কক্সবাংলা রিপোট(৫ আগস্ট) :: কক্সবাজারের টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কে বহুল অলোচিত সেনাবাহিনীর মেজর (অবঃ) সিনহা মোঃ রাশেদ খান হত্যার বিচার চেয়ে টেকনাফের সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে একটি হত্য মামলা দায়ের করেছে সিনহার পরিবার।
৫ আগস্ট বুধবার সকাল সাড়ে ১১ টার দিকে টেকনাফের বাহারছরা পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের প্রত্যাহারকৃত পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে প্রধান আসামি ও টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ সহ ৯ জনকে আসামী করে এ মামলাটি আদালতে ফাইল করা হয়।
মেজর (অবঃ) সিনহা মোঃ রাশেদ খানের বড়বোন শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস বাদী হয়ে এ মামলাটি দায়ের করেন।
মামলাটি বিজ্ঞ বিচারক সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট(সদর) তামান্না ফারাহ্ (ভারপ্রাপ্ত এজলাসে বসলে মামলাটি গ্রহন করে র্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ান(র্যাব-১৫) কে তদন্তের দায়িত্ব দেন। মামলার প্রধান কৌশলী সিনিয়র আইনজীবী এডভোকেট মোহাম্মদ মোস্তফা জানান, এসআই লিয়াকতকে প্রধান আসামী ও ওসি প্রদীপ কুমার দাশসহ ৯জনকে আসামী করা হয়েছে। বিজ্ঞ আদালত মামলাটি এজাহার হিসেবে গ্রহণ করে র্যাব-১৫কে তদন্তের দায়িত্ব দিয়েছেন। ৭ দিনের মধ্যে রিপোর্ট প্রদান করতে বলা হয়েছে।
আদালত সুত্রে জানা গেছে, দণ্ডবিধির ৩০২, ২০১, ৩৪ ধারায় দায়ের করা এই মামলায় প্রধান আসামি করা হয়েছে বাহারছড়া পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ ও পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত আলীকে। তাঁর বাড়ি চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার পূর্ব হুলাইন গ্রামে। দুই নম্বর আসামি হয়েছেন টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশ। মামলার অপর সাত আসামি হলেন থানার এসআই দুলাল রক্ষিত, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন, আব্দুল্লাহ আল মামুন, এএসআই লিটন মিয়া, এসআই টুটুল ও কনস্টেবল মো. মোস্তফা।
মামলার প্রধান সাক্ষী করা হয়েছে নিহত সিনহার সঙ্গে থাকা সাহেদুল ইসলাম ওরফে সিফাতকে। তাঁর বাড়ি বরগুনার পূর্ব শফিপুর গ্রামে।
মামলার এজাহারে বলা হয়, ৩১ জুলাই বিকেলে মেজর (অব) সিনহা মোহাম্মদ রাশেদ খান সঙ্গী সাহেদুল ইসলাম ওরফে সিফাতকে নিয়ে কক্সবাজারের হিমছড়ি নীলিমা রিসোর্ট থেকে তথ্যচিত্রের ভিডিওচিত্র ধারণের জন্য টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের পাহাড়ে যান। এ সময় সিনহার পরনে ছিল কমব্যাট গেঞ্জি, কমব্যাট ট্রাউজার ও ডেজার্ট বুট। তথ্যচিত্রের ভিডিওচিত্র ধারণ করার উদ্দেশ্যেই এই পোশাক তিনি পরেছিলেন।
এজাহারের ভাষ্যমতে, রাত আটটা পর্যন্ত পাহাড়ে ছিলেন সিনহা ও সিফাত। তাঁরা পাহাড়ে দিনের ও সন্ধ্যাকালের দৃশ্য ধারণ করেন। রাত ৯টা ২৫ মিনিটের দিকে নিজস্ব প্রাইভেটকারে শামলাপুর তল্লাশিচৌকিতে পৌঁছালে পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত আলীসহ আসামিরা গাড়িটির গতিরোধ করেন। এ সময় সিনহা নিজেকে অবসরপ্রাপ্ত সেনা কর্মকর্তা হিসেবে পরিচয় দেন। তখন আসামিরা সিফাতকে গাড়ির সামনের বাঁ দিকের দরজা খুলে টেনেহিঁচড়ে বের করে নিয়ে যান। এ সময় সিফাত দুই হাত ওপরে তুলে নিজের এবং গাড়িতে বসা সিনহার পরিচয় দেন। এতে আসামিরা আরও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। তাঁরা চালকের আসনে বসে থাকা সিনহাকে অকথ্য ভাষায় গালমন্দ করেন।
এ পর্যায়ে সিনহা গাড়ি থেকে নেমে দুই হাত ওপরে তুলে বারবার নিজের পরিচয় দিতে থাকেন। কিন্তু সিনহাকে উদ্দেশ্য করে আরও গালমন্দ শুরু করেন মামলার প্রধান আসামি লিয়াকত আলী। তিনি বলতে থাকেন, ‘তোর মতো বহুত মেজরকে আমি দেখছি। এইবার খেলা দেখামু।’ এরপর লিয়াকত আলী টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ কুমার দাশকে ফোন দিয়ে সলাপরামর্শ করতে থাকেন। একপর্যায়ে লিয়াকত আলী ফোনে ওসি প্রদীপকে বলতে থাকেন, ‘ঠিক আছে, শালারে শেষ কইরা দিতাছি।’ এরপর কিছু বুঝে ওঠার আগেই লিয়াকত আলী সম্পূর্ণ ঠান্ডা মাথায় পূর্বপরিকল্পিতভাবে মেজর (অব.) সিনহার শরীরে কয়েকটি গুলি করেন। গুলির আঘাতে সিনহা রক্তাক্ত অবস্থায় মাটিতে পড়ে যান। নিজের জীবন রক্ষার্থে তিনি ঘটনাস্থল থেকে উঠে পালানোর চেষ্টা করেন। তখন অন্য আসামিরা তাঁকে চেপে ধরে পুনরায় মাটিতে ফেলে দেন।
এ সময় সিনহার মৃত্যু নিশ্চিত করতে আরও একটি গুলি করেন লিয়াকত আলী। পরে ঘটনাস্থলে আসেন ওসি প্রদীপ। তিনি গুলিবিদ্ধ অবস্থায় মাটিতে পড়ে থাকা সিনহার শরীর ও মুখে কয়েকবার লাথি মেরে মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত হন। এ ছাড়া নিজের বুট দিয়ে ঘষা মেরে সিনহার মুখমণ্ডল বিকৃত করার চেষ্টা করতে থাকেন। এ সময় মামলার সাক্ষীদের ও ঘটনাস্থলের আশপাশের লোকজনকে আসামিরা অস্ত্র উঁচিয়ে হত্যার হুমকি দিয়ে ঘটনাস্থল থেকে তাড়িয়ে দেন। রাত ১টা ৪৫ মিনিটের দিকে সিনহাকে কক্সবাজার সদর হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাঁকে মৃত ঘোষণা করেন।
মামলার বাদী শারমিন শাহরিয়ার ফেরদৌস আদালত থেকে বেরিয়ে বলেন, ‘ওসি প্রদীপ কুমার দাশের নির্দেশনা মতে পরিদর্শক লিয়াকত ঠান্ডা মাথায় গুলি করে আমার ভাইকে হত্যা করেছে।’ তিনি আরো বলেন, পরে আমার ভাইয়ের শরীরে ও মুখে বিভিন্ন জায়গায় পা দিয়ে লাথি মেরে তার মুখ বিকৃত করার চেষ্টা করে। এসময় অন্যান্য আসামিরা তাদের সহযোগিতা করে। তাই তিনি আইনের আশ্রয় নিচ্ছেন বলে জানান।
তিনি আরও বলেন,সিনহা মোঃ রাশেদ খান হত্যার বিচার চেয়ে তিনি এ মামলাটি করেছেন।এ জন্য আদালতের কাছে র্যাব-১৫ কে তদন্তভার দেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন।তিনি আরও বলেন,ঘটনার দিন টেকনাফ থানার ওসি প্রদীপ তাদের ফোন করে সিনহার খোঁজখবর নিলেও মৃত্যূর খবরটি গোপন রাখেন। তিনি আশা করেন আদালতের মাধ্যমে ছোট ভাই সিনহা হত্যার সুবিচার তার পরিবার পাবে।
এ সময় আইনজীবীর পাশে ছিলেন মামলার বাদী শারমিন শাহরিয়াসহ নিহতের পরিবারের অন্য সদস্যরা। তাঁদের সঙ্গে ছিলেন ঢাকা থেকে আসা হাইকোর্টের আইনজীবী আনোয়ারুল কবিরও। অবশ্য, তাঁদের কেউই সাংবাদিকদের সঙ্গে কোনো কথা বলেননি।
জানা যায়,মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান গত ৩১ জুলাই রাত ৯টার দিকে কক্সবাজার-টেকনাফ মেরিন ড্রাইভ সড়কে পুলিশের গুলিতে নিহত হন। টেকনাফের শামলাপুর অঞ্চলে পাহাড়ি এলাকায় ডকুমেন্টারি ফিল্মের শুটিং শেষে তিনি নিজ গাড়িতে সঙ্গীসহ পুলিশ চেকপোস্ট অতিক্রম করার সময় এই ঘটনা ঘটে।
সরকারের একটি সংস্থার তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, গাড়ি থেকে হাত উঁচু করে নামার পরপরই বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের ইনচার্জ পরিদর্শক লিয়াকত আলী তাঁকে লক্ষ্য করে তিন রাউন্ড গুলি করেন। লিয়াকত কোনো কথাবার্তা না বলেই মেজর (অব.) সিনহাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোড়েন।
রাজধানীর সামরিক কবরস্থানে গত সোমবার সামরিক মর্যাদায় সিনহার দাফন সম্পন্ন হয়। ঘটনার পরপরই বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের সব কর্মকর্তা ও সদস্যকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।
চাঞ্চল্যকর এই ঘটনায় প্রথমে কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে আহ্বায়ক করে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। পরে তা পরিবর্তন করে চট্টগ্রাম বিভাগের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (উন্নয়ন) মোহাম্মদ মিজানুর রহমানকে আহ্বায়ক করে চার সদস্যের আরেকটি কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অন্য তিন সদস্য হলেন পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি (ক্রাইম ও অপারেশন) মো. জাকির হোসেন, কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. শাজাহান আলী ও রামুর ১০ পদাতিক ডিভিশনের জিওসি মনোনীত প্রতিনিধি লে. কর্নেল সাজ্জাদ। কমিটি গতকালই কাজ শুরু করেছে।
মেজর (অব.) সিনহা রাশেদ খান ২০১৮ সালে সেনাবাহিনী থেকে স্বেচ্ছায় অবসরগ্রহণ করেন। সেনাবাহিনীতে থাকাকালে তিনি স্পেশাল সিকিউরিটি ফোর্সের (এসএসএফ) সদস্য ছিলেন। তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের সাবেক উপসচিব প্রয়াত মো. এরশাদ খানের ছেলে। তিনি রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ থেকে ২০০২ সালে এইচএসসি পাস করেন।
জানা যায়, মেজর (অব.) সিনহা ‘জাস্ট গো’ নামে একটি ইউটিউব চ্যানেলের জন্য একটি ট্রাভেল ভিডিও তৈরির জন্য গত ৩ জুলাই ঢাকা থেকে কক্সবাজারে যান। তাঁর সঙ্গে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া বিভাগের তিনজন শিক্ষার্থীও যান। তাঁরা প্রায় এক মাস ধরে কক্সবাজারের বিভিন্ন স্থানে শুটিং সম্পন্ন করেন। গত ৩১ জুলাই সঙ্গী ক্যামেরাম্যান সিফাতকে নিয়ে তিনি শামলাপুর অঞ্চলের পাহাড়ি এলাকায় যান। ওই সময় সিনহা রাশেদ ফুলহাতা কম্ব্যাট গেঞ্জি, কম্ব্যাট ট্রাউজার ও ডেজার্ট বুট পরিহিত ছিলেন। শুটিং শেষে রাত সাড়ে ৮টার দিকে তাঁরা দুজন পাহাড় থেকে নামার সময় দু-তিনজন স্থানীয় ব্যক্তি তাঁদের দেখে ডাকাত সন্দেহে পুলিশকে অবহিত করে।
জানা যায়, সিফাতকে নিয়ে মেজর (অব.) সিনহা পাহাড় থেকে নেমে নিজস্ব প্রাইভেট কারযোগে মেরিন ড্রাইভ হয়ে কক্সবাজারের উদ্দেশে রওনা হন। শামলাপুরের পূর্বে বিজিবি চেকপোস্টে তাঁদের তল্লাশি করার জন্য থামানো হয় এবং পরিচয়প্রাপ্তির পর ছেড়ে দেওয়া হয়। এদিকে ডাকাত আসছে খবর পেয়ে এসআই লিয়াকত ফোর্স নিয়ে অপেক্ষায় ছিলেন। রাত ৯টার দিকে শামলাপুর পুলিশ চেকপোস্টে আসার পর তিনি সিনহার গাড়ি থামান। মেজর (অব.) সিনহা গাড়ি থামিয়ে পরিচয় দিলে প্রথমে তাঁদের গাড়ি থেকে নামতে বলা হয়। সিফাত হাত উঁচু করে গাড়ি থেকে নেমে পেছনের দিকে যান। মেজর (অব.) সিনহা গাড়ি থেকে হাত উঁচু করে নামার পরপরই পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকত তাঁকে লক্ষ্য করে তিন রাউন্ড গুলি করেন।
দায়িত্বশীল একটি সূত্রে জানা যায়, লিয়াকত কোনো কথাবার্তা না বলে গাড়ি থেকে নামার পরপরই মেজর (অব.) সিনহাকে লক্ষ্য করে গুলি করেন এবং সিফাতকে আটক করে বাহারছড়া তদন্ত কেন্দ্রে নিয়ে যান।
এই হত্যাকাণ্ডের পর গত শনিবার বিকেলে সেনাবাহিনীর একটি তদন্তদল ঘটনাস্থলে যায়। এ সময় স্থানীয় লামারবাজার মসজিদ ও হেফজখানার ইমাম, মুয়াজ্জিন ও দুজন হাফেজ বলেন, ‘এটি ছিল একটি নির্মম ঘটনা। মেজর (অব.) সিনহাকে কোনো কথা বলতে না দিয়েই পরিদর্শক লিয়াকত অশ্রাব্য ভাষায় গালি দিয়ে তাঁর বুকে গুলি চালিয়ে দেন।’
এদিকে টেকনাফ থানার উপপরিদর্শক নন্দদুলাল রক্ষিত বাদী হয়ে গত ৩১ জুলাই রাতে সংঘটিত ঘটনার বিষয়ে দুটি মামলা দায়ের করেছেন। একটি মামলায় পুলিশের সঙ্গে নিহত মেজর (অব.) সিনহা ও তাঁর সঙ্গী সাহেদুল ইসলাম সিফাতের কথিত বন্দুকযুদ্ধের বিবরণ রয়েছে। বলা হয়েছে, সেই বন্দুকযুদ্ধেই মেজর (অব.) সিনহা নিহত হন। মামলার একমাত্র আসামি সিফাত। মামলায় পুলিশ পরিদর্শক লিয়াকতসহ তাঁর সদস্যদের সরকারি কাজে বাধা দেওয়ার অভিযোগে পুলিশ অ্যাসল্টেরও অভিযোগ আনা হয়েছে।
অপর মামলাটিতে মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের ধারা উল্লেখ করে ৫০ পিস ইয়াবা ও বেশ কিছু পরিমাণ গাঁজা উদ্ধার দেখানো হয়েছে। তবে এসব বিষয়ে পুলিশের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।
Posted ১:০৫ অপরাহ্ণ | বুধবার, ০৫ আগস্ট ২০২০
coxbangla.com | Chanchal Chy