নজরুল ইসলাম,কুতুবিদয়া(২৬ জানুয়ারি) :: এই শীতে একবার ঘুরে আসুন কক্সবাজারের কুতুবদিয়া দ্বীপ। এখনো এই দ্বীপের ঐতিহাসিক বাতিঘরটি একনজর দেখতে প্রতিবছর ছুটে যান ভ্রমণকারীরা। ঐতিহাসিক এই বাতিঘর ও দ্বীপকে কেন্দ্র করে এদেশের পর্যটন শিল্পকে সমৃদ্ধ করতে বর্তমান সরকার যে মেগাপ্রকল্প হাতে নিয়েছে তা বাস্তবায়ন হলে বঙ্গোপসাগরের বুক চিরে জেগে উঠা কুতুব আউলিয়ার এই দ্বীপ পরিণত হবে সম্ভাবনাময় এক স্বর্গরাজ্যে। যে সকল প্রকৃতি প্রেমীরা চট্টগ্রাম হয়ে বিশে^র দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত কক্সবাজার ঘুরতে যান তারা সহজেই ফেরার পথেই ঘুরে আসতে পারেন বাতিঘরটিসহ বৈচিত্রময় এই মায়া দ্বীপটি।
কেন যাবেন? কিভাবে যাবেন? কোথায় থাকবেন? খাবেন কি? ইত্যাদি এসব প্রেেশ্নর উত্তর জানার আগে জেনে নিন ঐতিহাসিক কুতুবদিয়া বাতিঘরের আদ্যোপান্ত। প্রাচীনকাল থেকে চট্টগ্রাম ছিল একটি সমুদ্রবন্দর। খ্রিস্টীয় নয় শতক থেকে আরব বণিকরা চট্টগ্রামের সঙ্গে বাণিজ্যিক যোগাযোগ স্থাপন করে। বাংলায় মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠার পর থেকে চট্টগ্রাম বন্দর পরিণত হয় একটি ব্যস্ততম আন্তর্জাতিক বন্দরে ।
তখনকার সময়ে সামুদ্রিক জাহাজে উন্নত প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি ছিল না, অভিজ্ঞ নাবিকরা প্রাচীন প্রচলিত পদ্ধতিতে সাগর-মহাসাগর পাড়ি দিতেন। ১৮২২ সালে বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে উপকূলভাগ বিধ্বস্ত হওয়ার ফলে চট্টগ্রাম বন্দর এলাকায় সমুদ্রের বক্ষে পলি জমে অনেক চর সৃষ্টি হয়। যার ফলে চট্টগ্রাম বন্দরে দেশি-বিদেশি জাহাজ চলাচলে বিভিন্ন ধরনের সমস্যা দেখা দেয়। সৃষ্ট সমস্যা থেকে পরিত্রাণের লক্ষ্যে ব্রিটিশ সরকার বাতিঘর স্থাপনের জন্য জরিপকাজ পরিচালনা করে নির্বিঘ্নে জাহাজ চলাচলের স্বার্থে। সিদ্ধান্ত নেয় চট্টগ্রাম বন্দর থেকে প্রায় ২৫ মাইল দক্ষিণে তিন দিকে বঙ্গোপসাগর পরিবেষ্টিত কুতুবদিয়া নামক দ্বীপে একটি সুউচ্চ বাতিঘর স্থাপন করার।
তারই প্রেক্ষিতে ১৮২২ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ ক্যাপ্টেন হেয়ার এর পরিচালনায় ও ইঞ্জিনিয়ার জে এইচ টু গুড এর নকশায় বন্দর নগরী চট্টগ্রামের কর্ণফুলি নদীর মোহনায় কুতুবদিয়া দ্বীপের দক্ষিণ ধুরং ইউনিয়নের আলী ফকির ডেইল এর পশ্চিম সমুদ্র উপকূলে নির্মাণ করা হয় পাথরের ভিতের ওপর নির্মিত আটতলা বিশিষ্ট প্রায় ১২০ ফুট উচ্চতার কুতুবদিয়া বাতিঘর। মাটি থেকে টাওয়ারের অংশে ছিল ১৫ফুট উচ্চতার ১৫টি কক্ষ।
সর্বোচ্চ কামরায় একটি কাঠের ফ্রেমে বসানো হয়েছিল আট ফিতার ল্যাম্প। ল্যাম্পটি জ্বালানো হতে নারকেল তেল দিয়ে।বাতিটি জ্বালানো হতো প্রতিদিন সূর্য ডুবার আগে। এর ছয়টি কামরায় পাটাতন ও সিঁড়ি ছিল কাঠের তৈরি। বাতিঘরের নিচতলা ছিল মাটির নিচে এবং এর দেয়াল ছিল খুবই পুরু। প্রতিটি কক্ষে ছিল কাচের জানালা। এই বাতিঘরটির নির্মাণ কাজ শেষ হয় ১৮৪৬ খ্রিষ্টাব্দে। এটির নির্মাণ ব্যয় ছিল ৪৪২৮ টাকা।
১৮৯৭ সালের প্রচন্ড ঘূর্ণিঝড়ের তান্ডবে ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে সমগ্র লাইট হাউস নড়বড়ে হয়ে যায়। ভবনের কাঠের মেঝে বাতাসের তীব্রতায় প্রায় ৭০ মিটার দূরে ছিটকে পড়ে। ভবনের টিনের তৈরি ছাদ আশপাশের মাঠে গিয়ে আছড়ে পড়ে। স্তূপাকৃত বড় বড় পাথর পর্যন্ত ছড়িয়ে-ছিটিয়ে যায়। লাইট হাউসের রক্ষকের বাসভবন সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়।
সালের ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছ্বাসে স্থায়ী ভাঙনে বিলীন হওয়ার আগপর্যন্ত এ বাতিঘর বিরামহীন আলো দেখিয়ে সমুদ্রগামী জাহাজের নাবিকদের প্রায়২২০ কিলোমিটার পর্যন্ত দিকনির্দেশনা দিত। পুরোনো সেই বাতিঘর সমুদ্রে বিলীন হয়েছে বহু আগে। এখনো ভাটার সময় সেই বাতিঘরের ধ্বংসাবশেষ জেগে উঠতে দেখা যায়। পাকিস্তান আমলে এই টাওয়ারটি নতুন করে নির্মাণ করা হয় লৌহ কাঠামোর উপর। প্রাচীন আলোক-উৎপাদন প্রক্রিয়া বাতিল করে আধুনিক পদ্ধতিতে চালু করা হয় আলোক উৎপাদন প্রক্রিয়া। পরে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে পাকিস্তান আমলেই এই বাতিঘরটি অকেজো হয়ে ক্রমাগত সমুদ্রের ভাঙ্গনের মুখে বাতিঘরটি একসময় বিলীন হয়ে যায়।
কক্সবাজারের এই বাতিঘর পর্যটকদের কাছে একটি আকর্ষণীয় স্থান হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। তাই প্রতিদিনই এখানে পর্যটকের ভিড় লেগেই থাকে। বিশেষ করে শীতের সময়, যখন নদী থাকে শান্ত ও শীতল। এ সময়ে পর্যটকরা একসাথে নৌকা ভ্রমণও উপভোগ করে থাকেন আর দেখে আসেন স্টিল ফ্রেমে ১৯৭২ সালে ইস্পাতের কৌণিক দন্ড ব্যবহার করে নির্মিত নতুন বাতিঘরটি।
কীভাবে যাবেন ঃ
কুতুবদিয়া যেতে হবে কক্সবাজারের বাসে। নামতে হবে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রোডের যাত্রাবিরতি স্থল ইনানী রিসোর্টের এক কিলোমিটার দক্ষিণে বড়ইতলী মোড়ে নতুন রাস্তার মাথায়। সেখান থেকে সিএনজিচালিত বেবিটেক্সিতে যেতে হবে মাগনামা ঘাট। মাগনামা ঘাট থেকে কুতুবদিয়া চ্যানেল পার হতে হবে ইঞ্জিন নৌকা অথবা স্পিডবোটে। ইঞ্জিন নৌকায় সময় লাগে ২০ থেকে ২৫ মিনিট আর স্পিডবোটে লাগে ১০ মিনিট। চ্যানেল পার হলে কুতুবদিয়া।
কোথায় থাকবেন আর খাবেন কোথায় :
কুতুবদিয়া দ্বীপে পর্যটকদের থাকার জন্য মানসম্মত একমাত্র আবাসন ব্যবস্থা হলো হোটেল সমুদ্রবিলাস। সমুদ্র উপকূলে গড়ে তুলা এই হোটেলে বসে উপভোগ করা যায় সমুদ্রের সৌন্দর্য। এখানে রয়েছে মানসম্মত খাবেরর জন্য বেলাভূমি রেস্টুরেন্ট। বাংলা,ইন্ডিয়ান এবং চাইনিজ খাবেরর অপার দিয়ে থাকে রেস্টুরেন্ট কর্তৃপক্ষ। বিভিন্ন সামূদ্রিক তাজা মাছের পাশাপাশি এখানে পাবেন সাদা ভাত, বিরিয়ানি, বিভিন্ন রকম ভর্তা, শুঁটকি আর সবজি। দেশি মাছ-মাংস তো আছেই।
তাহলে আর দেরি কেন? কবে যাচ্ছেন অন্য রকম এই বাতিঘর দেখতে?
Posted ২:১৪ অপরাহ্ণ | সোমবার, ২৭ জানুয়ারি ২০২০
coxbangla.com | Chanchal Chy