কক্সবাংলা ডটকম(২৮ নভেম্বর) :: গত শুক্রবারের (২৪ নভেম্বর) কথা। ডজন দুয়েক ‘জঙ্গি’ মিসরের সিনাই উপদ্বীপে ইতিহাসের ভয়াবহতম হত্যাকাণ্ড চালাল। তাদের বর্বরতায় ৩০৫ জন লোকের প্রাণ গেল। সুফি সম্প্রদায়কে টার্গেট করে তারা এই হামলা চালায়, যারা সেখানকার রাওয়াদা মসজিদে নামাজ আদায় করে।
মিসর ও অন্যত্র তথাকথিত উগ্রবাদী জিহাদিদের নির্মম হামলার শিকার হচ্ছে সুফিবাদীরা। কিন্তু কেন?
সুফিবাদ বা তাসাউউফ এমন একটি বিষয়, যা স্রষ্টা সম্পর্কে গভীর জ্ঞানার্জন বা স্রষ্টাকে বুঝতে প্রার্থনা, তপস্যা, গান এমনকি নাচের মাধ্যমে চর্চা করা হয়। সুফিবাদের একটি অন্যতম প্রচলিত বিষয় হলো দরবেশ, যারা আল্লাহর নাম বার বার উচ্চারণের (জিকের) মাধ্যমে নিজেদের আত্মার প্রশান্তি লাভ করেন।
যারা সুফিবাদের অনুশীলন করেন তাদের একটি তরিকা বা পথ থাকে। তাদের এক একটা গ্রুপ থাকে এবং গ্রুপের একজন মোর্শেদ বা নির্দেশক থাকেন।
তবে ‘সুফিজম: এ বিগিনার’স গাইড,’ ইট ইজ ‘এন ইন্টেরিওরাইজেশন অ্যান্ড ইনটেন্সিফিকেশন অব ইসলামিক ফেইথ এন্ড প্রাকটিস’ বইয়ের লেখক উইলিয়াম চিত্তিকের মতে, সুফিবাদ আলাদা কোনো সেক্টর বা সম্প্রদায় নয়।
অবশ্য সুফিবাদের উৎপত্তিগত বিষয় নিয়ে মতপার্থক্য রয়েছে। কেউ কেউ মনে করেন, আরবি শব্দ সুফ (suf) থেকে এটি এসেছে। এর অর্থ পশমের কাপড়। এই পোশাক পরার মাধ্যমে সুফিবাদের অনুসারীরা যে দুনিয়া বিমুখ তা বোঝানো হয়। অন্যরা মনে করেন, সুফি শব্দটি এসেছে সাফ (saf) শব্দ থেকে, যার অর্থ পদ বা মর্যাদা। এর মাধ্যমে বোঝানো হয় যে, তারা আল্লাহর সবচেয়ে কাছের। আরেকটি পক্ষ মনে করেন, সুফি শব্দটি গ্রিক শব্দ সোফিয়া (sofia) থেকে এসেছে, যার অর্থ প্রজ্ঞা বা জ্ঞান।
অর্থ যাই হোক, সুফিবাদ ইসলামি শিল্প-সাহিত্য এবং সঙ্গীত ও স্থাপত্যে একটি বড় জায়গা দখল করে আছে। ত্রয়োদশ শতকে পার্সিয়ান কবি ও সুফি জালালউদ্দিন রুমির মাধ্যমে সুফিবাদ আমেরিকায় ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। তার অনেক গান, কবিতা বা অন্যান্য সাহিত্য কর্ম ইংরেজিতে অনুবাদ করা হয়েছে। এমনকি প্রখ্যাত মার্কিন শিল্পী ম্যাডোনাও তার গান গেয়েছেন। এক সময় সুফিবাদীরাই মুসলিম খিলাফত পরিচালনা করেছেন।
বিশ্বব্যাপী সুফিদের সংখ্যা নিয়ে নির্ভরযোগ্য কোনো তথ্য নেই। তবে সুফিদের বড় অংশই সংখ্যাগরিষ্ঠদের সুন্নি ইসলামের অনুসারী।
বিশ্বের বেশিরভাগ মুসলমান সুন্নি ইসলামে বিশ্বাসী। যা প্রায় মোট মুসলামানের ৮৫ থেকে ৯০ শতাংশ। মিসর, সৌদি আরব ও বেশির আরব দেশ এবং অ-আরব তুরস্ক ও আফগানিস্তান সুন্নি সংখ্যাগরিষ্ঠ। এ ছাড়া ফিলিস্তিন ও পশ্চিম আফ্রিকার বেশিরভাগ দেশই সুন্নি অধ্যুষিত।
মুসলমানদের দ্বিতীয় বৃহত্তম গ্রুপ হলো শিয়া। ইরান একমাত্র দেশ যেটি সবচেয়ে শিয়া সংখ্যাগরিষ্ঠ। দেশটি চালান শিয়া নেতারা। এ ছাড়া ইরাক, লেবানন ও বাহরাইনের জনগণের একটা বড় অংশ শিয়া।
সুন্নি ও শিয়ারা একই কুরআন এবং ইসলামের পাঁচটি স্তম্ভ অনুসরণ করেন। সুন্নী ও শিয়াদের মধ্যে যে মতভেদ তা ঐতিহাসিক ও রাজনৈতিক। ইসলামের প্রাথমিক যুগ তথা নবী (সা.) এর পর খিলাফতের যুগ থেকেই এটি চলে আসছে।
সুফিবাদ সালাফিবাদের প্রায় ঠিক উল্টো। কারণ সালাফিবাদের অনুসারীরা অনেকটা উগ্রবাদী, যেমন ইসলামিক স্টেট বা আলকায়েদা। কেউ কেউ অবশ্য সালাফিবাদকে প্রকৃত ইসলাম হিসেবে মনে করেন। সালাফিবাদের অনুসারীরা মনে করেন, সুফিরা পৌত্তলিক ও ধর্মত্যাগী এবং তাদের হত্যা করা যায়। সেইসঙ্গে সুফিদের উপাসনালয়গুলোকে তারা মূতি পূজা তথা পৌত্তলিকতার স্থান বলে মনে করেন।
আর এ কারণেই সুফি ও তাদের স্থাপনাগুলোতে হামলাকে রুটিন ওয়ার্ক মনে করছে তথাকথিত জিহাদিরা।
২০১১ সালে পাকিস্তানের শেখ সারোয়ার মাজারে আত্মঘাতি হামলা চালিয়ে ৪১ জন সুফিকে হত্যা করা হয়। নিহতরা তিন দিনব্যাপী একটি উৎসবের জন্য সেখানে একত্র হয়েছিল। এ ছাড়া চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে একই ধরনের হামলায় দেশটিতে ৮০ জনের মৃত্যু হয়। এর এক বছরের বেশি সময় পর শাব আল ধামানি নামের একটি মাজার গুরিয়ে দেওয়া হয়। অন্যদিকে, মালিতে আল কায়েদার আনসার দাইন গ্রুপ কয়েকশ বছরের পুরনো একটি সমাধি ধ্বংস করে দেয়।
সে রকমই একটি ঘটনা ঘটল মিসরের সিনাই উপদ্বীপে। যেখানে বছরের পর বছর অনেক মাজার ধ্বংসস্তূপে পরিণত করা হয়েছে। অথচ দেশটির বিশ্বখ্যাত শিক্ষা-প্রতিষ্ঠান আল-আজহার বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা করেন একজন সুফি। তাছাড়া দেশটির সুফি নেতাদের সঙ্গে সরকারেরও ঘনিষ্ঠতা রয়েছে।
তবে ইসলামিক স্টেটের অধীনে সুফিদের ওপর হামলার ঘটনা বেড়েছে। শুধু হামলা বা মাজার ধ্বংস নয়, এক বছর আগে আইএস যোদ্ধারা সুলাইমান আবু হাজর নামের এক সুফি পণ্ডিতের শিরচ্ছেদ করেছে।
এ ঘটনার কয়েক সপ্তাহ পর এক আইএস নেতা সুফিদের ইঙ্গিত করে বলেন, তারা শিরক ও বিদাতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। এ ছাড়া সরকারের সঙ্গে ওই পণ্ডিতের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে বলেও অভিযোগ করেন আইএসের ওই নেতা।
নাম না জানা এক পুলিশ প্রধান বলেন, ‘আমরা সকল সুফিদের বলতে চাই, আমরা বিশেষভাবে সিনাই এবং সাধারণভাবে মিসরে সুফিবাদ সহ্য করব না।’
সুফিদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, ‘আপনাদের জানা উচিত, আপনারা বহুঈশ্বরবাদী ও নাস্তিক এবং আপনাদের রক্ত আমাদের জন্য অপবিত্র।’
লস অ্যাঞ্জেলস টাইমস।
Posted ২:৪৪ পূর্বাহ্ণ | মঙ্গলবার, ২৮ নভেম্বর ২০১৭
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta