কক্সবাংলা ডটকম(১৫ মে) :: জীবিকার সন্ধানে নরসিংদীর রায়পুরা থেকে রাজধানীতে পাড়ি জমান গৃহকর্মী শিল্পী আক্তার। মাত্র আট মাস আগে সাত সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে তিনি ঢাকায় আসেন। আর্থিক সংকটে পড়ে ১০ হাজার টাকা ভাড়ার বাসা ছেড়ে ১৩ দিন আগে তেজগাঁওয়ের তেজকুনিপাড়ায় মাত্র ৩ হাজার টাকায় একটি টিনশেড ঘরে ওঠেন। এরই মধ্যে ঘটে যায় মর্মান্তিক এক ঘটনা।
নিখোঁজ হওয়ার এক দিন পর, গত মঙ্গলবার ওই বাসা থেকে মাত্র ১০০ মিটার দূরে বিজয় সরণি উড়ালসড়ক সংলগ্ন একটি নালা থেকে উদ্ধার করা হয় শিল্পী আক্তারের পাঁচ বছরের শিশুকন্যা রোজা মনির লাশ। গলায় রশি প্যাঁচানো অবস্থায় বস্তাবন্দি লাশটি দেখে হতবাক হন স্থানীয়রা।
পুলিশের প্রাথমিক তদন্তে জানা গেছে, গরম পানি ঢেলে শরীর ঝলসে দেওয়ার পর শিশুটিকে শ্বাসরোধে হত্যা করা হয় এবং হত্যার আলামত গোপন করতে লাশ ফেলে দেওয়া হয় নালায়। অপহরণ ও নির্মম এই হত্যাকাণ্ডর দুই দিন পার হলেও এখনও শনাক্ত বা গ্রেপ্তার হয়নি রোজার হত্যাকারীরা।
শুধু এই একটি ঘটনা নয়, সম্প্রতি ঘরে-বাইরে নারী ও শিশুর ওপর এমন নৃশংস সহিংসতার (নির্যাতন, অপহরণ, ধর্ষণ ও হত্যা) প্রবণতা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৪ সালের প্রথম চার মাসের তুলনায় ২০২৫ সালের একই সময়ে এসব ঘটনার হার প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে।
সমাজবিজ্ঞানী ও অপরাধ বিশ্লেষকদের মতে, নানা আইন ও নারী-শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ সেল থাকলেও বাস্তবে এর কার্যকারিতা খুবই সীমিত। বিশেষ দিবসে সচেতনতা বাড়ানো হলেও তা স্থায়ী প্রভাব ফেলছে না। তুচ্ছ বিষয়েও মানুষ হিংস্র হয়ে উঠছে। এমনকি সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয় মায়ের কোলও আজ অনেক ক্ষেত্রে রক্ষাকবচ নয়- সন্তান খুন হচ্ছে মায়ের হাতে, আবার বাবা-মা কিংবা ভাই-বোনের ওপর হামলা চালাচ্ছে সন্তান।
সাম্প্রতিক সময়ে একের পর এক নারকীয় সহিংসতার ঘটনা জাতিকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। গত মঙ্গলবার কুষ্টিয়ার হরিশংকরপুরে পারিবারিক কলহে স্ত্রী মেঘলাকে কুপিয়ে হত্যার পর দুই সন্তানকে হত্যাচেষ্টা করেন স্বামী মামুন, পরে নিজেও আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। এর আগে শনিবার কুড়িগ্রামের কাগজিপাড়ায় জমির বিরোধে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে বাবা-মা ও চাচি মিলে ঘুমন্ত স্কুলছাত্রী জান্নাতিকে কুপিয়ে হত্যা করে।
১৮ এপ্রিল গাজীপুরের টঙ্গীতে মা সালেহা বেগম নিজের দুই সন্তান মালিহা (৬) ও আবদুল্লাহকে (৪) বঁটি দিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করেন। ১৮ মার্চ শহীদ জসিম উদ্দীনের কবর জিয়ারত শেষে বাড়ি ফেরার পথে তার কলেজপড়ুয়া কন্যা লামিয়াকে অপহরণ করে দলবদ্ধ ধর্ষণ করে দুর্বৃত্তরা।
বিচার না পাওয়ার হতাশা, সমাজের অবহেলা ও চাপের মুখে তিনি আত্মঘাতী হন। সম্প্রতি মাগুরায় বোনের বাড়িতে বেড়াতে গিয়ে বোনের শ্বশুর ও জামাইয়ের যৌন নির্যাতনে প্রাণ হারায় ৮ বছরের শিশু আছিয়া, যা সারা দেশে তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে।
সমাজবিজ্ঞানী ও অপরাধ বিশেষজ্ঞদের মতে, পারিবারিক ও সামাজিক অশান্তি ক্রমেই বাড়ছে, যা এক পর্যায়ে রূপ নিচ্ছে সহিংসতা ও হত্যাকাণ্ড। এর পেছনে রয়েছে স্বার্থের দ্বন্দ্ব, সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ, পরকীয়া, দারিদ্র্য, বিশ্বাসহীনতা, মাদকাসক্তি, প্রযুক্তির অপব্যবহার, ভোগবিলাসের মোহ ও সামাজিক মূল্যবোধের চরম অবক্ষয়।
অধিকারকর্মীরা বলছেন, আইনি জটিলতা, বিচারপ্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রতা, সামাজিক লজ্জা ও অজ্ঞতার কারণে অনেক ভুক্তভোগী আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাছে যান না। অনেকেই জানেন না কোথায় অভিযোগ জানাতে হবে। অন্যদিকে, দুর্বল তদন্ত ও আইনের ফাঁকফোকরে অনেক অপরাধী দ- থেকে বেঁচে যায়।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, বিচারপ্রক্রিয়ার দ্রুততা, আইনের যথাযথ প্রয়োগ এবং সমতাভিত্তিক নীতি বাস্তবায়নের মাধ্যমেই নারী-শিশুর প্রতি সহিংসতা রোধ সম্ভব। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের বিভিন্ন জরিপেও নারী-শিশু নির্যাতন ও হত্যার ক্রমবর্ধমান চিত্র উঠে এসেছে।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৪ সালে দেশে ২ হাজার ৫২৫ নারী ও কন্যাশিশু নির্যাতনের শিকার হয়। এদের মধ্যে নিহত হয় ৪৫১ নারী ও ৭৭ শিশু। ধর্ষণ ও গণধর্ষণের শিকার হয় ৫১৬ জন, যার মধ্যে ৩৬৭ জন কন্যাশিশু। ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ২৩ জনকে এবং আত্মহত্যা করে ছয়জন।
২০২৪ সালের প্রথম চার মাসে নির্যাতনের শিকার হয় ৮৬৯ জন, যেখানে ২০২৫ সালের একই সময়ে সংখ্যাটি বেড়ে দাঁড়ায় ১ হাজার ১৬৮ জনে। এ সময়ে হত্যাকাণ্ডর শিকার হয় ৬১৮ নারী ও শিশু, ধর্ষিত হয় ৫১৬ জন, ধর্ষণের চেষ্টা করা হয় ১০৬ জনের ওপর, ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় ১০ জনকে এবং আত্মহত্যা করে চারজন। শুধু চলতি মে মাসের প্রথম ১৫ দিনেই নারী-শিশু নির্যাতনের ঘটনা ১৫০ ছাড়িয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান বলছে, ২০২৪ সালের শেষ চার মাসে দেশে নারী-শিশু নির্যাতনের ঘটনা ছিল ৫ হাজার ৭৯৫টি; আর ২০২৫ সালের প্রথম চার মাসে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭ হাজার ১৩টিতে। অর্থাৎ ১ হাজার ২১৮টি বেশি। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এই পরিসংখ্যান বাস্তব চিত্রের তুলনায় অনেক কম, কারণ অধিকাংশ নির্যাতনের ঘটনা প্রকাশই পায় না।
বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সভাপতি ফওজিয়া মোসলেম জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক সময়ে নারী ও কন্যাশিশুর প্রতি সহিংসতা অতীতের তুলনায় অনেক বেশি, অথচ সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কার্যকর পদক্ষেপ নিচ্ছে না, যা অত্যন্ত উদ্বেগজনক। বিচারিক দীর্ঘসূত্রতা এবং অপরাধীদের শাস্তির অনিশ্চয়তাই এই সহিংসতা বাড়ার বড় কারণ।
তিনি বলেন, নারী-শিশুর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্রীয় ও সামাজিক পর্যায়ে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। অপরাধীদের দ্রুত গ্রেপ্তার ও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠা, গণমাধ্যমের দায়িত্বশীল ভূমিকা এবং মব সহিংসতা বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ জরুরি। সেই সঙ্গে সমতাভিত্তিক সমাজ গঠনে রাষ্ট্রবিরোধী অপতৎপরতা প্রতিহত করতে হবে এবং নারীদের অধিক সক্রিয় হয়ে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তুলতে হবে।
Posted ২:০৭ পূর্বাহ্ণ | শুক্রবার, ১৬ মে ২০২৫
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta