কক্সবাংলা ডটকম(১৫ ডিসেম্বর) :: সরকারের হিসাবে দেশে ইউরিয়া ও নন-ইউরিয়া সারের পর্যাপ্ত মজুত আছে। কিন্তু চলমান ভরা মৌসুমে কৃষক চাহিদা মতো নন-ইউরিয়া সার পাচ্ছেন না। তবে বেশি দামে সার মিলছে। কেজিতে ৫ টাকা থেকে ১৫ টাকা বেশি নেয়া হয়। আবার কখনো সার পাওয়া যাচ্ছে না।
কৃষকদের অভিযোগ, একশ্রেণির অসাধু ডিলার সিন্ডিকেট করে সারের মজুত গড়ে তুলে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে ফায়দা লুটছে।
সরকারের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারাও অসাধু ডিলারদের কারসাজির কথা স্বীকার করেছেন। সরকারও কৃত্রিম সংকট নিরসনে অসাধু ডিলারদের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাসহ কঠোর ব্যবস্থা নিচ্ছে। কিন্তু তারপরও থেমে নেই ডিলারদের কারসাজি।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (সার ব্যবস্থাপনা ও উপকরণ) আহমেদ ফয়সাল ইমাম বলেন, চাহিদা অনুযায়ী সারাদেশে সার বরাদ্দ করা আছে এবং প্রতি মাসের বরাদ্দ অনুযায়ী সরবরাহ করা হচ্ছে। সারের কোনো সংকট নেই। এ মৌসুমে কোনো সংকটও হবে না। উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই।
তিনি বলেন, সব সময়ই কিছু অসাধু ডিলার কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে। ডিলারদের মাধ্যমে যেহেতু সার বিক্রি করা হয়, সেহেতু তারা ‘দুষ্টুমিটা’ করে। আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি।
জেলা প্রশাসকদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তারা ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করছেন, অসাধু ডিলারদের জরিমানা করছেন, শাস্তি দিচ্ছেন। কৃষি বিভাগের কোনো কর্মকর্তার যদি গাফেলতি থাকে তাদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে বলেও জানান অতিরিক্তি সচিব।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) সার ব্যবস্থাপনা বিভাগের কয়েকজন কর্মকর্তা বলেন, সারের কোনো ঘাটতি নেই। তবে ডিলাররা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে দাম বেশি নিচ্ছে স্বীকার করলেও এ বিষয়ে তাদের কিছু করণীয় নেই বলে দাবি করেন।
সরকার চলতি মৌসুমে প্রায় ৫০ লাখ ৭০ হাজার হেক্টর জমিতে ২ কোটি ২৬ লাখ মেট্রিক টন বোরো ধান উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। পাশাপাশি আলু চাষসহ শীতকালীন সবজি ও ফসল চাষের ভর মৌসুম চলছে। চলতি মৌসুমে মার্চ পর্যন্ত ইউরিয়া সারের মোট চাহিদা ১৬ লাখ ৪৮ হাজার ৭০১ মেট্রিক টন। এছাড়া টিএসপি ৪ লাখ ৬৬ হাজার ২৭৯ মেট্রিক টন, ডিএপি ৯ লাখ ৬৮ হাজার ৭৭৭ মেট্রিক টন এবং এমওপি ৫ লাখ ৫৬ হাজার ৮৪৬ মেট্রিক টন নির্ধারণ করেছে কৃষি মন্ত্রণালয়।
কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, দেশে এখন ৬ লাখ ৮১ হাজার টন ইউরিয়া, ১ লাখ ২৫ হাজার টন ট্রিপল সুপার ফসফেট (টিএসপি), ২ লাখ ২৮ হাজার টন ডাই-অ্যামোনিয়াম ফসফেট (ডিএপি) এবং ২ লাখ ৪৮ হাজার টন মিউরেট অফ পটাশ (এমওপি) মজুত রয়েছে।
কৃষি মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, এর মধ্যে চলতি ডিসেম্বরে বরাদ্দ করা রয়েছে টিএসপি ৯৩ হাজার ৬৪৬ টন, এমওপি ১ লাখ ২৮ হাজার ৭৯৫ টন এবং ডিএপি ১ লাখ ৮৩ হাজার ২৫৬ টন।
এছাড়া বেসরকারিভাবে টিএসপি ৩২ হাজার ৩৫০ টন, এমওপি ২৯ হাজার টন এবং ডিএপি ৮০ হাজার ২০০ টন বরাদ্দ রয়েছে বলে বিএডিসি সূত্রে জানা গেছে। পাশাপাশি সার বিদেশ থেকে আমদানি করা হচ্ছে, যা পাইপ লাইনে রয়েছে। কিন্তু এত সার মজুত থাকার পরও দেশের বিভিন্ন এলাকায় বিশেষ করে নন-ইউরিয়া সারের সংকট চলছে। কিছু প্রভাবশালী
অসাধু ডিলার ও ব্যবসায়ী সার লুকিয়ে রেখে সংকট তৈরি করছেন। আবার কেউ কেউ সরাসরি গেুদামে সারের মজুত রেখেও দাবি করছেন, সার নেই। তারা বলছেন, সার সরবরাহ কম পাচ্ছেন। তবে মধ্যস্বত্বভোগীরা সুযোগ নিয়ে বেশি দাম নিয়ে কৃষকদের কাছে সার বিক্রি করছে। এই পরিস্থিতিতে কৃষকরা অসহায় ও দিশাহারা হয়ে পড়েছেন। বেশি দামে সার কিনলে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাবে। ফলে ফষল চাষে নিরুৎসাহিত হতে পারেন কৃষকরা।
সরকার নির্ধারিত টিএসপি সারের কেজি ২৭ টাকা, এমওপি ২০টাকা এবং ডিএপি টাকা হলেও কেজিতে ৫ থেকে ১৫ টাকা বেশি নেয়া হচ্ছে। ১ হাজার ৩৫০ টাকার টিএসপি সারের বস্তা কিনতে বাধ্য হচ্ছেন ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার টাকায়।
গাইবান্ধা সদরের বল্লমঝাড় ইউনিয়নের তালুকমন্দুয়ার গ্রামের কৃষক জাহাঙ্গীর আলম জানান, টিএসপি প্রতি বস্তা ১ হাজার ৩৫০ টাকার স্থলে ২ হাজার ২০ টাকা, এমওপি বা পটাশ ১ হাজার টাকার স্থলে ১ হাজার ১২০ টাকা এবং ডিএপি ১ হাজার ৫০ টাকার স্থলে ১ হাজার ১৫০ টাকা দরে কিনতে হয়েছে। সাদুল্লাপুর উপজেলার হবিবুল্লাপুর গ্রামের বর্গাচাষি মঞ্জু মোল্লা জানান, সাদুল্লাপুর বাজার থেকে ৩২ টাকা দরে টিএসপি ও ২২ টাকা দরে পটাশ সার কিনেছেন।
জাতীয় কৃষক সমিতির সাদুল্লাপুর উপজেলার সভাপতি কামরুল ইসলাম জানান, সার কিনতে গেলে ডিলার ও খুচরা বিক্রেতারা সংকটের কথা বলেন। তবে দাম বেশি দিলেই সার পাওয়া যায়। কিছু কিছু ডিলার মূল্য তালিকা টাঙিয়ে রাখলেও সেই অনুযায়ী বিক্রি করছেন না। বিক্রেতারা কৃষককে বিক্রয় রসিদ দিচ্ছেন, কিন্তু বাড়তি দাম রসিদে লিখছেন না। প্রতিবাদ করলে সার বিক্রি করবেন না বলে সাফ জানিয়ে দেন।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে গাইবান্ধা বিএসডিসির এক সার ডিলার জানান, আমন ধান কাটার পর কৃষকরা এক সঙ্গে বিভিন্ন রবি শস্যের চাষ শুরু করেন। এ কারণে অন্য সময়ের চেয়ে নন ইউরিয়া সার টিএসপি, পটাশ ও ডিএপি সারের চাহিদা বাড়ে। কিন্তু বরাদ্দ স্বাভাবিক সময়ের মতো অর্থাৎ অন্য মাসের মতোই দেয়া হয়। এ কারণে এই সংকট। বিসিআইসির এক সার ডিলার জানান, চাহিদার চেয়ে সরবরাহ কম। তাছাড়া গত নভেম্বর মাসের সার অনেক ডিলারকে সরবরাহ করা হয়নি। এই কারণে সংকট সৃষ্টি হয়েছে।
জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার কৃষকদের অভিযোগ, সারের ডিলাররা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে সরকারের নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে চড়া দামে সার বিক্রি করছে। টিএসপি সারের সংকট এতটাই প্রকট- অনেক কৃষক দিনের পর দিন ডিলারের কাছে ঘুরেও নির্ধারিত মূল্যে সার পাচ্ছেন না। ১ হাজার ৩৫০ টাকার টিএসপি সারের বস্তা কিনতে বাধ্য হচ্ছেন ১ হাজার ৮০০ থেকে ২ হাজার টাকায়।
নীলফামারীর ডিমলার কৃষকরা অভিযোগ করেছেন, ডিলাররা তাদের কাছে সার বিক্রি না করে অতিরিক্ত দামে খুচরা বিক্রেতাদের কাছে বিক্রি করছেন। পরে সেই সার খুচরা বিক্রেতাদের কাছ থেকে তাদের বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। এর পরও চাহিদামতো সার পাচ্ছেন না তারা। ডিলার ও খুচরা সার বিক্রেতারা দোকানে মূল্য তালিকা টাঙ্গিয়ে রাখলেও সে অনুযায়ী বিক্রি করছেন না তারা।
প্রতি বস্তা সার সরকারি মূল্যের চেয়ে প্রকারান্তরে ২০০ থেকে ৩০০ টাকা বেশি দরে বিক্রি করছেন। কৃষক সার কিনতে গেলে ডিলার ও খুচরা বিক্রেতারা সংকটের কথা বলেন। তবে দাম বেশি দিলেই সার পাওয়া যাচ্ছে। বাইশপুকুর গ্রামের কৃষক মোত্তালেব হোসেন অভিযোগ করেন, ডিলাররা রাতে চুপিসারে খুচরা বিক্রেতাদের কাছে সার সরবরাহ করেন। তাদের কাছে বলছেন, সার নেই। উপজেলা প্রশাসনের নজরদারির অভাবে এ অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে।
দিনাজপুরের চিরিরবন্দর উপজেলার কৃষক আমিনুল হক বলেন, ডিলারের কাছে গেলে তারা বলে সার নেই। অথচ গুদামে সার মজুত আছে। বেশি দামে বিক্রির জন্য ইচ্ছাকৃতভাবে সংকট তৈরি করা হচ্ছে।
হাকিমপুর উপজেলার কৃষি অফিসার আরজেনা বেগম বলেন, কিছু অসাধু ব্যবসায়ী ইচ্ছাকৃতভাবে সারের মজুত রেখে বাজারে সংকট তৈরি করছেন। আমরা অভিযান চালিয়ে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছি।
ঠাকুরগাঁওয়ের রাণীশংকৈল উপজেলার কৃষক আকরাম হোসেন বলেন, প্রতি বস্তা টিএসপি ২০০ টাকা বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। এতে গম ও আলু চাষে খরচ বাড়ছে। লাভের আশায় চাষ করতে গিয়ে আমরা ক্ষতির মুখে পড়ছেন।
বালিয়াডাঙ্গি উপজেলার ব্যবসায়ী মতলেবুর রহমান দাবি করেন, সরকার থেকে সরবরাহ কম হওয়ায় কৃষকদের চাহিদা অনুযায়ী সার দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। বেশি দামে বিক্রির অভিযোগ সঠিক নয়।
Posted ২:০৭ পূর্বাহ্ণ | রবিবার, ১৫ ডিসেম্বর ২০২৪
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta