কক্সবাংলা ডটকম(২৭ আগস্ট) :: প্রত্যাবাসন না তৃতীয় দেশে পুনর্বাসন? বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গা ইস্যুটি জটিল সমীকরণে আবদ্ধ। রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন ইস্যু নিয়ে সময় যতই গড়াচ্ছে, দেশের জন্য তা তত বেশি ক্ষতি ডেকে আনছে। রোহিঙ্গাদের ঘিরে নানামুখী জঞ্জাল দেশের প্রশাসনকে উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় রেখেছে। সাধারণ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। পরিবেশ ক্রমশ ধ্বংস হচ্ছে।
মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গাদের এদেশে অবস্থানের পাঁচ বছর পূর্তিতে গত ২৫ আগস্ট সরকার পক্ষে এবং বিশে্বর বিভিন্ন দেশ ও সাহায্য সংস্থার বিভিন্ন ধরনের বক্তব্য এসেছে। এসব বক্তব্য ইতিবাচক হলেও অন্যতম শক্তিশালী দেশ এবং মিয়ানমারের সঙ্গে ভূ-রাজনীতি নিয়ে ওতপ্রোতভাবে জড়িত চীন কোন বক্তব্য বা বিবৃতি দেয়নি। তবে ইতোপূর্বে দীর্ঘ সময় পর এ দেশটি বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসন নিয়ে ইতিবাচক বক্তব্য দিয়েছিল।
রোহিঙ্গাদের তৃতীয় কোন দেশে পুনর্বাসনের প্রক্রিয়াটি জটিল সমীকরণে আবদ্ধ। এক্ষেত্রে সহজতর কোন উপায় নেই। যারাই ইচ্ছা প্রকাশ করুক না কেন মূলত আশ্রিত এত বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা নিয়ে কোন দেশ যে কার্যকর উদ্যোগ নেবে না তা নিয়ে কোন সন্দেহ নেই। গত পাঁচ বছর ধরে এরা এদেশের জন্য বিষফোঁড়া হয়ে রয়েছে। হাতেগোনা দু-একজন তৃতীয় দেশের আশ্রয় পেলে তা উদাহরণে আসে না। মূলত রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়াটি কার্যকর করাই শ্রেয়। কেননা বাংলাদেশ আগে থেকেই বলে আসছে রোহিঙ্গা সমস্যা মিয়ানমারের, সমাধানও করতে হবে মিয়ানমারকে। এর কোন বিকল্প পথ খোলা নেই।
জানা যায়,যুক্তরাষ্ট্র গত এক দশকে বাংলাদেশ থেকে কোনো রোহিঙ্গা শরণার্থী নেয়নি। তবে এই দীর্ঘ সময়ে মালয়েশিয়া থেকে ৯ হাজার রোহিঙ্গাকে নিয়েছে তারা। কয়েক মাস আগে মার্কিন কংগ্রেসে উপস্থাপন করা শরণার্থী নীতিমালায় এই তথ্য দেওয়া আছে।
এ অবস্থায় যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশসহ এ অঞ্চল থেকে ‘রোহিঙ্গা শরণার্থীদের’ পুনর্বাসন ‘উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি’ করতে কাজ করছে—দেশটির এই ঘোষণায় আশান্বিত না হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
কারণ এ পর্যন্ত তারা বাংলাদেশ থেকে কোনো রোহিঙ্গা শরণার্থী নেয়নি। ফলে ‘উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি’র অর্থও পরিষ্কার নয়। তবে এর আগেও যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থী নেওয়ার আগ্রহ দেখিয়েছিল। কিন্তু সংখ্যায় তা খুবই নগণ্য হওয়ায় বাংলাদেশ আগ্রহ দেখায়নি। বাংলাদেশ রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ দেশ মিয়ানমারে প্রত্যাবাসন চায়।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিনকেন গত বৃহস্পতিবার এক বিবৃতিতে বলেছেন, তাঁর দেশ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের পুনর্বাসন ‘উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি’ করতে কাজ করছে।
এরপর বিষয়টি নিয়ে নানামুখী বিশ্লেষণ শুরু হয়।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন শুক্রবার সাংবাদিকদের বলেছেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্যসহ আরো কয়েকটি দেশকে এক লাখ করে রোহিঙ্গা নিতে অনুরোধ জানিয়েছিলেন।
সাবেক রাষ্ট্রদূত ও আন্তর্জাতিক বিষয়ের বিশ্লেষকরা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র কতসংখ্যক রোহিঙ্গা নেবে তা এখানে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
যুক্তরাষ্ট্র যদি কয়েক লাখ রোহিঙ্গাকে পুনর্বাসন করে তাহলে বাংলাদেশের ওপর থেকে চাপ কমবে। কিন্তু গত এক দশকে তারা যা করেছে, সে রকম হলে এই ঘোষণা উল্টো রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের কাজকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে।
রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে কাজ করেন এমন কর্মকর্তারা বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্রের এই ঘোষণা পরিষ্কার না হলে বেশ কিছু ঝুঁকি তৈরি হবে। রোহিঙ্গারা যদি দেখতে পায় যে তারা শরণার্থী হিসেবে বাংলাদেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্রে যেতে পারছে, তাহলে তাদের অনেকেই হয়তো মিয়ানমারে ফিরে যেতে আগ্রহী হবে না।
এতে রোহিঙ্গাদের তাদের মাতৃভূমি মিয়ানমারে প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ ভেস্তে যেতে পারে। আর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বড় অভিযোগ, তারা রোহিঙ্গাদের মিয়ানমার থেকে নির্মূল করতে চায়। রোহিঙ্গারা যদি ফিরে না যায়, তাহলে তাদের সেই লক্ষ্য সহজে পূরণ হয়ে যাবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন রোহিঙ্গা অধিকার কর্মী বলেন, গত কয়েক বছরে হাজার কয়েক রোহিঙ্গা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশ থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোতে শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় পেয়েছে। তবে বাংলাদেশ থেকে যায়নি। কারণ বাংলাদেশ সরকার এই উদ্যোগকে সমর্থন করেনি।
বিদেশে অবস্থানরত এই রোহিঙ্গা অধিকার কর্মী বলেন, উচ্চশিক্ষা বা বিভিন্ন কারণে রোহিঙ্গাদের যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন দেশে যাওয়ার সুযোগ থাকা উচিত। তবে অবশ্যই অন্য দেশে রোহিঙ্গাদের স্থায়ীভাবে থাকার সুযোগ দেওয়ার চেয়ে তাদের মিয়ানমারে ফেরার পরিবেশ সৃষ্টি করা জরুরি।
রোহিঙ্গাদের তৃতীয় দেশে যাওয়া বিষয়ে জানতে চাইলে সাবেক পররাষ্ট্রসচিব তৌহিদ হোসেন বলেন, খুব ব্যতিক্রমী কিছু ঘটনা, যেমন কারো ওপর নির্যাতন করা হচ্ছে অথবা কোনো শিশু মা-বাবা দুজনকেই হারিয়েছে—এমন ব্যক্তি ও শিশুর তৃতীয় দেশে আশ্রয় পাওয়ার নজির আছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়, কানাডাও বিভিন্ন সময় কিছু রোহিঙ্গাকে নিতে চেয়েছিল। কিন্তু সংখ্যাটা খুব নগণ্য। যেমন : কোনো রোহিঙ্গার স্বজন কানাডায় থাকে, তাকে নিতে চেয়েছে তারা। পরিবারের সদস্য হিসেবে সেখানে পুনর্বাসন করতে চেয়েছে।
তৌহিদ হোসেন প্রশ্ন করেন, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে আশ্রিত কতজন রোহিঙ্গাকে পুনর্বাসন করেছে। সেটাকে উল্লেখযোগ্য মাত্রায় বৃদ্ধি করলেই বা কী হবে। দ্বিগুণ বা তিন গুণ করবে। মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেননি, যুক্তরাষ্ট্র এক লাখ বা ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে পুনর্বাসন করবে। যদি এটি তাদের চিন্তায় থাকে তাহলে পরিষ্কার বলে ফেলা উচিত ছিল।
তৌহিদ হোসেন বলেন, বাস্তবতা বলে, পশ্চিমা দেশগুলো যতজন রোহিঙ্গাকে পুনর্বাসন করবে তা প্রতিবছর যে পরিমাণ রোহিঙ্গা শিশু কক্সবাজারে আশ্রয়শিবিরে জন্ম নেয় তার ক্ষুদ্র একটি অংশ হতে পারে।
সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, জীবন বিপন্ন হওয়ার ঝুঁকি থাকলে যে কেউ আশ্রয়ের আবেদন করতে পারে। কক্সবাজারে নিহত রোহিঙ্গা নেতা মহিব উল্লাহর পরিবারকে কানাডা আশ্রয় দিয়েছে। এগুলো খুবই ব্যতিক্রমী ঘটনা। এর বাইরে এযাবৎ রোহিঙ্গাদের মধ্যে যারা কানাডা বা পশ্চিমা দেশগুলোতে আশ্রয় পেয়েছে তাদের প্রত্যেকেরই ওই দেশগুলোর সঙ্গে বা সেখানে অবস্থানরত কারো সঙ্গে যোগসূত্র ছিল।
বাংলাদেশে আশ্রিত ১০ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গার মধ্যে ৩৫ হাজার ৫১৯ জন শরণার্থী হিসেবে নিবন্ধিত। অন্যরা শরণার্থী হিসেবে নিবন্ধিত না হলেও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় তাদের ‘শরণার্থী’ হিসেবেই অভিহিত করে থাকে।
সাবেক পররাষ্ট্রসচিব ও বর্তমানে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের বঙ্গবন্ধু চেয়ার এম শহিদুল হক বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েও দেখতে হবে তারা সরকারকে কী প্রস্তাব দিচ্ছে। কারণ যুক্তরাষ্ট্র সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশ থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থী নেয়নি। বাংলাদেশ বলে আসছে যে রোহিঙ্গাদের নিতে হলে বড় সংখ্যায় নিতে হবে। কিন্তু তারা যে সংখ্যাটি নিতে চেয়েছিল তা ১০০-এর কম।
শহিদুল হক জানান, ২০০৫ সালের আগে বাংলাদেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের তৃতীয় দেশে পুনর্বাসন করার ব্যবস্থা ছিল। এটি বন্ধ হয়ে যাওয়ার বড় কারণ, দেশগুলো থেকে খুব কমসংখ্যক রোহিঙ্গা নেওয়ার আগ্রহ জানানো হয়েছিল। একটা সময় তা ৩০ জন, ১০ জন ও সাতজনে নেমে এসেছিল।
শহিদুল হক বলেন, এ ধরনের বাস্তুচ্যুতির ক্ষেত্রে তৃতীয় দেশে পুনর্বাসনও একটা সমাধান। কারণ সবাই মিয়ানমারে ফিরে যাবে না। আবার সবাই তৃতীয় দেশে পুনর্বাসনের সুযোগ পাবে না। কারণ সংখ্যাটা ১০ থেকে ১২ লাখ।
তৃতীয় দেশে পুনর্বাসনের সুযোগ পেলে মিয়ানমার থেকে রোহিঙ্গারা নতুন করে বাংলাদেশে আসতে উৎসাহিত হবে কি না, জানতে চাইলে শহিদুল হক বলেন, সেখানে আর খুব বেশি রোহিঙ্গা নেই।
যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশে সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, ‘মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যকে গঠনমূলক বলেই মনে হয়। কিন্তু এর পাশাপাশি মূল বিষয় থাকবে রোহিঙ্গাদের নিরাপদে মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো। সেই লক্ষ্যেই আমাদের কাজ করে যেতে হবে। এ ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রসহ বন্ধুরাষ্ট্রগুলোর সহযোগিতা আমরা আশা করি।
’ তিনি আরো বলেন, শুধু তৃতীয় দেশে পুনর্বাসনের মধ্য দিয়ে রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান হবে না। ১০ লাখ লোককে হয়তো কেউ নেবে না। কিছু বা কয়েক হাজার নিতে পারে।
জানতে চাইলে যুক্তরাজ্যভিত্তিক রোহিঙ্গাদের সংগঠন বার্মিজ রোহিঙ্গা অর্গানাইজেশন ইউকের (ব্রুক) সভাপতি তুন খিন বলেন, যুক্তরাষ্ট্র রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা দিচ্ছে। কিন্তু মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ফেরার পরিবেশ সৃষ্টির মতো কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেয়নি। তিনি বলেন, ‘আমি আমার দেশে, পিতৃভূমি মিয়ানমারের রাখাইনে ফিরতে চাই। আমরা রোহিঙ্গারা ভিক্ষুক নই। আমরা দয়া চাই না, অধিকার চাই। ’
Posted ১২:৪২ অপরাহ্ণ | শনিবার, ২৭ আগস্ট ২০২২
coxbangla.com | Chanchal Chy