কক্সবাংলা ডটকম(২১ সেপ্টেম্বর) :: মিয়ানমার থেকে জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত ১২ লাখের বেশি রোহিঙ্গা ৭ বছর ধরে বাংলাদেশের কক্সবাজারের সীমান্ত উপজেলায় অবস্থান করলেও প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে বাস্তব কোনো অগ্রগতি এখন পর্যন্ত চোখে পড়েনি। বাংলাদেশ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিভিন্ন সময় নানা উদ্যোগ নিলেও এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গারা নিজ দেশ মিয়ানমারে ফিরে যেতে পারেনি।
কূটনৈতিক ও আইনি প্রক্রিয়ার পাশাপাশি মিয়ানমারের সঙ্গে বিভিন্ন সময় আলোচনার পরও সংকট সমাধানে কোনো অগ্রগতি নেই। এই সমস্যার সমাধান হতে না হতে আবার যোগ হয়েছে রোহিঙ্গাদের নতুন ঢেউ। গত কয়েক দিনে আরও ১৫ হাজারের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে এবং ৭০ হাজারের বেশি সীমান্তে অবস্থান করছে বলে গণমাধ্যম প্রকাশ করেছে।
প্রত্যাবাসন বিলম্ব হওয়ায় দিন দিন রোহিঙ্গা ক্যাম্পে সন্ত্রাস ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড বেড়ে চলেছে। মাদক ও অস্ত্র চোরাচালানসহ ভয়ংকর অপরাধেও তাদের সম্পৃক্ত থাকার তথ্য পাওয়া গেছে। বিপুল পরিমাণ রোহিঙ্গা উপস্থিতির কারণে কক্সবাজারের স্থানীয় অধিবাসীদের জীবনেও নেমে এসেছে এক দুর্বিষহ অবস্থা।
অনেক রোহিঙ্গা বাংলাদেশের পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে গিয়ে বাংলাদেশের শ্রমবাজারের ক্ষতি করছে। জঙ্গিবাদের সঙ্গেও তাদের সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে ফলে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশের জাতীয় নিরাপত্তার জন্যও হুমকি হয়ে উঠেছে। যা শুধু বাংলাদেশের জন্য নয় এই পুরো অঞ্চলের জন্যও নিরাপত্তা হুমকি।
মিয়ানমারের আগের প্রশাসনের সঙ্গে রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন নিয়ে আলোচনা অনেক দূর এগিয়ে গেলেও সেখানে সামরিক বাহিনী ক্ষমতায় আসার পর সে আলোচনা থমকে যায়। বর্তমানে মায়ানমারজুড়ে জাতিগত সংঘাত, সহিংসতা এমন পর্যায় গিয়ে পৌঁছেছে যে সেখানকার সামরিক সরকারের ভবিষ্যৎ ক্রমেই অনিশ্চিত হয়ে পড়ছে। বিদ্রোহী গোষ্ঠী ‘আরাকান আর্মি’ মায়ানমারের আরাকান রাজ্যের বড় একটি অংশ নিজেদের দখলে নিয়েছে।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে রাখাইন রাজ্যে দেশটির জান্তা বাহিনী ও আরাকান আর্মির মধ্যে ভয়াবহ সংঘর্ষ চলছে। আরাকান আর্মি ও সেনাবাহিনীর মধ্যে চলমান যুদ্ধে দুপক্ষই রোহিঙ্গাদের ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে।
রোহিঙ্গা নেতারা জানান, মিয়ানমারে তাদের ওপর প্রথম গণহত্যা চালায় দেশটির জান্তা বাহিনী আর বর্তমান দ্বিতীয়বার গণহত্যা চালাচ্ছে আরাকান আর্মির সদস্যরা।
ইতোমধ্যে দ্বিতীয় দফায় গণহত্যায় তিন হাজারের বেশি রোহিঙ্গা নিহত হয়েছে। ওইসব এলাকার অনেক রোহিঙ্গাকে বাস্তুচ্যুত করা হয়েছে এবং অনেক বাড়িঘরে আগুন দেয়া হয়েছে। রাখাইন রাজ্যকে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীশূন্য করতে তাদের এ কৌশল বলে অনেকে মনে করছেন।
কূটনৈতিক সূত্র জানায়, আন্তর্জাতিক চাপের মুখে ২০১৭ সালের শেষ দিকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে রাজি হয় মিয়ানমারের অং সান সু চি সরকার। ওই বছর সেপ্টেম্বরে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় চুক্তিতেও স্বাক্ষর করে দেশটি।
বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা চলার এক পর্যায়ে ২০১৯ সালে দুই দফায় প্রত্যাবাসনের উদ্যোগ নেয়া হয় কিন্তু মিয়ানমার সরকারের প্রতিশ্রুতিতে রোহিঙ্গারা আস্থা রাখতে না পারায় সেই চেষ্টা ভেস্তে যায়। ২০২১ সালের ফেরুয়ারিতে মিয়ানমারের সামরিক বাহিনী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করার পর রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসন আলোচনা কার্যত বন্ধ হয়ে যায়।
এরপর, ২০২৩ সালের এপ্রিলে চীনের পক্ষ থেকে তৃতীয় দফায় উদ্যোগ নেয়া হয়। চীনের কুনমিংয়ে বাংলাদেশ, মিয়ানমার ও চীনের মধ্যে ত্রিপক্ষীয় বৈঠক হয় এবং মে মাসে চীনের উদ্যোগে মিয়ানমার প্রত্যাবাসনের সম্ভাব্যতা যাচাই ও পাইলট প্রকল্প হাতে নেয়া হয়।
এ উদ্যোগের পর কয়েক দফায় রোহিঙ্গাসহ উভয় দেশের প্রতিনিধিরা প্রত্যাবাসনের সম্ভাব্যতা যাচাই করেন। মিয়ানমারে ফেরার জন্য নির্বাচিত রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পগুলোয় একত্র করা হয় কিন্তু আরাকান আর্মি ও মিয়ানমার জান্তা সরকারের সঙ্গে চলমান যুদ্ধে প্রত্যাবাসনের প্রক্রিয়া আবারো থেমে যায়।
মিয়ানমারের প্রতিবেশী দুই অর্থনৈতিক পরাশক্তি ভারত ও চীন তাদের নিজ নিজ ভূ-রাজনৈতিক স্বার্থে রোহিঙ্গা ইস্যুতে কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিচ্ছে না বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং জাপানের দেশটিতে বিনিয়োগ থাকায় তাদের ভূমিকাও অস্পষ্ট।
জাতিসংঘ, বিভিন্ন দাতা সংস্থা, প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলো এ সমস্যার ব্যাপারে অবহিত হলেও সমাধানের ব্যাপারে কার্যকর ও দৃশ্যমান পদক্ষেপ চোখে পড়ার মতো না।
রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাকে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে প্রস্তাব পাসের দিকে বিশেষভাবে নজর দিতে হবে। নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য দেশগুলোর মিয়ানমারের ওপর চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখতে হবে।
বিশেষ করে রোহিঙ্গা ইস্যুতে চীন, রাশিয়া ও ভারতের সমর্থন বাংলাদেশের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকদের মতে, রোহিঙ্গাদের তাদের নিজ দেশে প্রত্যাবসনই একমাত্র সমাধান হলেও নানা জটিলতায় আটকে আছে প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া। রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বহুমুখী কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জরুরি। মিয়ানমার ও রাখাইন রাজ্যে যুদ্ধ বন্ধে এবং স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে প্রভাবশালী দেশগুলোকে দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে।
জাতিসংঘ, আন্তর্জাতিক সংস্থা ও দাতা দেশগুলোর সহায়তায় রোহিঙ্গাদের রাখাইনে গ্রহণযোগ্যতা বাড়াতে আরাকান আর্মি, সেখানকার রাজনৈতিক দল ও স্থানীয় রাখাইনদের নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। এখনই সময় কূটনৈতিক প্রচেষ্টা জোরদার করে এই সমস্যা সমাধানের। প্রয়োজনে আমাদের আরাকান আর্মির সাথে ভিন্ন চ্যানেলে কথা বলা যেতে পারে, যেন তারা রোহিঙ্গা প্রত্যাবসনকে সমর্থন করে।
দীর্ঘ সাত বছর ধরে চলমান রোহিঙ্গা সংকট নানা দিক দিয়ে বাংলাদেশের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে। বিশ্বজুড়ে চলমান অস্থিতিশীল ও সংঘাতময় পরিস্থিতিতে এই সমস্যা যেন গুরুত্ব হারিয়ে না ফেলে সেদিকে আমাদের সবপক্ষকে সজাগ থাকতে হবে। আমরা আশা করতে পারি, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের ক্ষেত্রে আরো আন্তরিক হবে এবং তাদের সম্মানজনক প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করবে।
লেখক: সাইফুল ইসলাম শান্ত, সাংবাদিক ও কলামিস্ট
Posted ১২:২৫ পূর্বাহ্ণ | রবিবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta