বিশেষ প্রতিবেদক :: দেশে অবকাশকালীন ভ্রমণের জন্য পর্যটকদের শীর্ষ পছন্দের তালিকায় রয়েছে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত ও প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন। এ কারণে হোটেল-মোটেলসহ পর্যটনকেন্দ্রিক বিভিন্ন বিনিয়োগও সেখানেই হয়েছে সবচেয়ে বেশি।
আবার সঠিক পরিকল্পনা ও নজরদারির সীমাবদ্ধতায় এ দুই এলাকায় পরিবেশগত ক্ষতিও হয়েছে মারাত্মক আকারে।
এর মধ্যে অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও বৈচিত্র্যে ভরপুর দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন এখন চরম সংকটে। অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণের ফলে সেখানকার বাস্তুসংস্থানে এরই মধ্যে ব্যাপকভাবে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে।
ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার ফলে সেন্ট মার্টিনের পরিবেশের ওপর পড়ছে বিরূপ প্রভাব। প্রতিনিয়ত কমে যাচ্ছে প্রবালের পরিমাণ। কমছে গাছপালা আচ্ছাদিত অঞ্চলের পরিমাণ, নষ্ট করা হচ্ছে প্রাকৃতিকভাবে বেড়ে উঠা কেয়া বন। একদিকে যেমন পর্যটন সম্ভাবনা বিকশিত হয়েছে অন্যদিকে হচ্ছে পরিবেশের বিপর্যয়।
দ্বীপে প্রবালের পরিমাণ কমেছে প্রায় দুই তৃতীয়াংশ
যে প্রবালকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে স্বচ্ছ জলধারার এই দ্বীপ সেটিই এখন শূন্য হওয়ার পথে। গত চার দশকে এই দ্বীপে প্রবালের পরিমাণ কমেছে প্রায় দুই তৃতীয়াংশ। অথচ শুধুমাত্র এই প্রবালের ওপর ভিত্তি করেই গড়ে উঠেছে এই দ্বীপ। প্রবাল কমে যাওয়ায় এই দ্বীপের আয়তনও কমা শুরু হয়েছে।
পরিবেশ বিজ্ঞানীদের ধারণা, এভাবে চলতে থাকলে ২০৪৫-৫০ সালের মধ্যে সেন্ট মার্টিন দ্বীপ প্রবালশূন্য হয়ে বঙ্গোপসাগরে তলিয়ে যাবে।
সূত্র জানায়, গত ৩ বছর ধরে সেন্ট মার্টিনে হোটেল-মোটেল ও আবাসিক স্থাপনা আশঙ্কাজনকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের ছোট ছোট স্থাপনা, দোকানপাট উচ্ছেদ করে প্রভাবশালীদের দখলে দেওয়া হয়েছে।
একই স্থানে দেড় শতাধিক অবৈধ হোটেল ও কটেজ গড়ে তোলা হয়েছে। প্রতিনিয়ত অতিরিক্ত পর্যটকের চাপ সামলাতেই এই স্থাপনাগুলো গড়ে উঠছে।
ফলে প্রাকৃতিক পরিবেশ বিপন্ন হচ্ছে এবং নষ্ট হচ্ছে জীববৈচিত্র্য। প্রবাল পাথরগুলোকে ভেঙে হোটেল নির্মাতাদের কাছে বিক্রি করছেন স্থানীয় মানুষজন। যা সেন্ট মার্টিনের অস্তিত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ। অল্প কিছু টাকার জন্য তারা নিজেদের আবাসস্থলকে ফেলছে অসম্ভব বড় ঝুঁকিতে।
সৈকত দখল করে এভাবে গড়ে উঠছে ভবন।
অভিযোগ রয়েছে, পরিবেশ রক্ষার নামে সরকার ও প্রশাসনের কৌশলগত উদাসীনতা, আর প্রভাবশালী মহলের দখলদারি মিলে দ্বীপটির প্রাকৃতিক ভারসাম্য বিপন্ন করে তুলেছে।
এছাড়া বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়হীনতার কারণে সেন্ট মার্টিনের মতো নাজুক বাস্তুসংস্থানসংবলিত দ্বীপকে বাঁচাতে কোনো ব্যবস্থা নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। দ্বীপটিতে যেকোনো ধরনের স্থাপনা গড়ে তোলার ওপর সরকারি নিষেধাজ্ঞা থাকলেও সেগুলো উপেক্ষা করেই গড়ে উঠছে একের পর এক রিসোর্ট, হোটেল, মোটেল।
জীববৈচিত্র্য রক্ষায় ১৯৯৯ সালে সেন্ট মার্টিন দ্বীপকে সরকার পরিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা ঘোষণা করেছিল। প্রায় আট বর্গকিলোমিটার এলাকায় দ্বীপটিতে স্থায়ী প্রায় নয় হাজার বাসিন্দার বিপরীতে দৈনিক ভিড় করছে গড়ে আট হাজারের বেশি পর্যটক। ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত মানুষের চাপ ঠেকাতে সেন্ট মার্টিন ভ্রমণের ক্ষেত্রে ১৪টি বিধিনিষেধ জারি করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর। যদিও প্রতিনিয়তই সেগুলো লঙ্ঘন করা হচ্ছে।
সৈকত দখল করে এভাবে গড়ে উঠছে ভবন।
স্থানীয়রা বলছেন, প্রশাসনের একের পর এক ‘ঢাকঢোল পেটানো’ অভিযানের নামে লোক দেখানো কার্যক্রম চলছে। দ্বীপের কেয়াবন ধ্বংস করে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। এমনকি সরকারি সংস্থাগুলোও পরিবেশ আইন লঙ্ঘন করে বহুতল ভবন নির্মাণে যুক্ত হয়েছে। সরেজমিন গিয়ে এসব তথ্য মিলেছে।
বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপক প্রভাব পড়েছে সেন্টমার্টিনে। সরকারের পক্ষ থেকে সেন্টমার্টিন রক্ষায় নানা বিধিনিষেধ ও কঠোরভাবে তা প্রয়োগের কথা বলা হলেও বাস্তবতা বলছে ভিন্ন কথা। গত ৩ বছরে দেড় শতাধিক অবৈধ হোটেল, কটেজ ও স্থাপনা গড়ে তোলা হয়েছে।
সরেজমিন গিয়ে সৈকতের উত্তর অংশে দ্বীপ রক্ষার সারিবদ্ধ বিশাল কেয়াবনের কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। সৈকতের বিশাল জায়গা দখল করে নির্মাণ করা হয়েছে বিলাসবহুল হোটেল প্রাসাদ প্যারাডাইস, সি-হেভেন এবং পুলিশের বিশাল ভবন। এসব স্থাপনা নির্মাণে সৈকত দখলের পাশাপাশি কেয়াবন উজাড় করা হয়েছে। কেয়াবন দ্বীপের প্রাকৃতিক রক্ষাবলয় হিসাবে কাজ করে।
স্থানীয় বাসিন্দা নুরুল আলম ও আবু বক্কর অভিযোগ করে বলেন, উচ্ছেদের নামে সৈকত থেকে স্থানীয় গরিবদের ক্ষুদ্র দোকানপাটগুলো তুলে দিয়েছে প্রশাসন। পরে সেসব স্থানে প্রভাবশালী ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো বহুতল ভবন নির্মাণ করেছে।
সৈকত দখল করে এভাবে গড়ে উঠছে ভবন।
সরেজমিন দেখা যায়, সেন্টমার্টিনে সরকারি সংস্থাগুলো কে কার চেয়ে বড় স্থাপনা করা যায় যেন সে প্রতিযোগিতায় নেমেছে। সেসব সরকারি সংস্থাগুলো হলো পরিবেশ অধিদপ্তর, পুলিশ, বিজিবি এবং কোস্টগার্ড। এমনকি প্রশাসনের কর্মকর্তারাও নিজেদের জন্য বহুতল ভবন নির্মাণ করছেন।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কক্সবাজার জেলার সাধারণ সম্পাদক কলিম উল্লাহ বলেন, সেন্টমার্টিন রক্ষার নামে প্রশাসন ও প্রভাবশালীরা ধ্বংসের প্রতিযোগিতায় মেতে উঠেছে। একদিকে স্থাপনা উচ্ছেদের নামে প্রচার-প্রচারণা চালিয়ে ছোট ছোট ঝুপড়িঘর ও দোকানপাট উচ্ছেদ করা হচ্ছে।
অন্যদিকে, একই স্থানে বড় বড় ভবন নির্মাণের সুযোগ দেওয়া হচ্ছে। গত ৩ বছরে এখানে দেড় শতাধিক বহুতল ভবন গড়ে উঠেছে। কলিম উল্লাহ আরও উল্লেখ করেন, পরিবেশ অধিদপ্তর, বিজিবি, পুলিশ ও কোস্টগার্ডও এখানে ভবন নির্মাণে জড়িত। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে যেন ভবন নির্মাণের এক প্রকার প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে।
সৈকত দখল করে এভাবে গড়ে উঠছে ভবন।
অভিযোগের দায় স্বীকার করে ব্যর্থতার জন্য আওয়ামী লীগ সরকার ও সাবেক মন্ত্রী-সচিবদের দুষলেন পরিবেশ অধিদপ্তরের কক্সবাজারের পরিচালক মুহাম্মদ সোলায়মান হায়দার।
তিনি বলেন, বিগত সরকারের সেন্টমার্টিন রক্ষার জন্য যতগুলো সিদ্ধান্ত হয়েছে, তা মন্ত্রী-সচিবদের প্রভাবের কারণে বাস্তবায়ন সম্ভব না হওয়ায় সেন্টমার্টিন আজ ধ্বংসের শেষ সীমানায় দাঁড়িয়ে আছে।
জানতে চাইলে কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহাম্মদ সালাহউদ্দিন বলেন, আমি দায়িত্ব নিয়েছি বেশিদিন হয়নি। অনেক কিছু আমার অজানা ছিল। এখন খোঁজ নিয়ে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
সৈকতজুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা ময়লা-আবর্জনা
পরিবেশ অধিদপ্তর জানায়, সরকার ১৯৯৯ সালের ১৯ এপ্রিল ৫২৯ হেক্টর আয়তনের সেন্ট মার্টিন দ্বীপকে প্রতিবেশ সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করে। গত ৪ জানুয়ারি সরকার বন্য প্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা) আইন ২০১২-এর ক্ষমতাবলে দ্বীপের অতিরিক্ত ১ হাজার ৭৪৩ বর্গ কিলোমিটার এলাকার ৭০ মিটার গভীরতা পর্যন্ত এলাকাকে ‘সেন্ট মার্টিন মেরিন প্রটেক্টেড এলাকা’ ঘোষণা করে।
কিন্তু সেন্ট মার্টিনে পর্যটকের যাতায়াত সীমিতকরণ, অনলাইনে নিবন্ধন এবং পর্যটকদের মাথাপিছু টাকা আদায়ের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করে আসছে জাহাজ মালিকদের সংগঠন সি ক্রুজ অপারেটরস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ, ট্যুর অপারেটরস অ্যাসোসিয়েশন এবং হোটেল-কটেজ ব্যবসায়ীরা।
নতুন করে চলছে রিসোর্ট নির্মাণের কাজ।
Posted ৩:১০ অপরাহ্ণ | সোমবার, ১৬ ডিসেম্বর ২০২৪
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta