো রোহিঙ্গা ঢল নামে। এ সময় বিজিবি তাদের আটকে দিলে রোহিঙ্গারা সীমান্তের জিরো পয়েন্টে অবস্থান নেয়। এরপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ফাঁকি দিয়ে কিছু রোহিঙ্গা উখিয়ার ক্যাম্পগুলোতে চলে আসলেও এখনো ৩০/৩৫ হাজার রোহিঙ্গা সেখানে অবস্থান করছে। সীমান্তের ওই জিরো পয়েন্টে গণমাধ্যমকে যেতে দেয়া হচ্ছে না। তবে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার প্রতিনিধিরা সেখানে ত্রাণ, শুকনো খাবার বিতরণ ও মেডিক্যাল ক্যাম্প করে রোহিঙ্গাদের সেবা দিচ্ছে।
আনজুমানপাড়া মেডিক্যাল ক্যাম্পে চিকিত্সা নিতে আসা কাউয়ারখোপ গ্রামের সোনা আলী (৪৫) জানান, বুচিডং শহরে প্রায় ৩৫টি গ্রামের মধ্যে ১৪টি গ্রাম জনশূন্য হয়ে পড়েছে। রাখাইনের বুচিডংয়ের রইচ্ছংপাড়া থেকে সপরিবারে আসা আশরাফ আলী (৪০) ও তার স্ত্রী আয়েশা বিবি’র (৩৫) সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পালিয়ে আসা অন্যদের মতো তারাও মংডুর সর্বদক্ষিণে নাইক্ষংদিয়ায় অবস্থান করছিল তিন দিন ধরে। বুচিডং এর নাইচাদং, কুমাংচিদং, কোয়াংছিবং, নাগপুরা, চিনদং, কাউয়ারখোপ, লাউদং, নয়াপাড়াসহ ১৪টি গ্রামের প্রায় ৩০ হাজার মানুষ গত সোমবার ভোর রাতে আনজুমানপাড়া শূন্য রেখায় পৌঁছায়।
দেখা গেছে,গত তিনদিন ধরে নাফ নদীর আনজুমানপাড়ার বেড়িবাঁধ, ধানক্ষেত ও চিংড়ি ঘেরে দিনের বেলা রোদে পুড়ছে রোহিঙ্গারা। আবার বুধবার দুপুরের হঠাত্ বৃষ্টিতে তারা অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহায়। তার ওপর এসব দুর্ভোগের ফলে অনেক শিশু ও বৃদ্ধ অসুস্থ হয়ে পড়ছে।
এ ব্যাপারে সেখানে কর্মরত বিজিবি সদস্যদের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করলেও তারা আনুষ্ঠানিক কিছু জানাতে অপারগতা প্রকাশ করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, উখিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগসহ বেশকিছু দাতা সংস্থা ত্রাণ ও চিকিত্সা তত্পরতা অব্যাহত রেখেছে।
সেখানে স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থার একজন প্রতিনিধি বলেন, আগে পরে বাংলাদেশ সরকার এসব রোহিঙ্গাকে ঢুকতে দিবে। সেক্ষেত্রে এখানে তাদের আটকে রেখে অমানবিক পরিস্থিতি তৈরি করলে বাংলাদেশেরই ক্ষতি।
Posted ২:০৮ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৯ অক্টোবর ২০১৭
coxbangla.com | Chanchal Chy