মো. আবদুর রহিম(১২ ফেব্রুয়ারি) :: আমার শিক্ষকতা জীবনের প্রজ্ঞাবান প্রিয় সহকর্মী আলহাজ্ব এএমএম আনোয়ার শাহ। গত ০৮ ফেব্রুয়ারি ২০২০ তারিখ তিনি মহান রাব্বুল আলমীনের দরবারে হাজিরা দেওয়ার জন্য অগণিত প্রিয় মানুষকে শোকাহত করে না ফেরার দেশে চলে যান। তিনি কক্সবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে সাবেক শিক্ষক। আদর্শ শিক্ষক হিসেবে তাঁর সুখ্যাতি রয়েছে। তিনি একজন রত্নধর পিতা। সুশিক্ষার মাধ্যমে তিনি সমাজকে আলোকিত করেছেন। নিজের মেধা ও শ্রমকে তিনি মাটি ও মানুষের কল্যাণে উৎসর্গ করেছিলেন। আলোকিত করেছেন ধরাকে। হয়তো এবার আলোকিত করবেন আলমে বরযখ, তারপর হয়তো হাশরের ময়দান।
কক্সবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসাবে যোগদান করার পর কয়েক বছর বরেণ্য শিক্ষক আলহাজ্ব এ এম এম আনোয়ার শাহ’র একান্ত সান্নিধ্য লাভ করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। সত্যি বলতে, ঐ কয়েকটি বছর ছিল আমার জীবনে পাথেয় স্বরূপ। রামু উপজেলার চাকমারকুল ইউনিয়নের কলঘর বাজারের দক্ষিণে এক কালজয়ী আলেমের ঘর আলোকিত করে জন্ম নিয়েছিলেন মহান এ শিক্ষাগুরু। বর্ণাঢ্য জীবনে তিনি একদিকে যেমনি নিজের সন্তান-সন্ততিদের আলোকিত করেছেন তেমনি তাঁর স্পর্শে আলোকিত হয়েছে কক্সবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়সহ অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অগণিত ছাত্র ছাত্রীরা।
তিনি দ্বীনি শিক্ষা ও আরবী সাহিত্যে যেমন দক্ষ ছিলেন তেমনি তাঁর দখল ছিল বাংলা, ইংরেজি, গণিত ও অন্যান্য বিষয়ে। এলেমের ভান্ডার বলে খ্যাত সকলের অন্তর জয় করা এ মানুষটি ছাত্রজীবনে অত্যন্ত মেধাবী গোল্ড মেডল প্রাপ্ত শিক্ষার্থী ছিলেন। বংশগতির প্রভাবে এবং যথাযথ পরিবেশ দেওয়ার কারণে উনার সন্তান-সন্তুতিরাও অত্যন্ত মেধাবী হয়েছেন এবং কর্ম ক্ষেত্রে প্রত্যেকে সফলতা অর্জন করেছেন।
কক্সবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় সংলগ্ন ডরমেটরিতে আলহাজ্ব এ এম এম আনোয়ার শাহ, আকতার কামাল স্যার এবং আমি পাশাপাশি রুমে থাকতাম। আমাদের প্রত্যেকের ২জন করে শিক্ষার্থী সন্তান থাকতো আমাদের সাথে। আনোয়ার শাহ এর কনিষ্ঠ ছেলে দেলওয়ার এবং ছোট কন্যা হুমাইরা পারভীন আঙ্গুর, আকতার কামাল স্যারের ছোট দুই মেয়ে মাছুমা ও সায়মা এবং আমার দুই মেয়ে জান্নাতুল মাওয়া ফেন্সী ও জান্নাতুন নাঈম তাকওয়া। মাঝে মধ্যে আমাদের সকলকে আনোয়ার শাহ উনার কক্ষে বসিয়ে আপ্যায়ন করাতেন এবং ইসলামী শিক্ষামূলক নানা গল্প শুনাতেন। যা শুনে আমরা সকলে অভিভূত হতাম। উনি আমাদেরকে শুনাতেন গুহাবাসী বালকদের ঘটনা, ইউসুফ (আ.) এর জীবনী, নমরুদ, কারুন ও ফেরাউনের পরিনতি এবং কুকুরের লেজ চূঙায় ভরলেও সোজা না হওয়ার গল্প ইত্যাদি। আমি এখনো উনার মুখ থেকে শুনা ইসলামী শিক্ষামূলক বুলিগুলো বুকে ধারণ করে আছি। শ্রেণিকক্ষে ছাত্রদেরকে উজ্জ্বীবিত ও প্রাণবন্ত রাখতে এখনো আমি উনার থেকে শেখা বুলিগুলো আওড়াই।
মেডিকেল কলেজ ও প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ুয়া ছেলেদের কাছে পাঠানোর জন্য কোন কোন সময় উনি আমার নিকট থেকে টাকা ধার নিতেন। নেওয়ার সময় কউকে না কাউকে সাক্ষী করতেন আর বলতেন আমাদের কারও এক মূহুর্তের নিশ্চয়তা নেই তাই একজনকে সাক্ষী করিয়ে রাখলাম। বেতন পাওয়ার সাথে সাথে কাল বিলম্ব না করে ঋণের সম্পূর্ণ টাকা পরিশোধ করে দিতেন। একবার বেতন পাওয়ার পর টাকা পরিশোধ করতে এসে আমাকে ডর্মেটরিতে না পেয়ে আমার টিউশনির বিভিন্ন জায়গায় খোঁজ করতে করতে ৬৫ টাকা রিক্সাভাড়া দিয়েছিলেন।
ফজরের নামাজের আযান হলে উনি প্রায় প্রত্যেকদিন আমাদের ডেকে দিতেন। খুব সকালে মেয়েরা প্রাইভেটে চলে যায় বলে মেয়েরা রাত্রে ঘুমিয়ে গেলে আমি সকালের রান্না রাত্রে করে ফেলতাম। তাই গভীর রাত পর্যন্ত আমাকে রান্না-বান্না করতে হতো। সেই সুবাদে প্রতিদিন গভীর রাতে আনোয়ার শাহ এর সাথে আমার দেখা হতো। ওয়াশ রুম থেকে ওজু করে নিজের রুমে প্রবেশের পূর্বে আমাকে বলতেন “রহিম সাব” রোজা রাখতেছেন নাকি! এভাবে বহুদিন আমি উনাকে গভীর রাতে আল্লাহর ধ্যানে মগ্ম থাকতে দেখেছি। আমি আমার মেয়েদের মাথার চুল আছড়ে দিতাম, তাদের কাপড়-চোপড় ধুয়ে রোদে শুকাতে দিতাম। একদিন আনোয়ার হুজুর আমাকে বললেন “রহিম সাব” আপনার মেয়দের কাপড়গুলো ডুকিয়ে ফেলুন। আরও বললেন মেয়েদের রঙিন কাপড়-ছোপড় বাইরে শুকাতে দেওয়া ঠিক না। উনার কথা মতো আমি আমার মেয়েদের কাপড় ঘরে ডুকানোর জন্য আনতে গিয়ে পেছনে ফিরে দেখি উনার মেয়ে আঙ্গুরকে পাঠিয়েছেন আমাকে সাহায্য করতে। এ রকম দ্বীনি চেতনা সম্পন্ন সহানুভূতিশীল ও সহমর্মি মানুষ আমি জীবনে খুব কমই পেয়েছি। আমার জানামতে উনি ২বার হজ্ব করেছেন এবং আরও একবার হজ্বে যাওয়ার জন্য পাগলপারা হয়ে উঠেছিলেন। হে পরওয়ারদিগার নিষ্পাপ শিশুর মতো স্বভাবের অধিকারি মরহুম আলহাজ্ব এ এম এম আনোয়ার শাহকে আপনার সর্বোত্তম পুরস্কার জান্নাতুল ফেরদাউস দান করুন এবং আমাদেরকে উনার মতো হওয়ার তওফিক দান করুন, আমিন।
লেখক :
সিনিয়র শিক্ষক
কক্সবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়।
Posted ১২:৩৪ পূর্বাহ্ণ | বৃহস্পতিবার, ১৩ ফেব্রুয়ারি ২০২০
coxbangla.com | Chanchal Chy