হুমায়ুন রশীদ,টেকনাফ(৯ অক্টোবর) :: কক্সবাজারের সীমান্ত এলাকায় দলে দলে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করতে না করতেই উখিয়া-টেকনাফে রোহিঙ্গাদের আন্দোলন শুরু হয়ে গেছে। আন্দোলনের কর্মসুচীর অংশ হিসাবে তাদের ২১ দফা বাস্তবায়নের দাবিতে ইতিমধ্যেই রোহিঙ্গারা দাবি সম্বলিত ডিজিটাল ব্যানার প্রকাশ করেছে।
উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা এলাকা সমুহে এসব ডিজিটাল ব্যানারে ছেয়ে গেছে। ক্যাম্পের ভেতরে বাইরে প্রধান সড়কের পাশে এবং দর্শনীয় স্থানে লাগানো হয়েছে এ ব্যানার।
‘আমাদের ২১ দফা মানতে হবে’ রোহিঙ্গা অধিকার প্রতিষ্টা কমিটি, প্রতিষ্টা ২৫ আগস্ট ২০১৭, আবেদনে সকল রোহিঙ্গা জনগণ শিরোনামে ২টি ছবি ও লোগো সম্বলিত প্রচারিত ব্যানারে বাংলা ও ইংরেজী দুই ভাষায় ২১ দফা উল্লেখ করা হয়েছে।সকালে সকলের নজরে পড়ে ২১ দফার এ ব্যানার।
৯ অক্টোবর সোমবার রোহিঙ্গা ক্যাম্প ঘুরে কে বা কারা এ ব্যানার তৈরী বা লাগিয়েছে তার সন্ধান পাওয়া যায়নি। সাধারণতঃ ডিজিটাল ব্যানারে প্রেসের ঠিকানা থাকে। কিন্ত এ ব্যানারে ঠিকানাও নেই। তাছাড়া দিনভর রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অনুসন্ধান করেও কথিত রোহিঙ্গা অধিকার প্রতিষ্টা কমিটির খোঁজ মিলেনি।
২১টি দফার দাবি সম্বলিত বড় বড় ডিজিটাল এ ব্যানার সকলের নজর কাড়লেও ব্যানার তৈরীতে কে বা কারা জড়িত তার দায়-দায়িত্ব কেউ স্বীকার করেনি।
রোহিঙ্গারা এখনও আসছে। যারা এসেছেন তাঁরা এখনও ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছেন। সকলের ন্যুনতম মাথা গোঁজার ঠায় হয়নি। সরকারীভাবে শরণার্থীর মর্যাদা দেয়া হয়নি।
এমতাবস্থায় ২১ দফা দাবি বাস্তবায়নের ব্যানার প্রচার স্থানীয় সচেতন মহলকে ভাবিয়ে তুলেছে।তারা ধারনা করছেন সোমবার জাতিসংঘ এবং এর একদিন আগে যুক্তরাষ্ট্র রাখাইনে রোহিঙ্গা নির্যাতন নিয়ে দুটি পৃথক বিবৃতি প্রদান করে।যার পরিপ্রেক্ষিতে এ ব্যানারটিকেয়েকটি এনজিও’র যোগসাজসে করা হয়ে থাকতে পারে।
জাতিসংঘের ঢাকা কার্যালয় চলতি অক্টোবরে তৈরি করা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে উখিয়া ও কুতুপালং এলাকায় সংঘাতের আশঙ্কা করছে জাতিসংঘ। সংস্থাটি বলেছে, ২৫ আগস্টের পর থেকে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের কারণে ওই এলাকায় ভয়াবহ চাপ সৃষ্টি হয়েছে। সেখানে স্থানীয় জনগোষ্ঠী ও রোহিঙ্গারা অথবা রোহিঙ্গাদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব তৈরি হওয়ার পরিস্থিতি বিরাজ করছে, যা সংঘাতে রূপ নিতে পারে।
‘হিউম্যানিটারিয়ান রেসপন্স প্ল্যান; সেপ্টেম্বর ২০১৭-ফেব্রুয়ারি ২০১৮ রোহিঙ্গা রিফিউজি ক্রাইসিস’ শীর্ষক জাতিসংঘের প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। জাতিসংঘের ঢাকা কার্যালয় চলতি অক্টোবরে প্রতিবেদনটি তৈরি করেছে।
এর আগে গত বৃহস্পতিবার যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদের পররাষ্ট্র বিষয়ক কমিটিতে রোহিঙ্গা সঙ্কট নিয়ে শুনানিতে রাখাইনে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনীর দমন অভিযানের কারণে স্থানীয়ভাবে অস্থিতিশীলতা তৈরি ও একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র।
২১টি দফার দাবি সম্বলিত বড় বড় ডিজিটাল এ ব্যানার ইংরেজী ও বাংলা দুই ভাষায় লেখা। প্রথম লাইন লাল কালিতে ইংরেজী এবং ২য় লাইন কাল কালিতে বাংলা।
২১ দফা দাবি হচ্ছে …………
১. সকল রোহিঙ্গা জনগণকে বাধ্যতামুলক নাগরিক অধিকার দিতে হবে ও বার্মা সরকারের পক্ষ থেকে কোন শর্ত না দিয়ে আমাদেরকে ফিরিয়ে নিতে হবে।
২. রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার আগে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে।
৩. রোহিঙ্গাদের বাড়িঘর যেগুলো আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে তার সম্পুর্ণ ক্ষতিপুরণ সরকারীভাবে দিতে হবে।
৪. রোহিঙ্গাদের সকল শিক্ষার অধিকার দিতে হবে।
৫. রোহিঙ্গাদের বাড়িঘরের জমিজমা কোন শর্ত ছাড়াই কাগজে-কলমে ফেরৎ দিতে হবে।
৬. রোহিঙ্গাদের পুরানো নাম আরাকান স্টেট দিতে হবে।
৭. রোহিঙ্গাদের স্বাধীনভাবে ব্যবসা বাণিজ্যের অধিকার দিতে হবে এবং ব্যবসা বাণিজ্যের মালামালের নিরাপত্তা দিতে হবে।
৮. আরাকানে রোহিঙ্গাদের জন্য আলাদা বিচার ব্যবস্থা করতে হবে। জজ, ম্যাজিস্ট্রেট রোহিঙ্গাদের মধ্য থেকে দিতে হবে।
৯. রোহিঙ্গাদের ধরে ধরে জেল হাজতে বন্দি রেখে দিনের পর দিন নির্যাতন করছে তাদের শর্তবিহীন ছেড়ে দিতে হবে এবং রোহিঙ্গাদের জন্য আলাদা জেলখানা আরাকানের ভেতরে স্থাপন করতে হবে।
১০. রোহিঙ্গাদের জন্য আলাদা সরকারী মুসলিম মন্ত্রণালয় স্থাপন করতে হবে।
১১. যেকোন এনজিও দেশী-বিদেশী সাংবাদিকদেরকে আরাকানে প্রবেশ করার অধিকার দেওয়ার পাশাপাশি নিজস্ব টিভি চ্যানেল পরিচালনায় কোন বাধা দিতে পারবেনা।
১২. আরাকানের জমিতে অবস্থানরত বৌদ্ধ ধর্মের লোকদের বাড়িতে যে অস্ত্র ও বোমা দেয়া হয়েছে তা সম্পুর্ণ সরকারীভাবে ফেরৎ নিতে হবে।
১৩. রোহিঙ্গা নারী শিশু যুবকদের উপর যুগ যুগ ধরে গোপনে প্রকাশ্যে যে গণহত্যা নারী ধর্ষন করা হয়েছে তার বিচার আর্ন্তজাতিক আদালতে হতে হবে।
১৪. রোহিঙ্গাদের জন্য প্রতি থানায় থানায় ওআইসি এবং জাতিসংঘের শান্তি মিশণের ফোর্স নির্ধারিত থাকতে হবে।
১৫. রোহিঙ্গাদের মসজিদ মাদ্রাসা মক্তব তবলীগের মরকজসহ সকল ধর্মীয় প্রতিষ্টান স্থাপন করতে দিতে হবে।
১৬. রোহিঙ্গাদের সকল প্রকার সরকারী ডিপার্টমেন্টে চাকরি দিতে হবে। শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সকলের অধিকার দিতে হবে।
১৭. পুরো আরাকানে ও বার্মার যেকোন স্থানে রোহিঙ্গাদের চলাফেরা করার অধিকার দিতে হবে।
১৮. রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ভিসা পাসপোর্ট করার ব্যবস্থা করতে হবে। পাসপোর্ট অফিস আরাকানের ভেতরে হতে হবে এবং রোহিঙ্গাদের বিদেশ গমনাগমণের সুযোগ দিতে হবে।
১৯. কোন মামলা ছাড়া মিলেটারী পুলিশসহ যেকোন বাহিনী অনর্থক রোহিঙ্গাদের বাড়িঘরে চেক করার নামে ঢুকতে পারবেনা।
২০. রোহিঙ্গা আলেম ওলামাদের পাঞ্জাবী পায়জামা টুপি পরনে বাধা না দেয়ার পাশাপাশি ধর্মীয় কাজে বাধা দিতে পারবেনা।
২১. গবাদিপশু হাঁস-মুরগী পালনে কোন ক্ষতিপুরণ নিতে পারবেনা।
ব্যানারে আরও লেখা হয়েছে ‘আমরা নিজ দেশে ফিরে যেতে চাই, আমাদের অধিকার আমরা চাই, মারামারি নয়, হানাহানি নয়, খুনাখুনি নয়, অধিকার নিয়ে শান্তিতে বসবাস করতে চাই’।
লেদা অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পের (স্থানীয় ভাষায় রোহিঙ্গা টাল) নির্বাচিত চেয়ারম্যান হাফেজ মোঃ আয়ুব বলেন,সোমবার ঘুম থেকে উঠে সকালে দেখি আমার বাসার বাইরে এ ব্যানার। তা কে বা কারা লাগিয়েছে সে সম্পর্কে আমি কিছুই জানিনা’। ক্যাম্পের প্রবীণ মুরুব্বী মাস্টার আবদুল জব্বার এবং মাস্টার আবদুল মতলবও একই মন্তব্য করেন।
স্থানীয় সচেতন মহলের মতে নিশ্চয় এ ব্যানার রোহিঙ্গা বা রোহিঙ্গাদের পক্ষে কোন গোষ্টি পরিকল্পিতভাবে লাগিয়েছে। ব্যানারে লেখা ২১টি দফার ২১টি দাবিই যথার্থ, সঠিক ও যুক্তিসঙ্গত। কিন্ত বর্তমানে দলে দলে মিয়ানমারের বাসিন্দা রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশের স্রোতে দেশের সর্ব শ্রেনীর মানুষ রোহিঙ্গাদের যথসাধ্য মানবিক সাহায্য-সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছেন। দেশের সরকার প্রধান, মন্ত্রী পরিষদ, বিরোধী দল রোহিঙ্গাদের প্রতি সহানুভুতিশীল। এমতাবস্থায় এ ধরণের কর্মকান্ড মোটেও যুক্তিসঙ্গত নয়। এতে সীমান্ত এলাকার শান্তি শৃংখলা ভঙ্গসহ অশুভ শক্তির ইঙ্গিত বহন করে।
টেকনাফ এবং উখিয়ায় ২টি নিবন্ধিত এবং একাধিক অনিবন্ধিত ক্যাম্প গত ২ যুগ ধরে চলছে। রোহিঙ্গাদের অতীত ইতিহাস অন্তত সীমান্ত এলাকার এ অঞ্চলের মানুষ ভুলে যাননি। এরা বাংলাদেশের সরকারী কর্মকর্তাদের উপর সশস্ত্র হামলা, ক্যাম্প অভ্যন্তরে ঢুকতে না দিয়ে অবরুদ্ধ করে রাখা, কথায় কথায় রেশন বর্জন করে ও অপপ্রচার চালিয়ে আর্ন্তজাতিক মহলে বাংলাদেশের ভাবমুর্তি ক্ষুন্ন, পুলিশ-বিডিআরের উপর হামলা এমনকি ম্যাজিস্ট্রেটের উপর হামলা করতে মোটেও কুন্ঠাবোধ করেনি। তাছাড়া তাদের অঘটন-অপকর্মের ফিরিস্তি অনেক লম্বা।
আলোচিত ব্যানার বিষয়ে স্থানীয় প্রশাসনের ভুমিকা জানতে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মোঃ জাহিদ হোসেন সিদ্দিকের মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে ফোন রিসিভ না করায় বক্তব্য নেয়া সম্ভব হয়নি।
এব্যাপারে প্রতিক্রিয়ায় টেকনাফ-উখিয়ার সাবেক এমপি ও টেকনাফ উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি আলহাজ্ব অধ্যাপক মোহাম্মদ আলী বলেন ‘এসব ভাল লক্ষণ নয়। এই রোহিঙ্গাদের পেছনে আর্ন্তজাতিক চক্রান্ত রয়েছে। মহলটি আমাদের প্রিয় মাতৃভুমি বাংলাদেশকে তালেবান রাষ্ট্র বানাতে তৎপর। রোহিঙ্গারা আমাদের দেশে আশ্রয় নিয়ে তাদের দাবি বাস্তবায়নে বড় বড় ডিজিটাল ব্যানার প্রচার করবে আর আমাদের দেশের প্রশাসন ও আইনশৃংখলা বাহিনী নিরব থাকবে তা দুঃখজনক’।
Posted ১২:৩৪ অপরাহ্ণ | মঙ্গলবার, ১০ অক্টোবর ২০১৭
coxbangla.com | Chanchal Chy