কক্সবাংলা ডটকম(৭ এপ্রিল) :: গত রোববার রাতেও সব ঠিকঠাক ছিল। সবুজ ধানগাছে আধাপাকা শীষ কোরক মেলেছে; আর পক্ষকাল পরেই পাকা ধান ঘরে তোলার স্বপ্ন দেখেছিলেন কৃষক। কিন্তু সেই রাতে প্রচণ্ড ঝড়ের সঙ্গে গরম বাতাস সবকিছু ওলটপালট করে দিয়ে গেছে। সোমবার সকাল থেকে ধানগাছের সবুজ পাতা ও শীষ বিবর্ণ হতে হতে গত মঙ্গলবার সেগুলো দেখা যায় একেবারে সাদা। আচমকা এমন অবস্থা দেখে দিশেহারা কৃষক।
ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার তারুন্দিয়া ইউনিয়নের বৃপাঁচাশি গ্রামের পঁচাশি বছর বয়সী চাষি আব্দুল মান্নান গতকাল নিজের জমিতে দাঁড়িয়ে বলছিলেন- ‘এমন দৃশ্য আমার এই জন্মেও দেখিনি। বাপ-দাদার কাছ থেকেও কখনও শুনিনি। শুনেছি মানুষের গায়ে কুবাতাস লাগে। ধানেও যে এমনটা হয় কখনও ভাবিনি। সব ধান চিটা হয়ে গেছে। এই কুবাতাস আমাকে সর্বস্বান্ত করে দিয়ে গেল।’ ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা ও কিশোরগঞ্জ- এ তিন জেলার বিভিন্ন উপজেলায় অন্তত ৫০ হাজার হেক্টর জমির বোরো ধান এভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) বিজ্ঞানীরা মাঠপর্যায়ে কাজ শুরু করেছেন। কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক গতকাল ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে খোঁজ-খবর নিয়েছেন এবং প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।
ময়মনসিংহের ১৩ উপজেলার মধ্যে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ত্রিশাল। এ উপজেলার রামপুর ইউনিয়নের দরিল্যা মধ্যপাড়া গ্রামের বাছির উদ্দিন নিজের ও বর্গা নিয়ে এক একর জমিতে ধানচাষ করেছিলেন। ভালো ফলনে তার চোখেমুখে ছিল প্রশান্তির ছাপ। গতকাল ভোরে ক্ষেতের কাছে গিয়ে দেখেন সব ধান চিটা হয়ে গেছে। তিনি চোখের পানি ফেলতে ফেলতে বাড়ি ফেরেন। বাছিরের মতো স্বপ্নভঙ্গ হয়েছে উপজেলার দুই সহস্রাধিক কৃষকের।
ঈশ্বরগঞ্জের তারুন্দিয়া ইউনিয়নের শ্রিপুরজিথর গ্রামের বর্গাচাষি শহীদুল ইসলাম ১০ কাঠা জমিতে বোরো ধানের চাষ করেছিলেন ২২ হাজার টাকা দাদন নিয়ে। গতকাল মাঠে গিয়ে দেখেন তার সব ধান সাদা। এ দেখে মাঠেই কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
কিশোরগঞ্জের ইটনা উপজেলার রাজী গ্রামের কৃষক আতাউর রহমান বলেন, ‘আর মাত্র ১০-১৫ দিন পর ধান কাটার কথা ছিল। কিন্তু গরম বাতাসে ধান সব নষ্ট হয়ে গেছে। এখন কী করব বুঝতে পারছি না!’ উত্তর রাজী গ্রামের বুদু মিয়া জমিতে দাঁড়িয়ে কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘১৪ কাঠা জমিতে ধান লাগাইছিলাম, রোববার ও সোমবার গরম বাতাসে আমার সব শেষ করে দিছে। এখন ধান কাটার আর ইচ্ছা নাই।’
কটিয়াদী উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, চলতি বোরো মৌসুমে উপজেলায় ১২ হাজার ৮৫০ হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছে। উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছিল ৫১ হাজার ৪০০ টন। আচমকা বয়ে যাওয়া গরম বাতাসে বোরো ফসল নষ্ট হয়ে যাওয়ায় লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ব্যাহত হবে।
উপজেলার চান্দপুর ইউনিয়নের পাঁচপাড়া গ্রামের বর্গাচাষি মুছলিম ও কুড়েরপাড় গ্রামের প্রান্তিক চাষি আবুল খায়ের জানান, তারা সাড়ে আট বিঘা জমিতে বোরো আবাদ করেছেন। এখন আর নূ্যনতম ফসল ঘরে তোলার সম্ভাবনা নেই। চান্দপুর ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মাহতাব উদ্দিন জানান, তার ইউনিয়নের কৃষকদের মধ্যে হতাশা দেখা দিয়েছে। বেশিরভাগ জমির ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। তবে জমির মাঝখানে যেখানে বাতাস একটু কম লেগেছে, সেখানে কিছু ধান ভালো আছে।
করগাঁও ইউপি চেয়ারম্যান শরাফত লস্কর পারভেজ জানান, তার ইউনিয়নটি হাওর অধ্যুষিত। এক ফসলি বোরোই কৃষকের একমাত্র ভরসা। হঠাৎ বিপর্যয়ে কৃষকরা দিশেহারা হয়ে পড়েছেন।
ময়মনসিংহের ১৩ উপাজেলায় দুই হাজার ৬৩০ হেক্টর জমির ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে নিশ্চিত হয়েছে কৃষি বিভাগ। তবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশি বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। নেত্রকোনা জেলার হাওরাঞ্চল হিসেবে খ্যাত খালিয়াজুরী, মদন ও মোহনগঞ্জ উপজেলায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। হাওরের ৪৪ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয়েছিল। এর মধ্যে হাওরসহ নেত্রকোনা জেলায় ২১ হাজার ৬৭৭ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়েছে। কিশোরগঞ্জের সদর, ইটনা, করিমগঞ্জ, হোসেনপুর, তাড়াইল, কটিয়াদী, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম, কুলিয়ারচর ও বাজিতপুর উপজেলায় ২৫ হাজার হেক্টর জমির ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে তথ্য দিয়েছে কৃষি বিভাগ। তবে সুনামগঞ্জে ক্ষতি হয়েছে কম। জেলার শাল্লা উপজেলায় ২০ হেক্টর জমির ধান নষ্ট হয়েছে বলে জানিয়েছেন কৃষি সম্প্রসারণ দপ্তরের উপপরিচালক ফরিদুল হাসান। কৃষি বিভাগ বলছে- হিট ইনজুরি ও ঝড়ো হাওয়ার ফলে পরাগায়ন ব্যাহত হয়েছে। ফ্লাওয়ারিং টু মিল্ক্কিং স্টেজ ঠিকমতো সম্পন্ন হতে পারেনি। ফ্লাওয়ারিং মুহূর্তে ৩০ ডিগ্রির ওপরের তাপমাত্রা সহ্য করতে না পারায় ধানগুলো চিটা হয়ে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে যেসব জমি ভালো আছে, সেগুলোতে সব সময় পানি ধরে রাখতে কৃষকদের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
ব্রির উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. তাহমিদ হোসেন আনছারি বলেছেন, বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বলছে লু হাওয়ার মতো বয়ে গেছে। হঠাৎ করে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার কারণে যে ফ্লাওয়ারগুলোর মুখ বের হয়েছে বা বের হওয়ার পর্যায়ে ছিল, সেগুলোর পরাগায়ন সঠিকভাবে হয়নি। সে কারণে ধানগুলো চিটা হয়ে গেছে। কোথাও কোথাও কালো আবার কোথাও ধানের শীষ সাদা হয়ে যাওয়ার খবরও তারা পেয়েছেন। তিনি বলেন, লু হাওয়া বা হঠাৎ তাপমাত্রা বাড়া-কমার বিষয়ে তেমন কিছু করার থাকবে না। বিক্ষিপ্তভাবে কিছু জায়গায় এমনটা হলেও সার্বিকভাবে এর প্রভাব পড়বে না। তারা এ নিয়ে মাঠে কাজ করছেন। পরে আনুষ্ঠানিকভাবে বিস্তারিত জানানো হবে।
কিশোরগঞ্জ-৪ (ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম) আসনের সংসদ সদস্য রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক বলেছেন, ‘আমি কৃষি বিভাগকে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা তৈরির নির্দেশ দিয়েছি। তালিকা হাতে পেলে সহায়তা চেয়ে মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হবে।’
কিশোরগঞ্জ জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ ছাইফুল ইসলাম বলেন, জেলার ১৩ উপজেলায় ২৫ হাজার হেক্টর বোরো জমি আক্রান্ত হয়েছে। কয়েকদিনের মধ্যে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানিয়ে মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন পাঠানো হবে।
ময়মনসিংহ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. মতিউজ্জামান বলেন, গরম বাতাসের কারণে ফসলের মাঠ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এটি প্রাকৃতিক দুর্যোগ। বিজ্ঞানীরা পরামর্শ দিয়েছেন মাঠে পানি ধরে রাখতে। আবার অনেকে কিছু ট্রিটমেন্টের কথাও বলেছেন। ক্ষতির মাত্রা নির্ধারণ করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানো হবে।
Posted ৩:৪৯ পূর্বাহ্ণ | বুধবার, ০৭ এপ্রিল ২০২১
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta