কক্সবাংলা ডটকম(২০ নভেম্বর) :: প্রায় তিন মাস হতে চলল। প্রাণভয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে এখন পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ নিচ্ছে না মিয়ানমার। রোহিঙ্গা সংকটেরও কোনো সমাধান হচ্ছে না। উল্টো রোহিঙ্গা ইস্যুটি বিতর্কিত করে তুলছে দেশটি। বাংলাদেশ চাইছে দ্বিপক্ষীয় ও বহুপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে সংকটের সমাধান। নতুন চুক্তির মাধ্যমে সব রোহিঙ্গাকে নিরাপদে ফিরিয়ে দিতে। কিন্তু সে পথে যেতে নারাজ মিয়ানমার।
জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক মহলকে বাইরে রেখে ১৯৯২ সালের চুক্তি অনুযায়ী ও দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের কথা ভাবছে তারা। অথচ এ নিয়ে শুরু থেকেই আপত্তি জানিয়ে আসছে বাংলাদেশ। মিয়ানমারের এ প্রস্তাবকে আন্তর্জাতিক চাপ প্রশমনের কৌশল মনে করছে ঢাকা।
অন্যদিকে রোহিঙ্গা ইস্যুকে কেন্দ্র করে আঞ্চলিক রাজনীতিও ক্রমেই জটিল হয়ে উঠছে। ইতোমধ্যেই রোহিঙ্গাদের ফেরত নেওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশের সঙ্গে মতভিন্নতা দেখা দিয়েছে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের। এর মধ্যে চীন চাইছে, বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে সংকটের সমাধান। সর্বশেষ গত শনিবার সন্ধ্যায় গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ঢাকা সফররত চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বাংলাদেশ ও মিয়ানমারের মধ্যে সংলাপ আয়োজনে বেইজিংয়ের আগ্রহের কথা জানিয়েছেন।
আর যুক্তরাষ্ট্র বলছে, ১৯৯২ সালের চুক্তি অনুযায়ী সংকটের সমাধান হতে পারে। যদিও দেশটি সংকট সমাধানে মিয়ানমারকে অব্যাহত চাপ দিয়ে আসছে। সর্বশেষ গত বুধবার মিয়ানমার সফর করে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে মিয়ানমারকে উদ্যোগ নিতে বলেন।
একইভাবে গত বৃহস্পতিবার রোহিঙ্গা ইস্যুতে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের থার্ড কমিটিতে গৃহীত প্রস্তাবে বাংলাদেশের ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী ও বন্ধু কয়েকটি দেশের সমর্থন না পাওয়ায় ঢাকার মিয়ানমারনীতি বা কৌশল নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষ করে ভারত ও রাশিয়া এবং সাম্প্রতিক সময়ের বন্ধু দেশ চীন প্রস্তাবের পক্ষে ভোট না দেওয়ায় বাংলাদেশকে হতাশ করেছে। অথচ রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় শুরু থেকেই এই তিন দেশের কাছে সহযোগিতা চেয়ে আসছে বাংলাদেশ।
এমনকি ভোটাভুটিতে সার্কভুক্ত দেশ নেপাল, শ্রীলঙ্কা ও ভুটানের বিরত থাকাও অবাক করেছে বাংলাদেশকে। কারণ এ দেশগুলোর যেকোনো সংকটের শুরুতেই বাংলাদেশ সব সময় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। ফলে এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গা ইস্যুটি ঠিক একই জায়গায় ঘুরপাক খাচ্ছে।
সংকট সমাধানে দৃশ্যমান কোনো উন্নতি চোখে পড়ছে না। কার্যকর কোনো উদ্যোগও শুরু হয়নি। এ পর্যন্ত মিয়ানমারের সঙ্গে বাংলাদেশের তিন দফা আলোচনা হয়েছে। আলোচনা অনুযায়ী রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে জয়েন্ট ওয়ার্কিং কমিটি এখনো গঠন হয়নি। বাংলাদেশের দেওয়া নতুন চুক্তির প্রস্তাবের ব্যাপারেও কিছু বলছে না দেশটি।
এমনকি রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে বিতর্কিত সেই নাগরিকত্বের জায়গা থেকে নড়ছে না। উল্টো রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে বিলম্বের জন্য বাংলাদেশকে দুষছে। সর্বশেষ দ্বিপক্ষীয় আলোচনার নামে বিশেষ কৌশল ফেঁদেছে দেশটি।
গত ২৫ আগস্ট মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী অভিযান শুরু করে। মিয়ানমারের সেনাদের বিরুদ্ধে গণহত্যা, নির্যাতন, দলবদ্ধ ধর্ষণের অভিযোগ করে বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা। নির্যাতনের মুখে ছয় লক্ষাধিক রোহিঙ্গা সীমান্ত পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে, যাদের বেশির ভাগই নারী ও শিশু।
এমন পরিস্থিতিতে কী ভাবছে বাংলাদেশÑজানতে চাইলে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী বলেন, ‘রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আন্তর্জাতিক চাপ অনুভব করছে বলেই মিয়ানমার দ্বিপক্ষীয়ভাবে বাংলাদেশের সঙ্গে কথা বলছে। আগে তারা আমাদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথাই বলত না। ভবিষ্যতেও আন্তর্জাতিক চাপ থেমে গেলে মিয়ানমার রোহিঙ্গা ইস্যু ভুলে যাবে। আমরা চাই, সংকটের যৌক্তিক সমাধান না হওয়া পর্যন্ত মিয়ানমারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ অব্যাহত থাকুক।’
তবে মন্ত্রী এ কথাও বলেন, ‘রোহিঙ্গা সমস্যা এক দিনে বা এক মাসে সমাধান হবে না। বাংলাদেশ কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে এবং সারা বিশ্ব এখন বাংলাদেশের পাশে আগের চেয়ে বেশি মাত্রায় দাঁড়িয়েছে। আমরা কাজ করছি এবং ফলাফল দৃশ্যমান।’
অবশ্য আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক ও সাবেক কূটনীতিকরা রোহিঙ্গা ইস্যুকে ঘিরে দেখা দেওয়া সাম্প্রতিক ঘটনায় উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই বলে মনে করছেন। তাদের মতে, চীন ও রাশিয়া শুরু থেকেই মিয়ানমারের পক্ষে। প্রথমদিকে দেশ দুটি ‘কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কারো হস্তক্ষেপ কাম্য নয়’ বলে মন্তব্য করছিল। এখন সেখান থেকে সরে এসে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের কথা বলছে। এমনকি চীন রোহিঙ্গা ইস্যুতে কোনো দেশের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করবে না বলেও জানিয়েছে।
সুতরাং ধৈর্য ধরে বাংলাদেশকে কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যেতে হবে। দ্বিপক্ষীয় আলোচনায় সমস্যা নেই। তবে সমাধানে নেওয়া কৌশলে জাতিসংঘসহ বাংলাদেশের পক্ষের দেশগুলোকে অর্থাৎ তৃতীয় কোনো পক্ষ রাখতে হবে।
এ ব্যাপারে মিয়ানমারে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত মেজর (অব.) ইমদাদুল ইসলাম বলেন, মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে যে সমাধান সম্ভব নয়, তার উদাহরণ দেশটি নিজেই দিয়েছে। এর আগে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে করা ১৯৯২ সালের চুক্তি নিজেরাই ভঙ্গ করেছে দেশটি।
এখন পর্যন্ত রোহিঙ্গাদের ফেরত নিতে সদিচ্ছার প্রমাণ দেয়নি। নাগরিকত্ব নিয়ে জটিলতা সৃষ্টি করছে। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশের সঙ্গে দুই দফা আলোচনায় নেওয়া প্রস্তাবের একটিও মানেনি দেশটি।
উল্টো রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনের জন্য বাংলাদেশকে দুষছে। রোহিঙ্গা নির্যাতনকে বৈধতা দিতে ও আন্তর্জাতিক চাপ প্রশমনে রাশিয়া, চীন ও ভারতকে পক্ষে রাখতে কূটনৈতিক তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে। এমনকি বিশ্ব জনমতকে উপেক্ষা করে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন অব্যাহত রেখেছে। প্রতিদিনই বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে রোহিঙ্গারা।
জাতিসংঘের থার্ড কমিটিতে রোহিঙ্গা ইস্যুতে বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোর সমর্থন না পাওয়ায় মিয়ানমারনীতি বা কৌশল নিয়ে নতুন করে ভাবছে বাংলাদেশ।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্রমতে, রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে বাংলাদেশ এখনো বহুপক্ষীয় উদ্যোগের পক্ষে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে নিয়েই সমস্যা সমাধানে কাজ করছে। তবে মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনা অব্যাহত রাখবে। কারণ এটা স্পষ্ট যে, আন্তর্জাতিক চাপ সরে গেলে মিয়ানমার কিছুই করবে না। সুতরাং বহুপক্ষীয় উদ্যোগ থেকে সরে আসবে না বাংলাদেশ।
তবে থার্ড কমিটিতে বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান না নেওয়ায় তিন দেশের সঙ্গে নতুন করে আলোচনার উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ। শিগগিরই চীন ও রাশিয়া যাচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর দুই বিশেষ দূত। ভারতের সঙ্গে আলোচনা হবে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে সঙ্গে নিয়ে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে এখনকার কৌশল ও পদক্ষেপ থেকে বাংলাদেশের সরে আসার সুযোগ নেই বলে মনে করছেন মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
উদ্ভূত পরিস্থিতিতে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে আরো বেশি তৎপর হয়েছে বাংলাদেশ। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রমতে, ইতোমধ্যেই মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেক্স টিলারসন মিয়ানমার ও বাংলাদেশ সফর করেছেন। চীন, জাপান, জার্মানি ও সুইডেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরাও বাংলাদেশে এসেছিলেন। গতকাল থেকে মিয়ানমারের রাজধানী নেপিদোতে শুরু হওয়া
‘এশিয়া-ইউরোপ মিটিং’-এ অংশ নিয়েছে বাংলাদেশ। চলতি মাসের শেষে অর্থাৎ ২৯ নভেম্বর মিয়ানমার ও ৩০ নভেম্বর বাংলাদেশ সফর করবেন পোপ ফ্রান্সিস। এসব সফর ও বৈঠকে রোহিঙ্গা সংকট নিরসনে জোরালো ভূমিকা রাখছে বাংলাদেশ।
রোহিঙ্গা ইস্যুর সর্বশেষ পরিস্থিতি প্রসঙ্গে সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, থার্ড কমিটিতে রোহিঙ্গা সংকট সমাধানে যে প্রস্তাব পাস হয়েছে তা ইতিবাচক। রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার ব্যাপারে ১৩৫ ভোট পড়েছে। তার মানে এতগুলো দেশ বাংলাদেশের বন্ধু। ফলে এ প্রস্তাবকে ধরে আমাদের আরো কাজ করতে হবে।
ভারত ছাড়াও সার্কভুক্ত দেশগুলো কেন ভোটদানে বিরত রইল, সেটা বিশ্লেষণ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, রোহিঙ্গা ইস্যুটি শুধু রোহিঙ্গার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এখানে নানা স্বার্থ রয়েছে। সুতরাং কেউ এমনি এমনি পক্ষে দাঁড়াবে না।
এই কূটনীতিক আরো বলেন, থার্ড কমিটিতে গৃহীত হওয়ার পর এই প্রস্তাব জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সামনে সব সদস্যের বিবেচনার জন্য পুনরায় উত্থাপিত হবে। ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে এই প্রশ্নে চূড়ান্ত ভোটাভুটি হবে। সেসময় যাতে আরো অধিকসংখ্যক সদস্যরাষ্ট্র প্রস্তাবটির পক্ষে ভোট দেয়, সেজন্য বাংলাদেশি কূটনীতিকদের কাজ করতে হবে।
Posted ১:৪৯ পূর্বাহ্ণ | মঙ্গলবার, ২১ নভেম্বর ২০১৭
coxbangla.com | Chanchal Chy