কক্সবাংলা ডটকম(১৮ মার্চ) :: বৈশ্বিক মহামারি নভেল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে এখন পর্যন্ত মারা গেছেন ৭ হাজার ৮৬২ জন। উৎপত্তিস্থল চীনের হুবেই প্রদেশের উহান থেকে বিশ্বের অন্তত দেড় শতাধিক দেশে ছড়িয়ে পড়েছে এই ভাইরাস। ফলে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ১ লাখ ৯১ হাজার ৬৪৮ জনে। তবে ভাইরাসজনিত রোগে বিশ্ব এই প্রথম মহামারির সম্মুখীন হলো এমন নয়। মহামারির রয়েছে শত বছরের ইতিহাস।
যখন কোনো রোগ বিশ্বের বিরাট অঞ্চলজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে এবং অস্বাভাবিক সংখ্যায় মানুষ আক্রান্ত হয় ও মারা যায় তাকেই মহামারি বলা যেতে পারে। যখনই কোনো নতুন ভাইরাস দেখা দেয়, সাধারণত ওই সময়টাতে বৈশ্বিক মহামারির সৃষ্টি হয়। কেননা এই ভাইরাস খুব সহজেই একজন থেকে অন্যজনের শরীরে সংক্রমণ ঘটায়। আর নতুন হওয়ার কারণ মানুষের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা এ ভাইরাসের বিরুদ্ধে কোনো কাজে আসে না এবং তাৎক্ষণিকভাবে এর চিকিৎসা ব্যবস্থা নিয়ে ধন্দে থাকেন বিজ্ঞানীরা।
১৯১৮ সালে স্প্যানিশ ফ্লু নামক ভাইরাসজনিত রোগে বিশ্বে ৫ কোটি মানুষ প্রাণ হারায়। এর জন্য দায়ী ছিল ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাসের টাইপ এ (টাইপ এ, এইচ১এন১)। আক্রান্তদের অধিকাংশই ছিল ১৫ থেকে ৩৪ বছর বয়সী।
১৯৫৭ সালে সিঙ্গাপুরে দেখা দেয় এশিয়ান ফ্লু। এটির জন্য দায়ী ইনফ্লুয়েঞ্জা ভাইরাস (টাইপ এ, এইচ২এন২)। এ ভাইরাস ওই বছর বিশ্বব্যাপী ১০ থেকে ১৫ লাখ মানুষের মৃত্যু ঘটায়।
১৯৬৮ সালে বিশ্ব দেখে হংকং ফ্লু। এতে হংকংয়েই আক্রান্ত হয় ৫ লাখ মানুষ। পরবর্তীতে তা কভিড-১৯ এর মতোই বিশ্বের অন্যান্য দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ভিয়েতনাম থেকে প্রশিক্ষণ শেষ করে মার্কিন সৈন্যরা এই ভাইরাস দেশে বয়ে নিয়ে যায়। ফলে হাজার হাজার আমেরিকান হংকং ফ্লুতে মারা যায়।
২০০৯ সালে মেক্সিকোতে দেখা দেয় সোয়াইন ফ্লু। এই ভাইরাসে বিশ্বের প্রায় ২ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। পোষাপ্রাণিরাও এতে আক্রান্ত হয়েছিল।
ভাইরাসের মধ্যে এখন পর্যন্ত এইচআইভিকে সবচেয়ে মারাত্মক বলে গণ্য করা হয়। এ ভাইরাসের কারণেই মানুষ এইডস রোগে আক্রান্ত হয়। যার কোনো প্রতিষেধক এখনো আবিষ্কার হয়নি। এজন্য একে মারণব্যধিও বলা হয়। ১৯৮১ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম এইচআইভি আক্রান্তের সন্ধান মেলে। তখন থেকে এখন পর্যন্ত সারা বিশ্বে ৭ কোটি মানুষ এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে এবং মারা গেছে ৩ কোটি ২০ লাখ।
ভ্যাকসিন আবিষ্কারের আগে পোলিও রোগটিও মহামারী সৃষ্টি করেছিল। ১৮৪০ সালে জার্মান অর্থোপেডিক সার্জন জ্যাকব হেইন সর্বপ্রথম পোলিওমাইলিটিজ বা পোলিও চিহ্নিত করেন। পোলিওভাইরাস উপস্থিতি শনাক্ত করেন কার্ল ল্যান্ডস্টেইনার। ঊনিশ শতকের শেষার্ধ্বে ইউরোপ ও পরবর্তীকালে যুক্তরাষ্ট্রে ব্যাপকভাবে পোলিও ছড়িয়ে পড়ে। বিশ শতকে এসে এ রোগটিকে শিশুদের প্রধান ভয়ানক রোগের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। ১৯১০ সালের মধ্যে বিশ্বে নাটকীয়ভাবে পোলিও আক্রান্তদের সংখ্যা বাড়তে থাকে ও মহামারি নিয়মিতভাবে সংঘটিত হয়। বিশেষ করে শহরে গ্রীষ্মকালে এ রোগ দেখা দিতো বেশি। এ রোগে হাজারো শিশু ও কিশোর পক্ষাঘাতগ্রস্ত হতো। অবশেষে ১৯৫০-এর দশকে পোলিও টিকা আবিষ্কার হলে আক্রান্তের সংখ্যা হাজারে একজনে নেমে আসে।
ভারতীয় উপমহাদেশে মহামারি
ভাইরাসজনিত রোগ ছাড়াও ভারতীয় উপমহাদেশ মহামারি এসেছে বহুবার, কেড়েছে কোটি প্রাণ। ১৮১৭-২৪ সাল পর্যন্ত পূর্বভারত বারবার আক্রান্ত হয়েছে কলেরায়। কখনও তীব্র, কখনও মাঝারি রোগের প্রকোপ থেকে গিয়েছে। পূর্ব ভারত থেকে তা ক্রমশ ছড়িয়ে পড়েছিল দক্ষিণপূর্ব এশিয়া এবং সেখান থেকে সুদূর পশ্চিম এশিয়ায়, পূর্ব আফ্রিকা ও ভূমধ্যসাগরীয় উপকূলেও। এই কলেরা দিয়েই প্রথম মহামারি দেখে এশিয়া। এই মহামারিতে কত জন প্রাণ হারিয়েছিলেন, তার সঠিক পরিসংখ্যান আজও মেলেনি। প্লেগ অবশ্য ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ।
১৮২৬ সালে কলেরার প্রাদুর্ভাবেই দ্বিতীয়বার মহামারি দেখা দেয় ভারতে। চলে ১৮৩৭ সাল পর্যন্ত। মারা যায় অগণিত মানুষ।
ভয়াবহ রূপে ১৮৪৬-এ আবার ফিরে আসে কলেরা। তৃতীয় দফায় মহামারি জারি ছিল ১৮৬০, কোথাও কোথাও ১৮৬৩ সাল পর্যন্ত। এই কলেরা-মহামারিকে ধরা হয় উনিশ শতকের ভয়ঙ্করতম মহামারি হিসেবে। ভারতের গাঙ্গেয় বদ্বীপ থেকে কলেরা পৌঁছে গিয়েছিল এশিয়া, ইউরোপ, আফ্রিকা এবং উত্তর আমেরিকাতেও। ১৮৫৪ সালে শুধু গ্রেট ব্রিটেনেই প্রাণ হারিয়েছিলেন ২৩ হাজার মানুষ।
চতুর্থ দফার কলেরা মহামারি পৃথিবীতে স্থায়ী হয়েছিল ১৮৬৩ থেকে ১৮৭৫ সাল পর্যন্ত। পঞ্চম দফায় কলেরা-মহামারি ভারতে শুরু হয়েছিল ১৮৮১ সালে। তারপর তা ছড়িয়ে পড়েছিল এশিয়ার অন্য অংশ, ইউরোপ এবং দক্ষিণ আমেরিকায়।
ষষ্ঠ কলেরা-মহামারি দেখা দিয়েছিল ১৮৯৯ সালে। সপ্তম কলেরা-মহামারি শুরু হয়েছিল ১৯৬১ সালে। এবার আর ভারত নয়- কলেরার উৎস ছিল ইন্দোনেশিয়া। সেখান থেকে তৎকলীন পূর্ব পাকিস্তান (আজকের বাংলাদেশ) হয়ে রোগের জীবাণু প্রবেশ করে ভারতে।
গত দু’শ বছরে মোট সাতবার কলেরা মহামারিতে আক্রান্ত হয়েছে ভারত-সহ গোটা বিশ্ব। ১৮১৭ থেকে ১৮৬০ সাল অবধি কলেরা-মহামারিতে ভারতে প্রাণ হারিয়েছেন দেড় কোটিরও বেশি মানুষ। ১৮৬৫ থেকে ১৯১৭ অবধি এই পরিসংখ্যান ছিল ২ কোটি ৩০ লাখ।
কলেরার পাশাপাশি আরও একটি রোগের লাগামছাড়া প্রকোপ দেখা যেত অতীতে, তা হলো প্লেগ। ১৮৯৬ সালে তৎকালীন বোম্বাই শহরে দেখা দিয়েছিল প্লেগের মহামারি।
১৯৭৪ সালে ভারতে দেখা দেয় বসন্তরোগের মহামারি। সে বছর জানুয়ারি থেকে মে মাস অবধি ১৫ হাজারের বেশি মানুষ গুটিবসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, পাঁচ মাসে ভারতে গুটিবসন্ত রোগে আক্রান্ত হয়েছিলেন ৬১ হাজার ৪৮২ জন। প্রাণে রক্ষা পেলেও অনেকে এই রোগের জেরে হারিয়েছিলেন দৃষ্টিশক্তি।
২০০৯ সালে ফ্লু-এর মহামারি দেখা দেয় ভারতজুড়ে। গত কয়েক বছরে সোয়াইন ফ্লু-সহ বিভিন্ন ধরনের ইনফ্লুয়েঞ্জায় দেশটিতে প্রাণ হারান প্রায় কয়েক হাজার মানুষ।
সূত্র: বিবিসি
Posted ১১:০১ অপরাহ্ণ | বুধবার, ১৮ মার্চ ২০২০
coxbangla.com | Chanchal Chy