কক্সবাংলা ডটকম(২২ সেপ্টেম্বর) :: প্রবল গণআন্দোলনে শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর যোগ্য নেতৃত্বে দেশের অর্থবাজার অনেকটা ঘুরে দাঁড়ালেও সংকট থেকে বের হতে পারছে না পুঁজিবাজার। দেড় মাসের বেশি সময় অতিবাহিত হলেও চেয়ারম্যান ও পরিচালকদের নিয়োগ দিয়ে দুই স্টক এক্সচেঞ্জকে এখনো সচল করা সম্ভব হয়নি।
খোদ নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনে (বিএসইসি) নিয়োগপ্রাপ্তদের যোগ্যতা নিয়েও উঠছে প্রশ্ন। প্রধান পুঁজিবাজার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে (ডিএসই) স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দিতে তালগোল পাকিয়ে ফেলছে সংস্থাটি।
নিজ ক্ষমতায় এক্সচেঞ্জটিতে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দিতে এরই মধ্যে তিনবার ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন। এমনকি স্টক এক্সচেঞ্জসহ বাজার মধ্যস্থতাকারীদের প্রস্তাব অবমূল্যায়ন করায় কমিশনের সঙ্গে অন্তর্দ্বন্দ্বের তৈরি হয়েছে বাজার-সংশ্লিষ্ট অনেকের মধ্যে।
সরকার পতনের পর অর্থনীতিতে আলোচনার প্রধান বিষয়বস্তু হয়ে দাঁড়ায় ব্যাংকিং খাত সংস্কার এবং পুঁজিবাজারকে আস্থার জায়গায় ফেরানো। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংকিং খাত সংস্কারে অভিজ্ঞ অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুর বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হিসেবে নিয়োগ পেলেও পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির চেয়ারম্যান নিয়োগ দেওয়ার জন্য যোগ্য নেতৃত্ব খুঁজে পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়ে সরকারের জন্য।
প্রথমে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এম মাসরুর রিয়াজকে নিয়োগ দেওয়া হলে পূর্বের ফ্যাসিস্ট সরকারের নীতি নির্ধারকদের সঙ্গে তার সখ্য থাকার প্রশ্নে তিনি দায়িত্ব নিতে অপরাগতা প্রকাশ করেন।
এমন পরিস্থিতিতে বেসরকারি স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) খন্দকার রাশেদ মাকসুদকে চেয়ারম্যান করে বিএসইসির অন্যান্য কমিশনারের পদগুলোও পুনরায় নিয়োগ দিয়ে সাজানো হয়। এতে করে পূর্বের কমিশন থেকে যোগ্য ও অভিজ্ঞতা সম্পন্ন কমিশনার এ টি এম তারিকুজ্জামান এবং মোহাম্মদ মহসিন চৌধুরীসহ পূর্ণ পাঁচ সদস্যের কমিশন গঠন করা হয়।
এই পাঁচ সদস্যের মধ্যে কেবল এ টি এম তারিকুজ্জামানের সরাসরি পুঁজিবাজারের সঙ্গে দীর্ঘ বছরের কাজের অভিজ্ঞতা ছিল। তবে অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ সম্প্রতি এ টি এম তারিকুজ্জামানকেও তার পদ থেকে সরিয়ে দেয়।
এতে পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থাটি পুরোপুরি অনভিজ্ঞদের নিয়ে চলছে বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা। এমনকি অন্যদের পরামর্শ নিয়ে সমন্বয় করার মানসিকতাও কমিশনের বর্তমান নীতি নির্ধারকদের নেই বলে প্রশ্ন উঠেছে।
এ বিষয়ে পুঁজিবাজার বিশ্লেষক এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আল আমিন বলেন, ‘বর্তমান কমিশন হয়তো সবাইকে দুর্নীতিবাজ বা খারাপ ভাবছে। তাদের মনে রাখতে হবে, শেয়ারবাজারে কমিশন অভিভাবকতুল্য।
অভিভাবক যা করবেন, তাই ঠিক, অন্যদের কথা শোনা বা পরামর্শ নেওয়ার দরকার নেই– এমনটা যদি ভেবে থাকেন, তাহলে তা হবে খুবই ভুল চিন্তা। এমন চিন্তাধারা থেকে যত দ্রুত তারা বের হতে পারবেন, ততই সবার জন্য ভালো।’
আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রায় ১৫ বছরে (২০১১-২০) বিএসইসির দায়িত্বপ্রাপ্ত দুই চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এম খায়রুল হোসেন এবং অধ্যাপক শিবলী রুবাইয়াত-উল-ইসলামের সময়ে পুঁজিবাজার থেকে লাখো কোটি টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এতে তারল্য সংকট তৈরি হওয়ায় পুঁজিবাজার দীর্ঘ বছর ধরেই টালমাটাল আচরণ করছে।
এমন পরিস্থিতিতে সরকার পতনের পর পুঁজিবাজারকে খাদের কিনারা থেকে টেনে তুলতে যোগ্য নেতৃত্বের দাবি জানিয়ে আসছিল বাজার সংশ্লিষ্ট সর্বমহল ও বিনিয়োগকারীরা। কিন্তু দায়িত্বপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানসহ বর্তমান কমিশনের চার সদস্যের কমিশনার টিমে কারোই পুঁজিবাজার নিয়ে তেমন কোনো অভিজ্ঞতা নেই। তাই তো ডিএসইতে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ নিয়ে তালগোল পাকিয়ে বসছে তারা।
গত ১ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত কমিশন সভায় ডিএসইতে সাত স্বতন্ত্র পরিচালক পদে নিয়োগ দিয়ে আদেশ জারি করেছিল বিএসইসি। তবে ডিএসইর সাবেক এমডি মাজেদুর রহমান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ড. মো. হেলালউদ্দিন ডিএসইর পৃথক দুই ব্রোকারেজ হাউসের পরিচালক পদে দায়িত্ব পালনের তিন বছর অতিক্রম না করায় আইনের লঙ্ঘন হয় বলে প্রশ্ন ওঠে। এতে ডিএসইর স্বতন্ত্র পরিচালক পদে দায়িত্ব পালনে অপারগতা প্রকাশ করেন তারা।
পরবর্তীতে দ্বিতীয় দফায় তাদের স্থলে নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান হুদা ভাসী চৌধুরীর অংশীদার এ এফ নেসারউদ্দিন এবং জেড এন কনসালট্যান্টের প্রধান পরামর্শক সৈয়দা জাকেরিন বখ্ত নাসিরকে নিয়োগ দেয় বিএসইসি। কিন্তু নিরীক্ষা প্রতিষ্ঠান হুদা ভাসী চৌধুরী নিরীক্ষক এবং জেড এন কনসালট্যান্ট ডিএসইর পরামর্শক প্রতিষ্ঠান হওয়ায় আইন অনুযায়ী স্বার্থের সংঘাতের কারণে তারাও দায়িত্ব গ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করে।
তৃতীয় দফায় আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইপিডিসির সাবেক এমডি মোমিনুল ইসলাম এবং বহুজাতিক ওয়েলস ফার্গো ব্যাংকের সাবেক কান্ট্রি ম্যানেজার শাহনাজ সুলতানাকে ডিএসইর স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেয় বিএসইসি।
এ দফায়ও প্রশ্ন উঠেছে- আইপিডিসির সাবেক এমডির নিয়োগে আইনের লঙ্ঘন হয়েছে বলে। কেননা স্টক ডিমিউচুয়ালাইজেশন আইন ২০১৩-এর ৫ ধারার ‘কে’ উপধারায় বলা আছে- কেউ তালিকাভুক্ত কোম্পানির পরিচালক এবং কর্মকর্তা হিসাবে কাজ করে থাকলে তিনি স্টক এক্সচেঞ্জের স্বতন্ত্র পরিচালক হতে পারবেন না।
কিন্তু মোমিনুল ইসলাম এক বছর আগেও তালিকাভুক্ত কোম্পানি আইপিডিসির ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন। স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগে বারবার এমন ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ন্ত্রক সংস্থার অদক্ষতাকে ইঙ্গিত দেয় বলে মনে করছেন বাজার বিশ্লেষকরা।
এ বিষয়ে ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির স্কুল অব বিজনেস এডুকেশনের ডিন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মুসা বলেন, ‘স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগের ক্ষেত্রে যদি আইন ভেঙে থাকে তাহলে এটা ঠিক হয়নি। যারা আইন প্রয়োগ করবেন তারাই যদি আইন ভাঙেন তাহলে তো হয় না।’
তবে অধ্যাপক আল আমিন মনে করেন, ‘যারা নিয়োগ দিচ্ছে তারা নতুন হওয়ার কারণে এই বিষয়গুলো তৈরি হচ্ছে।’ এ ক্ষেত্রে ডিএসইর মালিকানায় যারা রয়েছেন, তাদের সঙ্গে বর্তমান কমিশনের অফিশিয়ালি সমন্বয়ের অভাব রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যেহেতু স্টক এক্সচেঞ্জের আগের পর্ষদ পুরোপুরি বিলুপ্ত করে দেওয়া হয়েছে, সেহেতু নিয়ন্ত্রক সংস্থা এবং স্টক এক্সচেঞ্জ বসে একটা ডায়ালগের আয়োজন করে সমন্বিত একটা বোর্ড গঠন করার সুযোগ ছিল।’
এদিকে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগের বিষয়টি নিয়ে শুরু থেকেই বিএসইসির সঙ্গে ডিএসইর মনোমালিন্য বা বিতর্ক তৈরি হয়। কারণ, ডিএসইর মতামত ছাড়াই এককভাবে বিএসইসির পক্ষ থেকে সংস্থাটিতে সাতজন স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়। অবশ্য কমিশনের পক্ষ থেকে ডিএসইর কাছে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগের পূর্বেই নাম চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু নিয়োগ দেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের সুপারিশ আমলে নেয়নি বিএসইসি।
যদিও স্টক এক্সচেঞ্জের মালিকানা থেকে ব্যবস্থাপনা পৃথক্করণ বা ডিমিউচুয়ালাইজেশন আইন অনুযায়ী ডিএসইর স্বতন্ত্র পরিচালক নির্ধারণের দায়িত্ব সংস্থাটির নমিনেশন অ্যান্ড রেমুনারেশন কমিটির (এনআরসি) হাতে ন্যস্ত। তবে সরকার পতনের পর সৃষ্ট পরিস্থিতিতে বাজারের উন্নয়নে এক্সচেঞ্জটিতে স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ দিতে ডিএসইসহ বাজার মধ্যস্থতাকারীদের সঙ্গে আলোচনা করে সুষ্ঠু পথ বের করা যেত বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
এ বিষয়ে ডিএসইর শীর্ষ এক ব্রোকারেজ হাউসের এমডি বলেন, ‘কমিশন এখন পূর্ণ পর্ষদ নেই– এমন অজুহাত দিচ্ছে। অথচ ডিএসইর বোর্ড অ্যান্ড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন রেগুলেশনস ২০১৩ এর ৩(১) (এফ) ধারায় স্পষ্ট বলা আছে, কোনো ক্যাটাগরির পরিচালকদের পদ শূন্য থাকায় পর্ষদের কোনো কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হবে না। স্বতন্ত্র পরিচালক না থাকার পরও পর্ষদে ছয় পরিচালক ছিলেন। তাদের সুপারিশ বা আলোচনা ছাড়া স্বতন্ত্র পরিচালক নিয়োগ নিয়ে শুরুতেই প্রধান স্টেকহোল্ডারের সঙ্গে অস্বস্তিকর পরিবেশ তৈরি হয়েছে।’
Posted ১২:৩৮ অপরাহ্ণ | সোমবার, ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta