কক্সবাংলা ডটকম(১৫ ডিসেম্বর) :: মোরা একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে যুদ্ধ করি/মোরা একটি মুখের হাসির জন্য অস্ত্র ধরি।’ মহান একাত্তরের লাল-সবুজ পতাকা, ছাপান্ন হাজার বর্গমাইল আর সাড়ে সাত কোটি বাঙালির মুখে হাসি ফোটাতে যারা জীবন বাজি রেখে অস্ত্র তুলে নিয়েছিলেন কাঁধে- গত ৪৮ বছরেও সেই বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রকৃত তালিকা হয়নি। প্রশ্নবিদ্ধ বিভিন্ন তালিকা নিয়ে অনেক সময় বিব্রত হতে হয়েছে সরকারকে। অবশেষে বিজয়ের ৪৯তম বর্ষে এসে মুক্তিযোদ্ধার পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রকাশ করতে যাচ্ছে সরকার।
মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র অনুযায়ী, দেশে গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ২ লাখ ৩৫ হাজার। এরপর আর নতুন করে কাউকে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে না। এ নিয়ে বিভ্রান্তির কোনো সুযোগ নেই।
মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, পূর্বঘোষণা অনুযায়ী বিজয় দিবসের আগেই আজ রবিবার বেলা সাড়ে ১১টায় মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রায় ২ লাখ ২৫ হাজার মুক্তিযোদ্ধার নাম ও পরিচয়সহ এই তালিকা প্রকাশ করা হবে।
জানতে চাইলে মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, আগে মুক্তিযুদ্ধের সংজ্ঞা নির্ধারিত না থাকায় অনেকে ভুল তথ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সনদ নিয়েছেন। এখন মুক্তিযুদ্ধের সংজ্ঞা নির্ধারণ করা হয়েছে। প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা যাচাইবাছাই করে আজ নতুন তালিকা প্রকাশ করা হবে। এরপর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকায় নাম অন্তর্ভুক্তির কোনো সুযোগ থাকবে না।
এরআগে গত ১২ সেপ্টেম্বর জাতীয় পার্টির সদস্য রতœা আহমেদের প্রশ্নের জবাবে মুক্তিযুদ্ধবিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক জাতীয় সংসদকে জানান, বর্তমানে দেশে গেজেটভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ২ লাখ ৩৫ হাজার ৪৬৭ জন। সরকারি দলের সদস্য দিদারুল আলমের প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী জানান, দেশে খেতাবপ্রাপ্ত নারী মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দুজন। আর গেজেটভুক্ত নারী মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৩২২ জন।
কেন এই লেজেগোবরে অবস্থা : কারা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে চিহ্নিত হবেন সেটি ১৯৭২ সালের আদেশে অর্ডারে স্পষ্ট রয়েছে। ১৯৭২ সালের অর্ডারের যে ব্যাখ্যা তাতে বলা হয়েছে মুক্তিযোদ্ধা মানে এমন একজন ব্যক্তি যিনি মুক্তিযুদ্ধে নিয়োজিত যেকোনো সংগঠিত দলের (ফোর্স) সদস্য হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন। কেউ যদি মুক্তিযুদ্ধে নিয়োজিত কোনো সংগঠিত দলের সদস্য না হন এবং হয়েও যদি সক্রিয় ভূমিকা না রাখেন তিনি মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞায় পরবেন না।
উল্লেখ্য, মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা সম্পর্কে ১৯৭২ সালের অর্ডারের ইংরেজি ভাষায় যা বলা আছে তা হচ্ছে, ‘ফ্রিডম ফাইটারস (এফএফ) মিনস অ্যানি পারসন হু হ্যাড সারভড অ্যাজ মেম্বার অব অ্যানি ফোর্স এনগেজড ইন দ্য ওয়ার অব লিবারেশন।’
অন্যদিকে ২০০৯ সালের ১৩ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা গণকর্মচারীর অবসরের বয়স বাড়ানোর পর ২০১০ সালের ৭ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের তৎকালীন সচিব মোল্লা ওয়াহেদুজ্জামান একটি পরিপত্র জারি করেন। এতে কারা মুক্তিযোদ্ধা গণকর্মচারী হবেন তার সংজ্ঞা বা চারটি শর্ত দেয়া হয়।
শর্তগুলো হচ্ছে- যারা চাকরিতে প্রবেশের সময় নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে ঘোষণা করেছিলেন অথবা যাদের নাম মুক্তিবার্তায় প্রকাশিত হয়েছিল অথবা মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে যাদের নাম গেজেটে প্রকাশ হয়েছিল অথবা যাদের মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বাক্ষর করা সনদ রয়েছে।
এ চারটির যেকোনো একটি শর্তে মুক্তিযোদ্ধা হওয়ার সুযোগ পান মুক্তিযোদ্ধা গণকর্মচারীরা। যদিও এখন আবার বলা হচ্ছে চাকরিতে প্রবেশের সময় মুক্তিযোদ্ধার কোটা সুবিধা না নিলে এখন তিনি মুক্তিযোদ্ধার সুবিধা পাবেন না। ফলে ১৯৭২ সাল থেকে বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা ও সংখ্যা নির্ধারণে ভিন্নতা রয়েছে। কোনো সংজ্ঞা নির্ধারণেই ’৭২-এর নির্দেশ পুরোপুরি অনুসরণ করা হয়নি। বিশেজ্ঞদের মতে, এটি না করায় মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে তৈরি হয়েছে বিতর্ক।
মুক্তিযুদ্ধের পর সেক্টর কমান্ডার ও সাবসেক্টর কমান্ডারদের প্রকাশনা থেকে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধে নিয়মিত বাহিনীর সংখ্যা ছিল ২৪ হাজার ৮০০ এবং অনিয়মিত বাহিনীর সংখ্যা ছিল ১ লাখ ৭ হাজার। মোট ১ লাখ ৩১ হাজার ৮০০ জন। সেক্টর থেকে পাওয়া (মুক্তিযুদ্ধকালীন সেক্টর বিলুপ্তির পর এসব দলিল ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের প্রশিক্ষণ ও রেকর্ড সংরক্ষণ প্রতিষ্ঠান ইবিআরসিতে স্থানান্তর করা হয়েছে) দলিলে দেখা যায়, মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৭০ হাজার ৮৯৬ জন। বাকি ৬০ হাজার ৯০৪ জনের খোঁজ পাওয়া যায়নি।
অন্যদিকে ১৯৯৮ সালে মুক্তিযোদ্ধা সংসদ কার্যালয়ে সংরক্ষিত লাল বইয়ে ১ লাখ ৫৪ হাজার মুক্তিযোদ্ধার নাম রয়েছে। মুক্তিযোদ্ধা সংসদের ভাষ্য অনুযায়ী, ইবিআরসিতে সংরক্ষিত ৭০ হাজার ৮৯৬ জনের মধ্যে অনেকের নাম এ তালিকায় নেই। ফলে এ তালিকাটিও অসম্পূর্ণ। ১৯৮৮ সালে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মেজর জেনারেল আমিন আহমদ চৌধুরী বীরবিক্রম ইবিআরসিতে রাখা ভারতীয় তালিকায় মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা ৬৯ হাজার ৮৩৩।
১৯৯৪ সালে বিএনপির তালিকা অনুযায়ী, মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা ৮৬ হাজার। আওয়ামী লীগের সময় (১৯৯৬-২০০১) মুক্তিবার্তা (লাল) অনুযায়ী, ১ লাখ ৫৮ হাজার ৪৫২ জন। পরে বিএনপি-জামায়াত ২ লাখ ১০ হাজার ৫৮১ জনকে তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে। ওইসময় গেজেটে তালিকাভুক্ত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা প্রায় ২ লাখ ১৫ হাজার।
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে ৭০ হাজারের বেশি ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা তালিকাভুক্ত হয়েছে বলে অভিযোগ করে। এই অবস্থায় মুক্তিযোদ্ধাদের ষষ্ঠ তালিকার কাজ শুরু করে শেখ হাসিনার সরকার। এসব আবেদন যাচাইবাছাই করতে ৪৭০টি কমিটি গঠন করা হয়। নতুন করে তালিকাভুক্তির জন্য সারাদেশ থেকে মোট আবেদন জমা পড়ে ১ লাখ ৪২ হাজার ৯৫০টি। যাচাইবাছাই কমিটির সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আপিল আবেদন করেন ২৯ হাজার ৩৭২ জন।
এ ব্যাপারে একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা সংগঠনের আহ্বায়ক আবীর আহাদ বলেন, প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা কোনো অবস্থায় দেড় লাখের বেশি হওয়ার কথা নয়। কিন্তু বর্তমানে মুক্তিযোদ্ধার সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৩১ হাজারেরও বেশি। মুক্তিযোদ্ধা বানানোর নামে বাণিজ্য চলছে। তবে দীর্ঘ ৪৮ বছর পর সরকারের এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানিয়েছেন মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক গবেষকরা।
এ ব্যাপারে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির ভোরের কাগজকে বলেন, দেশে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার তালিকা প্রণয়ন জরুরি। তালিকার বাইরে এখনো অনেক মুক্তিযোদ্ধা রয়েছেন। জাতির দায়মুক্তির জন্যই তালিকা প্রয়োজন।
ওয়ার ক্রাইমস ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটির চেয়ারম্যান ডা. এম এ হাসান বলেন, দেশ স্বাধীনের পরপরই বঙ্গবন্ধু তালিকা করেছিলেন। কিন্তু অনেকেই সেখানে নাম অন্তর্ভুক্তি করেননি। হয়ত উদাসীনতা একটা বিষয় ছিল। এ ছাড়া রাষ্ট্রীয় সুবিধা তেমন ছিল না। তাছাড়া একটা যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে স্বাধীনতা প্রাপ্তিটাই অনেক বড় ছিল। আজ দীর্ঘদিন পর মানুষ বুঝতে পারছেন এটি অত্যন্ত গৌরবের। তাই তালিকায় নাম তুলতে চান। তবে তালিকাটা যেন স্বচ্ছ হয় এটিই আমাদের কাম্য।
Posted ৩:২১ পূর্বাহ্ণ | রবিবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৯
coxbangla.com | Chanchal Chy