আবু তাহের,সমকাল(২০ আগস্ট) :: মেজর (অব.) সিনহা মো. রাশেদ খান হত্যা মামলার প্রধান দুই আসামি টেকনাফ থানার বরখাস্ত ওসি প্রদীপ কুমার দাশ ও বাহারছড়া পুলিশ তদন্ত কেন্দ্রের সাবেক ইনচার্জ লিয়াকত আলীকে জিজ্ঞাসাবাদ করে এ হত্যাকাণ্ডের স্বচ্ছ একটি চিত্র পেয়েছেন তদন্তকারীরা। এখন এ দুই আসামির বক্তব্যের সঙ্গে আলামতগুলো মিলিয়ে দেখা হচ্ছে।
সূত্র জানায়, ওসি প্রদীপ কুমার জিজ্ঞাসাবাদে এই হত্যাকাণ্ডের দায় চাপাতে চেয়েছেন লিয়াকতের ওপর। তবে ঘটনার আগে ও পরে লিয়াকতের সঙ্গে তার ফোনকলের অডিও রেকর্ড শোনানো হলে চুপসে যান প্রদীপ। পরে লিয়াকত ও প্রদীপকে সামনাসামনি এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। তখন দু’জনই ঘটনায় নিজেদের সংশ্নিষ্টতা নিয়ে বিস্তারিত বিবরণ দেন তদন্ত কর্মকর্তার কাছে।
তদন্তকারী সংস্থা র্যাবের একটি সূত্র এসব তথ্য দিয়েছে। তবে তদন্ত কর্মকর্তা এ বিষয়ে আর কথা বলতে রাজি হননি।
সিনহা হত্যা মামলার তিন শীর্ষ আসামি প্রদীপ কুমার দাশ, লিয়াকত আলী এবং এসআই নন্দ দুলাল রক্ষিতের রিমান্ডের তৃতীয় দিন বৃহস্পতিবার শেষ হয়েছে। এদিকে, সিনহার মৃত্যুর ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটিকে আরও সাত দিন সময় দেওয়া হয়েছে।
র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ সাংবাদিকদের বলেন, সিনহা হত্যা মামলায় রিমান্ডে থাকা আসামিরা চাঞ্চল্যকর ও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়েছেন। তাদের তথ্য যাচাই-বাছাই করে তদন্ত কর্মকর্তা ঘটনার একটি পরিস্কার চিত্র পেয়েছেন।
তিনি বলেন, মামলাটি অত্যন্ত স্পর্শকাতর, গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ। তাই অত্যন্ত সতকর্তা ও পেশাদারিত্বের সঙ্গে তদন্ত কার্যক্রম এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এরই মধ্যে এ মামলায় ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এই হত্যা মামলার গুরুত্বপূর্ণ আসামি প্রদীপ কুমার দাশ, লিয়াকত আলী, নন্দ দুলাল রক্ষিতসহ গ্রেপ্তার অন্যান্য আসামিকে রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদ, প্রত্যক্ষদর্শীর বক্তব্য, আলামতসহ সংশ্নিষ্ট সবকিছু যাচাই-বাছাই করে মামলাটির তদন্ত কার্যক্রম এগিয়ে চলছে।
আশিক বিল্লাহ বলেন, সিনহার বোনের মামলার ৯ আসামির মধ্যে সাতজন গ্রেপ্তার হয়েছে। বাকি দু’জনের পরিচয় শনাক্তের জন্য পুলিশ সুপার কার্যালয়ে আবেদন করেছেন তদন্ত কর্মকর্তা।
টেকনাফ থানা থেকে সিসিটিভি ফুটেজ গায়েব প্রসঙ্গে র্যাবের মিডিয়া প্রধান বলেন, অঘটন ঘটলে যে কেউ এমন ঘটনা ঘটায়। থানার সিসিটিভি ফুটেজ গায়েবও এমন ঘটনা। সিসিটিভি ফুটেজ পাওয়ার জন্য আমরা আদালতের কাছে আবেদন করেছি। আশা করছি, তা-ও পেয়ে যাব।
এদিকে সিনহা হত্যায় নিহতের বোনের দায়ের করা মামলায় চার পুলিশ সদস্যসহ সাতজনকে রিমান্ড শেষে বৃহস্পতি সকালে আদালতে পাঠিয়েছে র্যাব। আদালতে আসামিদের পক্ষ থেকে জামিন চাওয়া হয়নি। অন্যদিকে, তদন্ত কর্মকর্তার পক্ষ থেকেও ফের রিমান্ডের আবেদন জানানো হয়নি। কক্সবাজারের জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম আদালত-৪-এর বিচারক তামান্না ফারাহ তাদের কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
আদালতে সোপর্দ করা চার পুলিশ সদস্য হলেন- এএসআই লিটন মিয়া, কনস্টেবল সাফানুর করিম, কামাল হোসেন ও আবদুল্লাহ আল-মামুন। এ ছাড়া অন্য তিনজন পুলিশের দায়ের করা মামলার সাক্ষী ছিলেন। তারা হলেন- টেকনাফের বাহারছড়া ইউনিয়নের মারিশবুনিয়া এলাকার বাসিন্দা নুরুল আমিন, নেজামুদ্দিন ও মোহাম্মদ আয়াজ। গত ১২ আগস্ট আদালত তাদের প্রত্যেকের সাত দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
অপরদিকে হঠাৎ কক্সবাজার সদর থানার ওসি খায়রুজ্জামানকে শিল্প পুলিশ ও টেকনাফ থানার ওসি আবুল ফয়সলকে এপিবিএনে বদলি করা হয়েছে। এর মধ্যে খায়রুজ্জামানকে কক্সবাজার থানায় যোগদানের ৩ দিন পর ও টেকনাফ থানার ওসি ফয়সলকে ১০ দিন পরই বদলি করা হলো। কুমিল্লা থেকে বদলি হয়ে ওসি প্রদীপ কুমার দাশের স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন আবুল ফয়সল।
পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা জানান, শিগগিরই ওই দুই থানায় নতুন ওসি নিয়োগ দেওয়া হবে। কর্তৃপক্ষ মনে করছে, সেখানে আরও যোগ্য ব্যক্তিকে নিয়োগ দেওয়া দরকার। তাই দুই ওসিকে বদলি করা হয়েছে।
গাড়ি ও অন্যান্য আলামত র্যাবকে হস্তান্তর : নিহত মেজর (অব.) সিনহা রাশেদের সহকর্মী সিফাত ও শিপ্রার জব্দ করা মালামাল তদন্তের স্বার্থে কক্সবাজারের রামু থানা পুলিশের কাছ থেকে বুঝে নিয়েছে র্যাবের তদন্ত দলের প্রতিনিধিরা।
বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১০টার পর এসব মালামাল বুঝে নিতে র্যাবের প্রতিনিধি দল রামু থানায় যায়।
র্যাব-১৫ এর টেকনাফ ক্যাম্প কমান্ডার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার বিমান চন্দ্র কর্মকার বলেন, আমরা পুলিশের কাছ থেকে যাবতীয় মালামাল বুঝে নিয়েছি।
রামু থানার ওসি আবুল খায়ের বলেন, র্যাবের দলটি আসার পর আমরা এসব জব্দকৃত মালামাল আদালতের আদেশ অনুযায়ী তাদের হাতে বুঝিয়ে দেই।
এরআগে, ১৯ আগস্ট (বুধবার) র্যাবের এক আবেদনের প্রেক্ষিতে এ সংক্রান্ত আদেশ দেন সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট তামান্না ফারাহ এর বেঞ্চ।
গত ৩১ জুলাই (শুক্রবার) রাত সাড়ে ১০টার দিকে টেকনাফের মেরিন ড্রাইভ সড়কে একটি প্রামাণ্যচিত্রের শুটিং শেষে ফেরার পথে পুলিশের গুলিতে সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত মেজর সিনহা রাশেদ নিহত হন। এসময় তার সাথে থাকা সহযোগী সিফাত ও পরবর্তীতে রিসোর্টে অভিযান চালিয়ে তার আরেক সহযোগী শিপ্রা দেবনাথকে আটক করে পুলিশ। এরপর তাদের কাছে থাকা ল্যাপটপ, ক্যামেরাসহ যাবতীয় মালামাল জব্দ করে পুলিশ। সেইসাথে তাদেরকে অভিযুক্ত করে হত্যাচেষ্টা ও মাদকের মামলা দায়ের করে পুলিশ। এঘটনার পর পুলিশের বিরুদ্ধে হত্যার অভিযোগ উঠলে পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন নিহত মেজর (অব.) সিনহার বোন। পরবর্তীতে এই মামলার তদন্তভার র্যাবের কাছে দেয় আদালত।
এছাড়া হত্যাকাণ্ডের সময় মেজর (অব.) সিনহার ব্যবহূত ব্যক্তিগত গাড়িটি র্যাবের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। গাড়ি থেকে জব্দ অন্য আলামতও র্যাবকে দেওয়া হয়েছে। পুলিশ সুপারের অফিস থেকে বুধবার রাতে র্যাবের কাছে গাড়ি ও এসব মালপত্র হস্তান্তর হয়েছে বলে সংশ্নিষ্ট সূত্র জানিয়েছে।
এদিকে সিনহার মৃত্যুর ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় গঠিত তদন্ত কমিটির রিপোর্ট পেশ পিছিয়ে যাচ্ছে। ২৩ আগস্ট প্রতিবেদন দেওয়ার কথা থাকলেও এখনও সাবেক ওসি প্রদীপকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারেননি তারা। তাই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আরও সাত দিন সময় চেয়েছে কমিটি। মন্ত্রণালয় এ আবেদন মঞ্জুর করেছে।
তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক চট্টগ্রামের বিভাগীয় অতিরিক্ত কমিশনার মিজানুর রহমান এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেন, আসামিদের মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ একজন ওসি প্রদীপ কুমারকে এখনও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়নি। এ জন্য অন্তত আরও এক সপ্তাহ সময় প্রয়োজন। এ ঘটনার বিচার-বিশ্নেষণ করে আগামীতে এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঠেকাতে কমিটি সুপারিশ দেবে বলেও জানান তিনি।
Posted ২:৪৬ পূর্বাহ্ণ | শুক্রবার, ২১ আগস্ট ২০২০
coxbangla.com | Chanchal Chy