কক্সবাংলা ডটকম(২৬ এপ্রিল) :: শেয়ারবাজারে সংকট আরও বেড়েছে। ৫ আগস্টের পর দেশের অর্থনীতির অন্যান্য খাতে ইতিবাচক পরিবর্তন এলেও ব্যতিক্রম শুধু শেয়ারবাজার। বৃদ্ধি তো দূরের কথা, উল্টো প্রতিদিনই কমছে মূল্যসূচক ও বাজার মূলধন। কমছে তারল্যপ্রবাহ।
ঢাকার শেয়ারবাজার ডিএসইর প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স এখন ৫০০০ পয়েন্টের নিচে। টানা ৯ দিনের দরপতনে ২৩২ পয়েন্ট হারিয়ে সূচকটি নেমেছে ৪৯৭২ পয়েন্টে।
গত বছরের ২৮ অক্টোবর বা প্রায় ছয় মাস পর ফের এ সূচক বিনিয়োগকারীদের ‘মনস্তাত্ত্বিক বাঁধ-সীমা’ ৫০০০ পয়েন্ট পেরিয়ে নিচে নামল। সব কিছু মিলে শেয়ারবাজার গভীর খাদের কিনারায়। বাজারের এ অবস্থার পেছনে বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের (বিএসইসি) নেতৃত্বের দুর্বলতাকে দুষছেন সংশ্লিষ্টরা।
পুঁজিবাজারসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শীর্ষ কর্মকর্তাদের মতে, একদিকে বর্তমান কমিশনের শেয়ারবাজারের মতো টেকনিক্যাল খাতের ব্যাপারে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা নেই। অপরদিকে যোগ্য নেতৃত্বের মাধ্যমে সম্মিলিতভাবে পরিস্থিতি মোকাবিলার দক্ষতা নেই। পুরো কমিশন বাজার থেকে বিচ্ছিন্ন। তবে আলোচ্য সময়ে কমিশন বেশ কিছু কোম্পানিকে বড় ধরনের জরিমানা করেছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এ ঘটনায় মিডিয়া কাভারেজ ছাড়া তেমন কিছু অর্জিত হয়নি। কারণ এই জরিমানার টাকা আদায় হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই।বিভিন্ন ব্রোকারেজ হাউসসহ মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর শীর্ষ কর্মকর্তারা বলেন, সূচকের এমন পতনের কারণ বিনিয়োগকারীরা নতুন করে বিনিয়োগে আগ্রহ হারিয়েছেন।
শেয়ারবাজারে কী হচ্ছে বা আগামীতে কী হতে যাচ্ছে- এ বিষয়ে কোনো ধারণা পাচ্ছেন না তারা। ওই কর্মকর্তারা বলেন, শেয়ারবাজারের বর্তমান পতনের বড় কারণ- ‘নেতৃত্ব সংকট’। শেয়ারবাজারকে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছেন, তাদের সততা নিয়ে হয়তো কোনো প্রশ্ন নেই, তবে সংবেদনশীল এ বাজারকে নেতৃত্ব দেওয়ার সক্ষমতা রাখেন কিনা, তা নিয়ে প্রশ্ন আছে। জানতে
চাইলে দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলেন, গত আগস্টে দুর্নীতিগ্রস্ত শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর আট মাস কেটে গেছে। এখন রাষ্ট্রব্যবস্থার সর্বক্ষেত্রে সংস্কার কার্যক্রম চলছে।
বিনিয়োগকারীরা এখন জানতে চান শেয়ারবাজারে কী ধরনের সংস্কার হবে, ওই সংস্কার বিনিয়োগকারীবান্ধব হবে কিনা, এ জন্য কতটা সময় লাগবে, অতীতের দুর্নীতি ও অনিয়মের জন্য কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া হবে, তার জন্য শেয়ারবাজারের বিদ্যমান ব্যবস্থায় বড় কোনো পরিবর্তন আসবে কিনা? বর্তমান সময়ের প্রেক্ষাপটে এমন অনেক মৌলিক প্রশ্নের জবাব খুঁজছেন সবাই। কিন্তু উত্তর নেই।
এসব প্রশ্নের উত্তর নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির দেওয়ার কথা। কর্মকর্তারা জানান, সংস্থাটির নেতৃত্বে যারা আছেন, তাদের নানাভাবে বলা হলেও এ বিষয়ে মুখ খুলছেন না। সংস্কারের বিষয়ে সুপারিশ প্রণয়নে সাত মাস আগে টাস্কফোর্স গঠন হলেও শেয়ারবাজারে সুশাসন ফেরানো এবং যোগ্য নেতৃত্ব সংকট দূর করার বিষয়ে এখনও পর্যন্ত কোনো প্রস্তাব করতে পারেনি। ভবিষ্যতে এমন প্রস্তাব দিলেও তা বাস্তবায়নে কতদিন লাগবে, তা নিয়ে সন্দিহান সবাই। এর প্রভাব রয়েছে শেয়ারবাজারে।
পর্যালোচনায় দেখা গেছে, গত ৯ দিনের দর পতনে ৮৮ শতাংশ শেয়ারই দর হারিয়েছে। গত ৯ কর্মদিবসে তালিকাভুক্ত ৩৬০ কোম্পানির শেয়ার ও ৩৭ মেয়াদি মিউচুয়াল ফান্ডের মধ্যে ৩৪৯টির দর হারিয়েছে। এর মধ্যে কমপক্ষে ১০ থেকে ৩৯ শতাংশ পর্যন্ত দর হারিয়েছে ১৩০ শেয়ার, যেখানে মাত্র ৭টির দর ১০ শতাংশের ওপর বেড়েছে। একসময়ের হাজার কোটি টাকার লেনদেন নেমেছে তিনশ কোটির ঘরে। দেশের শেয়ারবাজারে এর আগে টানা ৯ দিন দরপতন হয়েছিল গত বছরের ১৩ থেকে ২৬ মে পর্যন্ত। তখন সূচকটি হারিয়েছিল প্রায় ৪৪৬ পয়েন্ট। অবশ্য গত বছরের টানা ৯ দিনে দরপতনের প্রেক্ষাপট আর এবারের দরপতনের প্রেক্ষাপট সম্পূর্ণ আলাদা।
গত বছরের মে মাসের দরপতন ছিল স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা সরকার পতনের মাত্র তিন মাস আগের ঘটনা। পতিত ওই সরকারের লাগামহীন দুর্নীতি ও অনিয়মের কারণে অর্থনীতি ভেতর থেকে যে ভেঙে পড়ার দশায় উপনীত হয়েছিল, তার স্বরূপ প্রকাশ হচ্ছিল। বৈদেশিক মুদ্রার সংকট তীব্র হয়ে উঠেছিল, যার কারণে আমদানি-রপ্তানি ব্যাপকভাবে ব্যাহত হচ্ছিল। অনেক আমদানি এলসির বিপরীতে অর্থ পরিশোধ করতে পারছিল না। ফলে রপ্তানি বাণিজ্য তো বটেই, অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য বড় সংকটে পড়ে।
ওই অবস্থায় শেয়ারবাজারের দরপতন ছিল অবশ্যম্ভাবী ঘটনা। তবে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে গত আগস্টে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর সে অবস্থার অনেকটাই বদল হয়েছে। দেশ পরিচালনায় অভিজ্ঞ না হওয়া সত্ত্বেও ড. ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকারের গত আট মাসে অর্থনীতি খারাপ দশা কাটিয়ে উঠেছে। বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে এখন আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হওয়ার খবর নেই। উল্টো আগের বকেয়া বিলের সিংহভাগ পরিশোধ হয়েছে। বন্ধ হয়েছে অর্থপাচার। ফলে দেশের ইতিহাসে রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স আসছে। এমন আশাবাদী ধারার কোনো প্রভাব শেয়ারবাজারে নেই।
বাজার বিশ্লেষণে দেখা যায়, গত সপ্তাহে দেশের প্রধান শেয়ারবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) সূচকের বড় পতনের মধ্য দিয়ে লেনদেন হয়েছে। এতে সপ্তাহের ব্যবধানে লেনদেনের সঙ্গে ডিএসইর বাজার মূলধন কমেছে ৭ হাজার ৮৬ কোটি টাকা। সপ্তাহ ব্যবধানে ডিএসইর বাজার মূলধন কমেছে ১ দশমিক ০৬ শতাংশ। গত সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসে ডিএসইর বাজার মূলধন দাঁড়িয়েছে ৬ লাখ ৬৩ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা। এর আগের সপ্তাহের শেষ কার্যদিবসে এ মূলধন ছিল ৬ লাখ ৭০ হাজার ৫৩৬ কোটি টাকা।
গত সপ্তাহে ডিএসইর সব কয়টি সূচকের পতন হয়েছে। প্রধান মূল্যসূচক ডিএসইএক্স কমেছে ১২৪ দশমিক ৭৩ পয়েন্ট বা ২ দশমিক ৪৫ শতাংশ। এ ছাড়া ডিএসই-৩০ সূচক কমেছে ৩০ দশমিক ৩৮ পয়েন্ট বা ১ দশমিক ৬২ শতাংশ। আর ডিএসইএস সূচক কমেছে ৩৯ দশমিক ০১ পয়েন্ট বা ৩ দশমিক ৪১ শতাংশ।
সপ্তাহজুড়ে ডিএসইতে ৩৯৬টি কোম্পানির শেয়ার ও মিউচুয়াল ফান্ড ইউনিটের লেনদেন হয়েছে। এর মধ্যে দাম বেড়েছে ৫৭টি কোম্পানির, কমেছে ৩২৪টির এবং অপরিবর্তিত রয়েছে ১৫টি কোম্পানির শেয়ারের দাম।
বাংলাদেশ ক্যাপিটাল মার্কেট ইনভেস্টর অ্যাসোসিয়েশনের (বিসিএমআইএ) সমন্বয়ক ও প্রধান মুখপাত্র মো. নুরুল ইসলাম মানিক বলেন, কার্যত দেশের শেয়ারবাজারে এই মুহূর্তে কোনো অভিভাবক আছে বলে মনে হয় না। গত আট মাসে পুঁজিবাজারের সূচক শুধু নিচেই নেমেছে, ওপরে ওঠেনি। এই সময় সূচক প্রায় ৯শ পয়েন্ট কমেছে। টানা এই দরপতনে প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকার মূলধন হারিয়েছেন বিনিয়োগকারীরা। দীর্ঘদিন ধরে শেয়ারবাজারে পতন চলতে থাকায় বাজারে বিনিয়োগকারীর সংখ্যা ১৮ লাখ থেকে কমে ৭ লাখে নেমে এসেছে। বিনিয়োগকারীদের অনেকে ৭০ থেকে ৮০ শতাংশ পুঁজি হারিয়েছেন।’
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের সাবেক সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট আহমেদ রশিদ লালী বলেন, শেয়ারবাজারে ভয়াবহ আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে। শেয়ারবাাজর উন্নয়নে গত আট মাসে কোনো ধরনের কাজ হয়নি। যেসব উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, তা বিপরীত ফল দিয়েছে। এতে আস্থার সংকট আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
Posted ১:২৮ পূর্বাহ্ণ | রবিবার, ২৭ এপ্রিল ২০২৫
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta