কক্সবাংলা ডটকম(৭ নভেম্বর) :: মার্কিন নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে থেকে গোটা বিশ্ব। এই নির্বাচনের উপর বিশ্বরাজনীতির অনেক হিসেব নিকেশ নির্ভর করে। অনেক দেশের অর্থনীতি, পররাষ্ট্রনীতি পরিবর্তিত হয় এই নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছে এ নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ নির্বাচনের ওপর আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর ভাগ্য অনেকখানি নির্ভর করে। কাজেই মার্কিন নির্বাচন কেবল ওই দেশের একজন নতুন রাষ্ট্রপতি বা সিনেটর কংগ্রেসম্যান করার নির্বাচন নয়, এ নির্বাচন পুরো বিশ্বের গতিপ্রকৃতির নির্ধারণ করার অন্যতম নিয়ামক নির্বাচন। আর এই নির্বাচনে এখন মোটামুটি স্পষ্ট হয়ে গেছে যে,জো বাইডেনই হচ্ছেন পরবর্তী মার্কিন প্রেসিডেন্ট।
কুটনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, শেষ পর্যন্ত যদি বাইডেন বিজয়ী হন, তাহলে বাংলাদেশে কোন কোন ব্যাপারে ক্ষতি হতে পারে। বিশেষ করে ডোনাল্ড ট্রাম্পের যে কূটনীতি সেটি ছিল মধ্যপ্রাচ্য উত্তর কোরিয়া, ইরান কেন্দ্রিক। তিনি এই উপমহাদেশ এর দিকে খুব একটা নাক গলাতে না। আর ডেমোক্রেটরা অনেক বেশি উপমহাদেশ কেন্দ্রিক কূটনীতিতে মনোযোগী। আর এই কূটনৈতিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া বাংলাদেশের কিছু কিছু বিষয়ে ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে বলে কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন।
অন্যদিকে জো বাইডেন যদি মার্কিন প্রেসিডেন্ট হন, তাহলে বাংলাদেশের কি হবে? এই নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে কূটনৈতিক অঙ্গনে। এখন নয় নির্বাচনের শুরু থেকেই এ নিয়ে কূটনৈতিক মহলে নানা রকম আলোচনা হচ্ছে। যদিও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মোমেন বলেছেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যেই জিতুকনা কেন তাতে বাংলাদেশের সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের কোনো ব্যত্যয় ঘটবে না। একই কথা বলেছেন প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক উপদেষ্টা ড.গওহর রিজভী।
কূটনীতিকদের সাথে আলাপ করে দেখা গেছে, জো বাইডেন যদি শেষ পর্যন্ত জয়ী হন তাহলে বাংলাদেশের জন্য বেশকিছু ইতিবাচক ঘটনা ঘটবে। বাংলাদেশ সুনির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে লাভবান হবে। যে বিসমস্ত ক্ষেত্রে বাংলাদেশ লাভবান হবে, তার মধ্যে রয়েছে:-
১। ভিসা সহজ হবে:
ডোনাল্ড ট্রাম্পের চার বছরের শাসনামলে বাংলাদেশসহ কিছু দেশের জন্য ভিসা করাকরি করা হয়েছিল। ভিসা প্রদানের হার ছিল অত্যন্ত কম। আবার বারাক ওবামার সময় বাংলাদেশের ভিসাব্যবস্থা সহজীকরণ করা হয়েছিল। ঐতিহাসিক ভাবে ডেমোক্রেটরা যেহেতু অনেক বেশি উদারনৈতিক তারা বাংলাদেশের মত দেশ গুলোর ব্যাপারে ভিসা সহজীকরণ করে। বাইডেন যদি বিজয়ী হয় তাহলে বাংলাদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জন্য ভিসা সহজীকরণ হবে এটা নিশ্চিত।ৎ
২। অভিবাসী প্রত্যাশীরা লাভবান হবেন:
বাংলাদেশের অনেক অভিবাসি প্রত্যাশী অপেক্ষামান রয়েছে। ডোনাল্ড ট্রাম্প ইমিগ্রেন ভিসা একরকম বন্ধই রেখেছেন। আর জো বাইডেন আসার পর ইমিগ্রন্ট ভিসা পুনরায় চালু করবেন বলে, অঙ্গীকার করেছেন। এটার ফলে বাংলাদেশে অনেক মানুষ উপকৃত হবেন, বাংলাদেশ লাভবান হবেন। অবৈধভাবে বসবাসকারীরা লাভবান হবেন। প্রচুর বাংলাদেশের নাগরিক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধভাবে বসবাস করছেন। তাদের ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে, তারা সেখানে অবস্থান করছেন, কাজকর্ম করছেন। তাদেরকে আইনগতভাবে বৈধতা দেয়ার কোনো উদ্যোগ ট্রাম্প সরকার নেয়নি। তবে ডেমোক্রাটরা এ ব্যাপারে অনেক উদার। তাই ডেমোক্রেটরা বিজয়ী হলে অবৈধ ভাবে থাকা এসব নাগরিকদের বৈধতার পাওয়ার ক্ষেত্রে অনেক সুবিধা হবে বলে তাঁরা মনে করছেন। এর ফলে বাংলাদেশ লাভবান হবে।
৪। শিক্ষার্থীদের সুযোগ বাড়বে:
বাংলাদেশের প্রচুর শিক্ষার্থী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে উচ্চশিক্ষার জন্য যায়। কিন্তু সেই উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রেও ট্রাম্প কড়াকড়ি আরোপ করেছিল। এখন জো বাইডেন বিজয়ী হলে শিক্ষার্থীদের জন্য সুযোগটা প্রসারিত হবে। যেটা বারাক ওবামার দুই মেয়াদে হয়েছিল।
৫। পরিবর্তিত পররাষ্ট্রনীতিতে লাভ হবে বাংলাদেশের:
জো বাইডেনের পররাষ্ট্র নীতি আর ডোনাল্ড ট্রাম্পের পররাষ্ট্র নীতি বলতে গেলে দুই মেরুতে। আর পরিবর্তিত পররাষ্ট্র নীতির কারণে জো বাইডেন বিজয়ী হলে ট্রাম্পের যে নীতি সে নীতি থেকে সরে আসবেন। তিনি ইতিমধ্যে ঘোষণাও দিয়েছেন জলবায়ু পরিবর্তনের প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়ন করবেন। আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করবেন। আর এর ফলে পরোক্ষ ভাবে লাভবান হবে বাংলাদেশ। কারণ বাংলাদেশে জলবায়ুতে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষে আছে বাংলাদেশ। তাছাড়া জাতিসংঘ, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে প্রতিষ্ঠানগুলোতে যদি জো বাইডেন বিজয়ী হন তাহলে এই সংস্থাগুলোর প্রতি মার্কিন অনীহা কমবে। ফলে পরোক্ষভাবে বাংলাদেশ লাভবান হবে। এছাড়াও এই বিজয়ের ফলে দুই দেশের বাণিজ্য সম্প্রসারণসহ বিভিন্ন বিষয় লাভবান হতে পারে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের কিছু কিছু বিষয়ে ক্ষতির সম্ভাবনা রয়েছে বলে কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন। আর এই ক্ষতিগুলোর মধ্যে যে ক্ষতিগুলো শিকার বাংলাদেশ হতে পারেন বলে কূটনৈতিক মহল মনে করছেন; তার মধ্যে:-
১। অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ:
দেখা গেছে যে, ডেমোক্র্যাটরা যখন ক্ষমতায় থাকেন তখন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করে। রাষ্ট্রদূতদের দৌড় ঝাপ বাড়ে। তারা বাংলাদেশের মানবাধিকার, গণতন্ত্র ইত্যাদি বিষয়ে অযাচিত কথাবার্তা বলেন। ডেমোক্র্যাটদের সঙ্গে যেহেতু প্রবাসী বাংলাদেশীদের সম্পর্ক খুব বেশি। সে জন্য সহজেই বাংলাদেশের ইস্যুগুলোকে সিনেট কংগ্রেসের রাষ্ট্রপতি পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া যায়। সেটা ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময় ছিল না বললেই চলে।
২। ভারত নির্ভরতা বাড়বে:
বাংলাদেশের ব্যাপারে জো বাইডেন ভারত নির্ভরতা অবশ্যই বাড়বে। কারণ তার রানিংমেট কমলা হ্যারিস ভারতীয় বংশোদ্ভূত। এর ফলে বাংলাদেশের মার্কিন নীতি পুরোপুরি ভারত নির্ভর হয়ে পড়বে। চীনের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে বাংলাদেশে হয়তো নতুন চাপে পড়তে পারে।
৩। সুশীলদের প্রভাব বাড়বে:
জো বাইডেন এবং ডেমোক্র্যাটরা ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশের সুশীলদের ক্ষমতা বাড়বে। বিশেষ করে বাংলাদেশের সুশীলদের একটা বড় অংশের সঙ্গে ডেমোক্র্যাটদের সুসম্পর্কের কথা জানা যায়। তারা বাংলাদেশের বিভিন্ন অভ্যন্তরীণ ব্যাপার মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের পৌঁছে দেয়ার জন্য প্রাণান্ত চেষ্টা করবেন। আগে তারা যেমন সহজে সুযোগ পেতেন না, এখন এ ধরনের অভিযোগ করার সুযোগ তাদের বেড়ে যাবে।
৪। ইসরায়েল ইস্যুতে চাপ বাড়বে:
ডোনাল্ড ট্রাম্প এবং জো বাইডেনের পররাষ্ট্রনীতির মধ্যে অনেক অমিল থাকলেও একটি বিষয় তারা মোটামুটি ঐক্যমতে আছেন। সেটা হলো ইসরায়েলকে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে ডোনাল্ড ট্রাম্পকে যে কূটনীতি শুরু করেছিলেন সেটাকে জো বাইডেন এগিয়ে যাবে বলেই ধারণা করা হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে যেহেতু ডেমোক্র্যাটদের নজর উপমহাদেশের উপর বেশি থাকে, সেজন্য বাংলাদেশের ওপর ইসরাইলকে স্বীকৃতি দেওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশের ওপর চাপ বাড়তে পারে।
৫। বাণিজ্য সূচক কমতে পারে:
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় বাজার হলো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি রপ্তানি করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে। আর এই কোটা সুবিধা বাতিল করার পরেও বাংলাদেশ এখনো মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পোশাক রপ্তানীসহ অন্যন্য রপ্তানীর ক্ষেত্রে ভালো অবস্থানে আছে। কিন্তু ডেমোক্র্যাটরা ক্ষমতায় এলে যেমন ট্রাম্পের আগ্রাসী দিকগুলো থেকে তারা সরে আসবে। ফলে গার্মেন্টসহ অন্যান্য ক্ষেত্রে চীন আরো বেশি সুযোগ পাবে। কমলা হ্যারিস থাকার কারণে ভারতের পণ্যের বাজার প্রসারিত হবে। এর ফলে বাংলাদেশী পণ্যের বাজার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সংকুচিত হওয়ার আশঙ্কা করছেন কেউ কেউ। এই সব ক্ষতিগুলোকে পুষিয়ে নেয়ার জন্য বাংলাদেশে প্রথম থেকেই কুটনৈতিক তৎপরতার প্রয়োজন হবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা।
Posted ২:১৭ পূর্বাহ্ণ | শনিবার, ০৭ নভেম্বর ২০২০
coxbangla.com | Chanchal Chy