কক্সবাংলা ডটকম(৮ আগস্ট) :: রাষ্ট্রপক্ষের ব্যর্থতায় রাজধানীর পুরান ঢাকায় পথচারী বিশ্বজিৎ দাস হত্যা মামলায় নিম্ন আদালত ও হাইকোর্টের রায় সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়নি। আলোচিত ও নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডের ভিডিও ফুটেজ থাকলেও লাশের সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে প্রকৃত ঘটনা উঠে আসেনি। আইনজ্ঞদের মতে, এসব কারণে নিম্ন আদালতের রায়ের সঙ্গে হাইকোর্টের রায়ে বৈপরীত্য ঘটেছে, যার জন্য অবশ্যই রাষ্ট্রপক্ষ দায়ী।
সোমবার একান্ত আলাপে আইনজ্ঞরা বলেন, শুধু ভিডিও ফুটেজের ভিত্তিতে আদালতের রায় দেওয়ার সুযোগ নেই। হত্যা মামলায় আদালতকে রায় দিতে হয় লাশের সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদন এবং এর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ সাক্ষী ও অন্যান্য উপাদানের ওপর ভিত্তি করে।
হাইকোর্ট এসব ক্ষেত্রে অসঙ্গতি পাওয়ার কারণেই সুরতহাল প্রতিবেদন প্রস্তুতকারী এসআই জাহিদুল ইসলাম ও ময়নাতদন্ত প্রস্তুতকারী সলিমুল্লাহ মেডিকেলের ফরেনসিক বিভাগের চিকিৎসক মাকসুদুর রহমানের বিরুদ্ধে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন।
তাদের বিরুদ্ধে তদন্তে গাফিলতি পাওয়া গেলে এবং হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হলে আপিল বিভাগ অবশ্যই ‘কমপ্লিট জাস্টিস’ করবেন। ন্যায়বিচারের জন্য ওই পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। অবশ্য রাষ্ট্রপক্ষ বলছে, সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের গাফিলতির বিষয়ে প্রতিবেদন পাওয়ার আগে কিছু বলার সুযোগ নেই।
২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলের অবরোধ কর্মসূচি চলার সময় রাজধানীর পুরান ঢাকার ভিক্টোরিয়া পার্কের সামনে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) ছাত্রলীগ ক্যাডাররা নির্মমভাবে কুপিয়ে খুন করেন দর্জি দোকানি বিশ্বজিৎ দাসকে।
২০১৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর আলোচিত এ হত্যা মামলায় নিম্ন আদালতের রায়ে আটজনকে মৃত্যুদ ও ১৩ জনকে যাবজ্জীবন কারাদ দেওয়া হয়। পরে ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন আসামিরা এবং রায় কার্যকরের জন্য ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) আবেদন করে রাষ্ট্রপক্ষ। এর পর গত ৬ আগস্ট হাইকোর্ট আপিল ও ডেথ রেফারেন্স আবেদনের চূড়ান্ত শুনানি নিয়ে রায় দেন।
হাইকোর্টের রায়ে নিম্ন আদালতে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া আট আসামির মধ্যে রফিকুল ইসলাম শাকিল ও রাজন তালুকদারের (পলাতক) মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়। পাশাপাশি মৃত্যুদণ্ড পাওয়া চারজনের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও দু’জনকে খালাস দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া নিম্ন আদালতে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া ১৩ আসামির মধ্যে যে দু’জন আপিল করেছেন, তাদেরও রায়ে খালাস দেওয়া হয়।
রায়ের পর্যবেক্ষণে আদালত বলেন, পুলিশের তদন্তে গাফিলতি এবং সুরতহাল রিপোর্টের বিরুদ্ধে বিশ্বজিতের ভাই তার সাক্ষ্যে আঘাতের বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন। ভিডিও ফুটেজের মাধ্যমে আমরা আঘাতের দৃশ্যগুলো দেখেছি। কিন্তু এমন একটি হত্যাকা ের সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে কোনো মিল পাওয়া যায়নি। এ ঘটনায় রায়ে তদন্তে গাফিলতির অভিযোগে এসআই জাহিদুল হক ও চিকিৎসক মাকসুদুর রহমানের বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
গতকাল সোমবার এ বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ বলেন, ‘সাক্ষ্য-প্রমাণ এবং হত্যা মামলার সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের ভিত্তিতে হাইকোর্ট যা পেয়েছেন, তার ভিত্তিতে রায় দিয়েছেন। তবে ভিডিও ফুটেজে যাদের দেখা যাচ্ছে, তাদের অবশ্যই সাজা হওয়া উচিত। আমি মনে করি, আপিল বিভাগ কমপ্লিট জাস্টিস করবেন।’
তিনি বলেন, ‘হত্যা মামলার বিচারে লাশের ময়নাতদন্ত ও সুরতহাল প্রতিবেদন খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এখানে অসঙ্গতি থাকলে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা অনেকাংশেই সম্ভব হয় না। প্রসিকিউশনের উচিত ছিল এ বিষয়গুলোতে আরও জোর দেওয়া। তা হয়নি বলেই হাইকোর্ট প্রতিবেদন প্রস্তুতকারীদের বিরুদ্ধে তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ারও নির্দেশ দিয়েছেন।’
আইনজীবী ড. শাহ্দীন মালিক বলেন, ‘ভিডিও ফুটেজের সত্য ময়নাতদন্ত ও সুরতহাল প্রতিবেদনে প্রতিফলিত হয়নি। আশা করছি, হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করা হবে। সেখানেই চূড়ান্ত বিচারে আসামিদের সর্বোচ্চ সাজা নিশ্চিত হবে।’
গত বছর হাইকোর্টের দেওয়া ১২টি হত্যা মামলার রায়কে উদাহরণ হিসেবে টেনে সুপ্রিম কোর্টের এই আইনজীবী বলেন, ‘বিচারিক আদালতের মৃত্যুদণ্ডের রায় ইদানীং হাইকোর্টে আসার পর কমে যাবজ্জীবনে রূপান্তরিত হচ্ছে। অর্থাৎ মৃত্যুদণ্ডের রায় কমে যাচ্ছে। শুধু বাংলাদেশ নয়, উন্নত দেশগুলোতেও এ রকম হচ্ছে। তবে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি খালাস পেলে বিচারপ্রার্থীর মনে প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক নয়।’
এর আগে হাইকোর্টের রায়ের পর রোববার বিশ্বজিতের ভাই উত্তম দাস তার ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ায় বলেছিলেন, ‘এটা কেমন রায় হলো? এমনটা তো আমরা চাইনি। এটা বিচার, না খেলা? আগের আদালত আটজনকে ফাঁসি দিলেন। আর এখন দিলেন মাত্র দু’জনকে। তাহলে আগের বিচারক কী দেখে রায় দিলেন?’
মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশের সভাপতি মনজিল মোরসেদ বলেন, ‘হাইকোর্টের রায়ে রাষ্ট্রপক্ষের ব্যর্থতার বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বলা হয়েছে। এতেই প্রমাণ হয়, হাইকোর্ট ভিডিও ফুটেজে যা দেখেছেন, তা রাষ্ট্রপক্ষের প্রতিবেদনে আসেনি।’ এ ক্ষেত্রে হাইকোর্ট হত্যা মামলাটি পুনর্বিচারের জন্য নিম্ন আদালতে পাঠাতে পারতেন কি-না, এমন প্রশ্নে মনজিল মোরসেদ বলেন, “এতে বিচারে আরও দেরি হতো। আপিল বিভাগই ‘কমপ্লিট জাস্টিস’ করবেন।”
জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক সালমা আলী বলেন, ‘এই হত্যা মামলার বিচারে বড় তথ্য-প্রমাণ ভিডিও ফুটেজ। কোনো নির্দোষ ব্যক্তি যেন সাজা না পায়, এটা যেমন সত্য, তেমনি নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডে জড়িতদের কেউ যাতে ছাড়া না পায়, তাও আদালতকে নিশ্চিত করতে হবে। কিন্তু এখানে নিম্ন আদালত ও হাইকোর্টের রায়ের মধ্যে সুস্পষ্ট ব্যবধান রয়েছে। এর কারণ অবশ্যই হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হলে পাওয়া যাবে।’
ফৌজদারি আইন বিশেষজ্ঞ মোহাম্মদ খুরশীদ আলম খান বলেন, ‘হাইকোর্টের রায় চূড়ান্ত নয়। আপিল বিভাগের রায় পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।’ অবশ্য রাষ্ট্রপক্ষের এ ব্যর্থতা সম্পর্কে জানতে চাইলে রাষ্ট্রপক্ষের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মনিরুজ্জামান বলেন, ‘লাশের সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে গাফিলতি আছে কি-না, তা তদন্তের জন্য হাইকোর্ট নির্দেশ দিয়েছেন। তদন্ত প্রতিবেদন না আসা পর্যন্ত এ বিষয়ে কিছু বলা যাবে না।’
Posted ৯:৪৫ পূর্বাহ্ণ | মঙ্গলবার, ০৮ আগস্ট ২০১৭
coxbangla.com | Chanchal Chy