কক্সবাংলা রিপোর্ট(২৮ অক্টোবর) :: দেশের অন্যতম প্রধান পর্যটন কেন্দ্র কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে পর্যটকদের ভিড় যেমন বাড়ছে, তেমনই ঘটছে অঘটন। কখনও সমুদ্রে তলিয়ে মৃত্যু, আবার কখনও জেট স্কি বা টিউব থেকে ছিটকে পড়েও মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে।
মৃত্যুর পাশাপাশি প্রতিনিয়ত সমুদ্রে তলিয়ে নিখোঁজ হয়ে যাওয়ার ঘটনাও ঘটে চলেছে।
কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের পাশাপাশি ইদানিংকালে সমুদ্রে তলিয়ে গিয়ে মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে উখিয়ার ইনানী, এমনকি টেকনাফ সৈকতেও । যা রীতিমতো ভয় ধরাচ্ছে পর্যটক ও স্থানীয়দের মধ্যে।
সমুদ্র সৈকতে পরপর ঘটে যাওয়া এই সমস্ত ঘটনায় চিন্তিত পর্যটন ব্যবসায়ী ও প্রশাসন। নজরদারি থাকা সত্ত্বেও কী ভাবে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। যদিও সৈকতে পরপর দুর্ঘটনার জন্য অতিরিক্ত ভিড়কে দায়ী করেছেন সংশ্লিষ্ঠরা।
চলতি অক্টোবর মাস কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত যেন ‘মৃত্যুপুরী’ ! বিশেষ করে কলাতলী থেকে সুগন্ধা হয়ে লাবণী পয়েন্ট পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার সমুদ্র সৈকতগুলিতে গোসলে নেমে তলিয়ে মৃত্যুর ঘটনা ক্রমশই বাড়ছে। সমুদ্রে পর্যটকদের বেপরোয়া মনোভাবকে এই মৃত্যুর জন্য অনেকাংশে দায়ী বলে মনে করছেন স্থানীয় পর্যটন ব্যবসায়ী থেকে বীচ ম্যানেজমেন্টের কর্তারা।
লাইফ গার্ড সূত্র জানায়, গত ২৬ অক্টোবর দুপুর ১২টার দিকে কক্সবাজার সৈকতের সিগাল পয়েন্টে গোসল করতে নেমে ঢেউয়ে ডুবে কক্সবাজার সদরের পিএমখালী এলাকার মাহমুদ (১৭) নামে এক কিশোরের মৃত্যু হয়।
এর পাঁচদিন আগে গত ২১ অক্টোবর দুপুর ১২টার দিকে কক্সবাজার সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টে দ্রুতগতির জলযান জেট স্কি থেকে ছিটকে পড়ে বরিশালের উজিরপুর থেকে বেড়াতে আসা পর্যটক আল মামুন হাওলাদার (৩২) এক যুবকের মৃত্যূ হয়।
একদিন আগে ২০ অক্টোবর বিকেলের দিকে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতের কলাতলী পয়েন্টে সাগরে গোসল করতে নেমে সায়মন (২০) নামে উখিয়া উপজেলার পালংখালী এলাকার এক যুবক প্রাণ হারায়।
এর চারদিন পর গত ২৬ অক্টোবর দুপুর ১২টার দিকে কক্সবাজার সৈকতের সিগাল পয়েন্টে গোসল করতে নেমে ঢেউয়ে ডুবে কক্সবাজার সদরের পিএমখালী এলাকার মাহমুদ (১৭) নামে এক কিশোরের মৃত্যু হয়।
চলতি মাসের ৭ অক্টোবর সকাল ৯টার দিকে কক্সবাজার সৈকতের শৈবাল পয়েন্টে গোসল করতে নেমে মোহাম্মদ আসমাইন(১৩) নামে এক কিশোর সাগরে ভেসে গিয়ে মারা যায়।
এছাড়া গত ২০ সেপ্টেম্বর বিকেলে উখিয়ার ইনানী সৈকতে সাগরে গোসলে করতে নেমে ঢাকার বংশাল থানার ১২/৮ বিকে গাঙ্গুলি এলাকার নাফি শাহরিয়ার (৩০) নামে এক পর্যটক ভেসে যায়।এসময় স্ত্রীকে উদ্ধার করা গেলেও শাহরিয়ার নিখোঁজ হন। বিকেল ৫টার দিকে ইনানীর হোটেল হোয়াইট কিচেনের সামনের সৈকতে নিখোঁজ পর্যটকের মরদেহটি ভেসে আসে।
এভাবেই একের পর এক পর্যটকের প্রাণ নিয়েছে সমুদ্র। গত একমাসে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে গোসলে নেমে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। চলতি বছরের গত ৫ মাসে প্রাণ গেছে ১২ জনের। আর গত ৬ বছরে সমুদ্রসৈকতে ৫২ জনের প্রাণহানি হয়েছে। এ সময় সাত শতাধিক মানুষকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করা হয়েছে।
জানা যায়,প্রতিবছর জুন থেকে অক্টোবর মাস পর্যন্ত বঙ্গোপসাগর উত্তাল থাকে। নিম্নচাপ এবং পূর্ণিমা-আমাবস্যার জেরে ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে সমুদ্র। ফলে এই সময়টা দুর্ঘটনার প্রবণতা বেশি থাকে। সমুদ্রে যেমন ভিড়ের মধ্যেই পর্যটকরা গোসলে নেমে তলিয়ে যান, তেমনি উল্টোদিকে লাইফ গার্ড ও পুলিশি নজরদারি এড়িয়ে ফাঁকা জায়গায় গোসল করতে গিয়েও দুর্ঘটনা ঘটছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা গেছে, পর্যটকদের অনেকেই অসতর্ক অবস্থায় সমুদ্রে নামছেন। ফলে তাঁদেরই কারও কারও পরিণতি হয় মর্মান্তিক।
ঢাকা থেকে আসা পর্যটকরা জানান, কক্সবাজার সমুদ্র সৈকতে পর্যটকেরা আসেন আমোদ প্রমোদের জন্য। সেই আমোদ প্রমোদের মাত্রা বেড়ে গেলেই ঘটছে দুর্ঘটনা। তাই দুর্ঘটনা ঠেকাতে প্রশাসনকে কড়া হতে হবে এবং নজদারি বাড়াতে হবে বলেও পর্যটকদের একাংশের দাবি।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক হোটেল ব্যবসায়ী কক্সবাংলাকে জানান,পর্যটকরা নেশা অবস্থায় সমুদ্রস্নানে নামার কারণে দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ বলে মনে করছেন। যাঁরা কক্সবাজার বেড়াতে আসেন তাদের একটি অংশ বিভিন্ন ধরনের নেশায় মেতে ওঠেন। অতিরিক্ত নেশার জন্যই সাগরে দুর্ঘটনাগুলি ঘটছে। ট্যূরিস্ট পুলিশ ও প্রশাসনের আরও কড়া নজদারির ব্যবস্থা করা হলে অনেকটায় দুর্ঘটনা কমবে বলে মনে করি।
সি সেফ লাইফগার্ডের সুপারভাইজার সিফাত সাইফুল্লাহ বলেন, বৈরী পরিবেশের কারণে সাগরের কয়েকটি স্থানে গুপ্ত খাল ও বড় বড় গর্তের সৃষ্টি হয়েছে। ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে গোসলে নামতে নিষেধ করে লাল নিশানা উড়ানো হচ্ছে। গোসলে নামার আগে পর্যটকদের সেদিকে নজর দেওয়া উচিত। বালুচরে একাধিক চৌকি স্থাপন করে, তার ওপর বসে দুরবিনের মাধ্যমে গোসলে নামা পর্যটকদের নজরদারি করা হচ্ছে। কেউ স্রোতের টানে ভেসে যেতে চাইলে চৌকি থেকে নিচে থাকা লাইফগার্ডদের জানানো হয়।
তবে লাইফ গার্ড এর এক কর্মী জানান,সমুদ্র গোসলে নামতে বাধা দেওয়া হলে হুমকি সহ বিভিন্ন ধরনের কথা বলতে থাকে। তবে পর্যটকেরা যাতে সমস্যায় না পড়ে, তার জন্য তাঁরা নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সমুদ্রে ঝাঁপ দিয়ে পর্যটকদের উদ্ধার করার চেষ্টা করেন বলেও জানান তিনি।
ফেডারেশন অব ট্যুরিজম ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অফ বাংলাদেশের সাধারণ সম্পাদক আবুল কাশেম সিকদার কক্সবাংলাকে বলেন, ট্যুরিস্ট পুলিশ ও বীচ ম্যনেজমেন্ট এ বিষয়ে যথেষ্ট তৎপর রয়েছে। পর্যটকদের অনেকে অবস্থায় সাগরে গোসলে নেমে বেপরোয়া হয়ে বিপদ ডেকে আনছেন। পুলিশ কিংবা লাইফগার্ডের পক্ষে তো সবার পিছনে নজরদারি সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে সাগরে গোসলে নামা পর্যটকদের নিজেদেরই সচেতন হতে হবে।
Posted ১:৪৬ অপরাহ্ণ | সোমবার, ২৮ অক্টোবর ২০২৪
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta