সুযোগটা ক্লাইভ দিয়েছিলেন। ওয়াটসের মাধ্যমে যোগাযোগ করে তিনি মীর জাফরকে নতুন নবাব হিসেবে স্বীকৃতির প্রস্তাব দেন। বিনিময়ে সিরাজউদ্দৌলাকে উৎখাত করতে সামরিক সহায়তা চান। মীর জাফর প্রস্তাবটি দ্রুত গ্রহণ করেন। ষড়যন্ত্রে শরিক করেন রায় দুর্লভ ও মানিক চাঁদকেও। কিন্তু দ্রুত একটি বিপজ্জনক সমস্যা দেখা দেয়। উমিচাঁদ নামে এক ধূর্ত হিন্দু ব্যবসায়ী, যাকে কেউ পুরোপুরি বিশ্বাস করত না; এর আগে তিনি শেঠদের সঙ্গে মিলে নিজের মতো করে ষড়যন্ত্র তৈরি করেছিল। কিন্তু ক্লাইভ ও অন্যান্য ষড়যন্ত্রীর দ্বারা পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যাত হয়। সে প্রত্যাখ্যান এবং তাকে আসল ষড়যন্ত্র সম্পর্কে জানা থেকে দূরে রাখার জন্য মীর জাফরের চেষ্টা বড় ধরনের সংকট সৃষ্টি করে। বিশেষ করে যখন উমিচাঁদ তার গুপ্তচরদের মাধ্যমে জানতে পারেন আসল ঘটনা। ক্ষুব্ধ ও অর্থলিপ্সু উমিচাঁদ সিরাজউদ্দৌলার কাছে পরিকল্পনা প্রকাশ করার হুমকি দেন, যদি না তাকে লাভের বড় অংশ দেয়া হয়।
১৮ জুন, ক্লাইভ জেনারেল আইর কুটকে পাঠান কুটনা গ্রাম এবং তার বিশাল চালের সরবরাহ দখল করার জন্য। প্রতিরোধকারীরা দুর্গ ছেড়ে পালিয়ে যায় কোনো প্রতিরোধ ছাড়াই। কিছু সময় পর ক্লাইভ সেখানে পৌঁছান। তার আশা ছিল মীর জাফর ও তার প্রতিশ্রুত ১০ হাজার সৈন্যের সঙ্গে দেখা হবে। কিন্তু পলাশীতে নবাবের উপস্থিতি জেনারেলের চলাচলে বাধা সৃষ্টি করেছিল। ক্লাইভ সবচেয়ে খারাপ পরিস্থিতির ভয় পেতে শুরু করেন। মীর জাফরের চিঠির অস্পষ্টতা ও গুঞ্জনগুলো তার উদ্বেগ আরো বাড়িয়ে দিয়েছিল। গুঞ্জন ছিল নবাবের সঙ্গে মীর জাফর বোঝাপড়া করে নিয়েছেন। মীর জাফর কি ব্রিটিশদের সঙ্গে হওয়া চুক্তির মর্যাদা রাখবে? নাকি শত্রুর প্রতি অনুগত থাকবে? ক্লাইভ তার জবাব জানতেন না।
ভাগীরথী নদীতে পৌঁছার পর ক্লাইভ তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হন। তার সামনে দুটি বিকল্প ছিল; হয় নদী পার হয়ে পলাশীর দিকে এগিয়ে যেতে হবে, অথবা সেখানেই রয়ে গিয়ে ঘটনার পরিণতি দেখার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। উভয় বিকল্পেই বিপুল ঝুঁকি ছিল। নদী তখন পার হওয়া সম্ভব ছিল, কিন্তু যদি ক্লাইভ নদী পার হয়ে মীর জাফরের বিশ্বাসঘাতকতার শিকার হন এবং পলাশীতে পরাজিত হন, তাহলে পালিয়ে আসা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ত। কারণ ততক্ষণে বর্ষার বৃষ্টির ফলে নদী বিশাল হয়ে উঠত। সেনাবাহিনী আটকে পড়ত এবং ধ্বংস হয়ে যেত। তবে নদী পার না হলে তাকে দুর্বল হিসেবে চিহ্নিত করা হতো, মীর জাফরও ষড়যন্ত্র থেকে নিজের সমর্থন প্রত্যাহার করে নিতে পারত। অবশ্য যদি তিনি এরই মধ্যে গোপনে তা করে না থাকেন। তাছাড়া দেরি হলে সিরাজউদ্দৌলার বাহিনীতে ফরাসি সৈন্য যোগ দেবে। ৩০০ জন ফরাসি সৈন্য মাত্র তিনদিনের দূরত্বে রয়েছে নবাবকে সাহায্য করার জন্য। এ দ্বিধা থেকে বের হওয়া ছিল কঠিন। প্রথমবারের মতো ক্লাইভ তার সহজাত দৃঢ় আত্মবিশ্বাসে সন্দেহ অনুভব করেন।
২১ জুন ক্লাইভ যুদ্ধপরিষদ ডেকে সিদ্ধান্তের বিষয়ে আলোচনা শুরু করেন। অপ্রত্যাশিতভাবে আইর কুট তাকে দৃঢ়ভাবেই নবাবের সঙ্গে সম্মুখ যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত থাকার আহ্বান জানান। তিনি মনে করেছিলেন যে ক্লাইভ কলকাতায় ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছেন। তবে ক্লাইভ ও অন্যান্য বেশকিছু কর্মকর্তা এমন একটি পদক্ষেপের নেতিবাচক দিক তুলে ধরেন। এটি ছিল খুবই বড় ঝুঁকি।
আলোচনার ১ ঘণ্টার মধ্যে ক্লাইভ হঠাৎ তার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলেন। কেন তিনি এটি করলেন তা পরিষ্কার নয়। তবে তিনি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছিলেন যে বর্তমান পরিস্থিতি সম্ভবত তার জন্য একমাত্র সুযোগ। এর মধ্য দিয়েই তিনি তার লক্ষ্যগুলো অর্জন করতে পারেন। এটি ছিল উচ্চঝুঁকি, উচ্চ পুরস্কারের ঘটনা।
খুব দ্রুত সময়ের মধ্যে তিনি মীর জাফরের একটি চিঠি পান। যদিও জেনারেল তখনো অস্পষ্ট ছিলেন, চিঠিটি পলাশীতে নবাবের ঘাঁটির বিষয়ে সতর্ক করা হয়; আহ্বান জানানো হয় অবিলম্বে আক্রমণ করার। এটি ক্লাইভকে নিশ্চিত করে তোলে যে অন্তত মীর জাফর তার অবস্থান নিরপেক্ষ রাখবেন। পরবর্তী দিন বিকালে তিনি সেনাবাহিনীকে নদী পার হওয়ার নির্দেশ দেন। ৮ ঘণ্টার ঝুম বৃষ্টির মধ্যে মার্চ করে সেনাবাহিনী ২৩ জুন ১টার দিকে পলাশীতে পৌঁছায়, সেখানে তারা আম বাগানে শিবির স্থাপন করে। ক্লাইভ জানতে পারেন যে মীর জাফর এখনো নবাবকে পরিত্যাগ করেননি। তিনি তখন কিছুই করতে পারেননি, শুধু উদ্বেগ নিয়ে অপেক্ষা করেছিলেন যে তার এ ঝুঁকি গৌরব না দুর্যোগে পরিণত হবে।
ক্লাইভের উদ্বেগের যথেষ্ট কারণ ছিল। শিকারি লজের ছাদ থেকে দূরবীনে চোখ রাখেন। সারা রাত এখানেই ঘুমহীন কাটিয়েছেন। তিনি দেখলেন যে তার বিরুদ্ধে এক বিশাল সেনাবাহিনী দাঁড়িয়ে আছে। তার বাহিনীর চেয়ে ঢের বেশি। মীর জাফর ও রায় দুর্লভের অধীনস্ত বাহিনীর আনুগত্য এখনো নিশ্চিত না হওয়ায় নবাবের মোট সৈন্য সংখ্যা প্রায় ৬০ হাজার বলে মনে হচ্ছিল। গুজব ছিল যে সিরাজউদ্দৌলার সেনাবাহিনীর অনেকেই বিদ্রোহ করেছে, ফলে ক্লাইভ ধারণা করেছিলেন যে হয়তো অনেক সৈন্য পালিয়ে গেছে। কিন্তু বাস্তবে দুই-তৃতীয়াংশ সৈন্য ছিল পদাতিক এবং বাকি ২০ হাজার ছিল অশ্বারোহী, যার মধ্যে পাঠান যোদ্ধারা ছিল অত্যন্ত দক্ষ, তলোয়ার ও লম্বা বর্শা নিয়ে সজ্জিত। তবে পাঠানরা ব্যতিক্রম ছিল; নবাবের বেশিরভাগ সৈন্য ছিল অপ্রশিক্ষিত ও অদক্ষ।
সিরাজউদ্দৌলার সামনের সারি ক্লাইভের অবস্থান থেকে মাত্র ২০০ গজ দূরে ছিল। তার সেরা সৈন্যদের নিয়ে গঠিত। বিশেষ করে মীর মদনের অধীনে থাকা সাত হাজার পদাতিক এবং পাঁচ হাজার অশ্বারোহী। মীর মদন আর্টিলারি বাহিনীকে সমর্থন দিচ্ছিলেন, যার মধ্যে ৫৩টি কামান ছিল। সেগুলো মূলত দুটি পুকুরের উঁচু পাড়ে স্থাপিত ছিল। ফরাসি নেতা মসিয়েঁ সিনফ্রের অধীনে প্রায় ৫০ জন ফরাসি সৈন্য তা পরিচালনা করছিল। পেছনের দিকে নবাবের বিশাল বাহিনীর বাকি অংশ; সেখানে ছিল সোনালি ও লাল কাপড়ে মোড়ানো হাতির একটি দল। কিন্তু এটি ছিল নবাবের সেনাবাহিনীর একটি অংশমাত্র। তার বাহিনীর আরো বড় অংশ মীর জাফরের অধীনে ব্রিটিশ বাহিনীর ডান দিকে অবস্থান করেছিল। যদি মীর জাফর ক্লাইভের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করার ইচ্ছা থাকত, তবে তিনি ক্লাইভকে ঘিরে ফেলার এবং তাকে ধ্বংস করার উপযুক্ত অবস্থানে ছিলেন। ক্লাইভ তখনো নিশ্চিত ছিলেন না যে সে বাহিনী তার ষড়যন্ত্রের অংশীদার।
প্রথমে ক্লাইভ আম বাগানটি ব্যবহার করার কথা ভাবেননি। বাগানটি অবস্থিত কাদার বাঁধের পেছনে ৩০০ গজ লম্বা এবং প্রায় এক মাইল বিস্তৃত। এর পরিবর্তে তিনি তার সেনাবাহিনীকে বাগানের পেছনে সমবেত করেছিলেন। কেন্দ্রে রাখা হয়েছিল ইউরোপীয়দের এবং দুপাশে ছিল দেশীয় সৈন্যরা। তাদের দুপাশে ছিল তিনটি করে কামান। বাকি কামানগুলো ছিল বামদিকে পেছনে, যা ২০০ গজ দূরে ইটের ভাটা দ্বারা সুরক্ষিত।
সকাল ৮টায় নবাবের কামান গোলাবর্ষণের করে এবং ব্রিটিশরা পাল্টা জবাব দেয়। যুদ্ধের আনুষ্ঠানিক শুরু হয়। যদিও ব্রিটিশ কামানগুলো নবাবের চেয়ে বেশি কার্যকর ছিল, তবু দেখা গেল যে ব্রিটিশরাই গোলাবর্ষণে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছিল। সিরাজউদ্দৌলা তার লোকসান সামলাতে পারছিলেন, কিন্তু ক্লাইভ পারছিলেন না। গোলাবর্ষণ শুরুর আধা ঘণ্টার মধ্যেই ১০ জন ইউরোপীয় ও ২০ জন দেশীয় সৈন্য নিহত হওয়ার পর ক্লাইভ তার বাহিনীকে কাদার বাঁধের পেছনে আম বাগানে ফিরিয়ে নিয়ে যান। এর পর থেকে শত্রুর গোলাগুলি গাছের ওপর দিয়ে চলে যেতে লাগল, ফলে ক্ষয়ক্ষতি অনেক কমে গেল।
এদিকে পলাশীতে তার সেনাবাহিনী বেশ কিছুক্ষণ ধরে অপেক্ষা করছিল, কিন্তু মীর জাফরের কোনো খবর আসেনি। ক্লাইভ তখন সিদ্ধান্ত নিলেন যে তিনি সরাসরি যুদ্ধ এড়িয়ে যাবেন। তিনি স্থির করলেন যে তিনি সেখানেই থাকবেন এবং রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করবেন। কলকাতার মতোই একটি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করার চেষ্টা করবেন। এটি ছিল একটি বিশাল জুয়া, তবে এ পর্যন্ত ভাগ্য ক্লাইভের সঙ্গে। তার পরিকল্পনা সফল হবে কিনা তা অনেকটাই নির্ভর করছিল তার ডানপাশে অলসভাবে বসে থাকা শত্রুপক্ষের বিশাল বাহিনীর ওপর। যদি তারা নিষ্ক্রিয় থাকত, তবে ক্লাইভের একটি সুযোগ থাকত।
দুপুর ১২টায় বৃষ্টি শুরু হয়, যা ৩০ মিনিট ধরে চলতে থাকে। ব্রিটিশরা তাদের কামান ও গোলাবারুদকে ত্রিপল দিয়ে ঢেকে রাখে, যাতে সেগুলো ভিজে না যায়। কিন্তু নবাবের বাহিনী এ ধরনের কোনো পূর্বসতর্কতা অবলম্বন করেনি। ফলে তাদের বারুদ ভিজে যায় এবং নবাবের কামানগুলো নীরব হয়ে পড়ে। যেহেতু ব্রিটিশরা তাৎক্ষণিকভাবে আক্রমণ করেনি, মীর মদন ভেবেছিলেন ব্রিটিশদের কামানও অকেজো হয়ে গেছে। এ ভুল ধারণার ফলে তিনি আক্রমণ শুরু করেন, তবে ব্রিটিশদের ছয় পাউন্ডের কামান সম্পূর্ণ সক্রিয় অবস্থায় ছিল এবং তারা মীর মদনের বাহিনীর ওপর প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ করে। একটি গুলি মীর মদনের ঊরুতে আঘাত করে এবং তিনি গুরুতরভাবে আহত হন। তার সৈন্যরা তাকে মাঠ থেকে সরিয়ে নিয়ে গেলে আক্রমণটি ব্যর্থ হয়।
মীর মদনের মৃত্যু নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে হতবাক করে দেয়। আরেক বিশ্বস্ত সেনাপতি বাহাদুর আলী খানের মৃত্যুর পর নবাবের কাছে আর কোনো বিশ্বস্ত ব্যক্তি অবশিষ্ট ছিল না। আতঙ্কিত নবাব মীর জাফরকে তার প্রধান কার্যালয়ে ডেকে পাঠান। তার প্রতি আনুগত্যের অনুরোধ জানিয়ে নবাব তার টুপি মীর জাফরের পায়ে ফেলে দেন। মীর জাফর আনুগত্যের প্রতিশ্রুতি দিলেও তা ছিল মিথ্যা। নবাবের উপস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসার পর মীর জাফর তাড়াহুড়ো করে ক্লাইভের কাছে একটি চিঠি লেখেন, যাতে তিনি আক্রমণের জন্য অনুরোধ করেন। পরিস্থিতি ছিল যথেষ্ট জটিল। মীর জাফর হয়তো অপেক্ষা করছিলেন কোন পক্ষ শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হয়, সেটা দেখার জন্য। যদি সিরাজউদ্দৌলা পিছু হটতেন এবং ব্রিটিশরা এগিয়ে যেত, তাহলে পুরো দমে যুদ্ধ শুরু হতো। তিনি শিগগিরই তার উত্তর পেয়ে যেতেন। এমনকি পরিস্থিতি অনুকূলে থাকলে তিনি ক্লাইভের সঙ্গে যুক্ত হওয়ার জন্যও একটি ভালো অবস্থানে থাকতেন। কিন্তু প্লাসির পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গিয়েছিল। মীর জাফরের চিঠি ক্লাইভের কাছে পৌঁছতে ব্যর্থ হয়, কারণ দূত গোলাগুলির ভয়ে চিঠি নিয়ে সামনে এগোতে সাহস করেনি। ফলে ঘটনাগুলো ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়।
মীর মদনের বিপর্যস্ত আক্রমণ ক্লাইভের পরিকল্পনাকে পরিবর্তন করতে পারেনি। তার মূল উদ্দেশ্য ছিল রাতের অন্ধকারে আক্রমণ করা। কিন্তু ভেজা পোশাক পাল্টাতে যখন তিনি শিকারের কুঠিরে ফিরে গেলেন, তখন পরিস্থিতি তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। তার জেনারেলদের অসৎ পরামর্শ শোনার পর নবাব তার বাহিনীকে পিছু হটার আদেশ দেন। যদিও কিছু সৈন্য বিশেষত সিনফ্রে ও মীর মদনের পরিবর্তে নিয়োজিত মোহন লাল অনিচ্ছায় পিছু হটেন। সিরাজউদ্দৌলা ও ক্লাইভ উভয়ের জন্যই মনে হয়েছিল যুদ্ধ শেষ হতে চলেছে। কিন্তু মেজর কিলপ্যাট্রিক শত্রুর এ পিছু হটার গতিবিধিকে দুর্বলতার লক্ষণ হিসেবে দেখেন এবং দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেন। কোনো আদেশ ছাড়াই তিনি তার সেনাদলকে এগিয়ে নিয়ে যান এবং ফরাসি বাহিনী যে স্থান ত্যাগ করেছিল, সে পুকুরের কূল দখল করেন। যুদ্ধ আবার শুরু হয়ে যায়।
ক্লাইভ তখন সামনে ফিরে আসেন এবং কিলপ্যাট্রিকের এমন অগ্রহণযোগ্য আচরণে রেগে যান। কিলপ্যাট্রিকের এ আক্রমণের ফলে তার অগ্রবর্তী বাহিনী বিপদে পড়ে এবং ক্লাইভের আর কোনো উপায় ছিল না। তাকে পুরোপুরি যুদ্ধে যুক্ত হতে হয় অগ্রগামীদের সহযোগিতা করতে। তাছাড়া এ মুহূর্তে পিছু হটার সিদ্ধান্ত নেয়া শত্রুর কাছে দুর্বলতার ইঙ্গিত হিসেবে ধরা হতে পারত এবং পাল্টা আক্রমণের আশঙ্কা ছিল। ক্লাইভ জেনারেল আইর কুটের দুটি ডিভিশন এবং একটি গ্রেনেডিয়ার বাহিনীকে আক্রমণে পাঠান। ঘটনাস্থলে পৌঁছে তিনি কিলপ্যাট্রিকের বাহিনীর নেতৃত্ব গ্রহণ করেন এবং তীব্র ভর্ৎসনার পর মেজর কিলপ্যাট্রিককে সেনাবাহিনীর পেছনে পাঠান।
ব্রিটিশরা অগ্রসর হলে মোহন লাল ও ফরাসিরা প্রতিরোধ গড়ে তোলে। ফরাসিরা একটি দুর্গ ও একটি বনপূর্ণ পাহাড়ে তাদের কামান পুনর্বিন্যাস করে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। মোহন লাল এক জোরালো পাল্টা আক্রমণের নেতৃত্ব দেন। সিনফ্রে কামানের সহায়তায় নবাবের অশ্বারোহীরা সামনে এগিয়ে যান, কিন্তু তারা একটি অদম্য দেয়ালে আঘাত করে। বহু সৈন্য ও বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার ক্ষতি স্বীকার করে মোহন লাল পিছু হটতে বাধ্য হন। এখন ব্রিটিশদের হাতে পরিস্থিতির নিয়ন্ত্রণ ছিল, তবে সামনে অগ্রসর হওয়া এখনো নিরাপদ না। নবাবের বাহিনীর একটি অংশ, যারা পুরো যুদ্ধের সময় ডানদিকে অবস্থান করেছিল, তখনো সেখানে ছিল। ক্লাইভ যদি সামনের শত্রুর বিরুদ্ধে আক্রমণ চালাতেন, তবে পাশে থাকা সৈন্যরা সহজেই তাকে ঘিরে ফেলতে পারত।
কর্নেল ক্লাইভের ছোট্ট সেনাবাহিনী নবাবের বিশাল বাহিনী দ্বারা প্রায় ঘিরে ফেলা হয়েছিল। তবে তারা তাদের নেতৃত্ব ও যুদ্ধক্ষেত্রের উদ্দীপনায় সংখ্যার অভাব পূরণ করে নেয়। বেলা ৩টার দিকে ভয়টি বাস্তব হতে চলেছিল, যখন সে একই শত্রু সৈন্যরা পেছনের নদীর দিকে এগিয়ে যেতে শুরু করে। তাদের পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত না হওয়ায় ব্রিটিশরা গুলি চালায়, কিন্তু পরে ক্লাইভ আবিষ্কার করেন যে এরা আসলে মীর জাফরের সৈন্য, যিনি নিরপেক্ষ থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। এ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য জেনে ক্লাইভ পুরোপুরি আক্রমণ চালানোর নির্দেশ দেন। তিনি দুর্গের দিকে এগিয়ে যান। কুট পাহাড়ের দিকে আক্রমণ চালান। ভারি গোলাগুলির সম্মুখীন হয়েও ব্রিটিশ বাহিনী তাদের লক্ষ্যবস্তু দখল করতে সক্ষম হয় আর ফরাসিরা পিছু হটে যায়। এ আক্রমণে শত্রু বাহিনীর মধ্যে ব্যাপক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়। হাতি ও সৈন্যরা দ্রুত পালাতে গিয়ে আরো বিশৃঙ্খলা তৈরি করে। এক পর্যায়ে নবাবের একটি গোলাবারুদ মজুদে বিস্ফোরণ ঘটে, যা পুরো শিবিরে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়। শুরুতে ব্রিটিশদের পরাজয় অনুমান করা হলেও শেষ পর্যন্ত শত্রুদের সম্পূর্ণ পরাজয় ঘটে।
মীর জাফর কেবল তখনই ক্লাইভের বাহিনীতে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নেন, যখন তিনি জানতে পারেন যে সিরাজউদ্দৌলা যুদ্ধক্ষেত্র থেকে পালিয়ে গেছেন। নবাব অনেক আগেই উটের পিঠে করে পালিয়েছিলেন; বিশেষ করে যখন বিকাল ৫টার দিকে যখন তার সেনাবাহিনীর অবশিষ্টাংশ সম্পূর্ণ ভেঙে পড়ে। বিজিতদের পিছু ধাওয়া প্রায় ছয় মাইল পর্যন্ত চলেছিল, তবে পর্যাপ্ত অশ্বারোহী না থাকায় ব্রিটিশরা সে ধাওয়া পরিত্যাগ করতে বাধ্য হয়।
এ যুদ্ধে নবাবের ৫০০ জনেরও বেশি সৈন্য নিহত হয়। ব্রিটিশদের ক্ষয়ক্ষতি ৭০ জনের কম, যাদের বেশিরভাগই সিপাহি; বেশিরভাগই আহত। প্রথমে মনে হতে পারে, মাত্র এক-চতুর্থাংশ নবাবের বাহিনী লড়াইয়ে অংশ নিয়েছিল বলে এটাকে ঠিক যুদ্ধ বলা যায় না। তবে যারা এর অভিজ্ঞতা পেয়েছিল, বিশেষ করে রবার্ট ক্লাইভ, তাদের জন্য যুদ্ধটি শেষ পর্যন্ত অনিশ্চয়তায় পূর্ণ ছিল। যদিও বলা যায় পলাশী জয়টা হয়েছে মূলত ষড়যন্ত্রের মধ্য দিয়ে, তবু মীর জাফরের সহযোগিতা ক্লাইভের তরবারির কার্যকর ব্যবহারের ওপরই নির্ভরশীল ছিল।
যুদ্ধের পর ক্লাইভের সঙ্গে দেখা করতে আসা মীর জাফর ক্লাইভের উদারতায় বিস্মিত হন, বিশেষত তার অংশগ্রহণের অভাবের পরও। ক্লাইভ তাকে লিখলেন, আমি আপনাকে বিজয়ের জন্য অভিনন্দন জানাই, এটি আপনার, আমার নয়। বাস্তবে ক্লাইভ উদার হতে পারছিলেন কারণ বিজয় আসলেই তার ছিল। মীর জাফর নতুন নবাব হলেও নবাব হওয়ার অর্থ এখন ব্রিটিশদের হাতের পুতুল হওয়ার চেয়ে বেশি কিছু নয়।
মীর জাফর প্রথমে মুর্শিদাবাদে সিরাজউদ্দৌলার পিছু নিলেও তিনি তাকে আটকানোর কোনো চেষ্টা করেননি। কয়েকদিন পর সিরাজউদ্দৌলা আবার পালানোর চেষ্টা করলে মীর জাফরের লোকেরা তাকে ধরে ফেলে। তাকে রাজধানীতে ফিরিয়ে আনা হয় এবং সেখানে তাকে ছুরিকাঘাত করে হত্যা করা হয়। এরপর তার বিকৃত মরদেহকে একটি হাতির পিঠে করে শহরের রাস্তায় প্রদর্শন করা হয়।
যদিও নবাবের কোষাগারে সম্পদের পরিমাণ পূর্বানুমানের তুলনায় অনেক কম ছিল, ক্লাইভ তবু ১ লাখ ৮০ হাজার পাউন্ডের সমপরিমাণ ধনসম্পদ অর্জন করেন। এর মধ্য দিয়ে মাত্র ৩২ বছর বয়সে তিনি ভারতের অন্যতম ধনী ব্যক্তিতে পরিণত হন। আরো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল মীর জাফরের সঙ্গে করা চুক্তি, যার মধ্য দিয়ে তিনি প্রায় ৩০ লাখ রুপি ক্ষতিপূরণ হিসেবে কলকাতায় পাঠান। অত্যন্ত অনুকূল বাণিজ্য অধিকার দেয়া হয়। এর মধ্যে ফরাসিদের বাংলায় নিষিদ্ধ করার বিষয়টিও অন্তর্ভুক্ত ছিল।
ক্লাইভের জন্য সম্পদ সবসময় দ্বিতীয় স্থানেই ছিল, আসল লক্ষ্য ছিল মর্যাদা। তিনি সে উচ্চ মর্যাদা অর্জন করেছিলেন বাংলার প্রথম ব্রিটিশ গভর্নর হিসেবে। যদিও কৌশলী ও প্রতারণামূলক পদ্ধতিতে তিনি সে লক্ষ্য অর্জন করেছিলেন, যা তাকে ১৭৭৪ সালের দুঃখজনক মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তাড়া করেছে। তার পরও ১৭৫৭ সালে তার সাফল্যগুলো সময়ের পরীক্ষায় টিকে আছে, এমনকি যে ব্রিটিশ রাজটি ভারতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল তার জন্য ক্লাইভকে সর্বাধিক কৃতিত্ব দেয়া হয়।
(লেখাটি মার্কিন সামরিক পত্রিকা ‘মিলিটারি হেরিটেজ’-এর ১৫তম ভলিউম ও পঞ্চম ইস্যু থেকে অনূদিত)
লুইস কিয়োটলা: মার্কিন সামরিক পত্রিকা মিলিটারি হেরিটেজের লেখক ও সামরিক বিশ্লেষক (অনুবাদ: মুহম্মদ আল মুখতাফি)
বাংলায় কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠায় সাহায্য করেছিল আর্মেনীয়রা
১৭৫৭ সালের ২৩ জুন। পলাশীর যুদ্ধে রবার্ট ক্লাইভের বাহিনীর হাতে বাংলার পরাজয়। জর্জ ব্রুস ম্যালেসন তার দ্য ডিসাইসিভ ব্যাটলস অব ইন্ডিয়া (১৮৮৩) গ্রন্থে পলাশীকে ব্রিটিশদের সবচেয়ে নিষ্প্রাণ বিজয় বলে চিহ্নিত করেন।
১৭৫৭ সালের ২৩ জুন। পলাশীর যুদ্ধে রবার্ট ক্লাইভের বাহিনীর হাতে বাংলার পরাজয়। জর্জ ব্রুস ম্যালেসন তার দ্য ডিসাইসিভ ব্যাটলস অব ইন্ডিয়া (১৮৮৩) গ্রন্থে পলাশীকে ব্রিটিশদের সবচেয়ে নিষ্প্রাণ বিজয় বলে চিহ্নিত করেন। ম্যালেসনের মতে, পলাশীর ফলেই কেপ অব গুড হোপ, মরিশাস দখল, মিসরে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়েছিল। পলাশীই ইংল্যান্ডের মধ্যবিত্তের সন্তানদের জন্য এক অসীম সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দিয়েছিল; যেখানে প্রতিভা ও পরিশ্রমের সত্যিকারের মূল্যায়ন সম্ভব হয়েছিল। প্রতিটি প্রকৃত ইংরেজের চেতনার গভীরে এ উপলব্ধি রয়ে গেছে।
ঐতিহাসিকদের মতে, পলাশীর পরিণতিই উন্মোচন করেছিল উপমহাদেশের অন্তর্দ্বন্দ্ব। ধ্বংস হয়েছিল স্থানীয় রাজবংশগুলোর পরাক্রম, ধসে পড়েছিল বাংলার সমৃদ্ধ অর্থনীতি।
পলাশীর ইতিহাসে সাধারণত ক্লাইভের সঙ্গে জাফর, জগৎ শেঠ ও উমিচাঁদের জোটের কথাই পুনরাবৃত্ত হয়। তবে বাংলায় তখন আরো এক শক্তির উপস্থিতি ছিল—আর্মেনীয়রা। তাদের সহায়তা ছাড়া ১৭৫৬ সালের কলকাতার পতনের পর ক্লাইভ ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির পক্ষে পলাশীর বিজয় এতটা সহজ নাও হতে পারত।
সে সময়ের তিন প্রভাবশালী আর্মেনীয়র কথাই বলা যাক। খোজা ওয়াজিদ, যিনি ক্লাইভকে সমর্থন করলেও পরে ফরাসিদের প্রতি আনুগত্যের সন্দেহে গ্রেফতার হন; জোসেফ এমিন একজন অভিযাত্রী, যিনি লন্ডনে পাড়ি জমিয়েছিলেন এবং এক দশক ধরে ইংরেজ অভিজাতদের আলোচনায় ছিলেন এবং খোজা পেট্রাস আরাটুন ইংরেজ কোম্পানির মিত্র, যিনি ১৭৬৩ সালে হত্যার শিকার না হলে মীর কাসিমের পর বাংলার নবাবও হতে পারতেন।
আঠারো শতকজুড়ে আর্মেনীয়রা পারস্য, তুরস্ক ও আফগানিস্তান থেকে ব্যাপকভাবে ভারত অভিমুখী হয়ে পড়ে। এর পেছনে প্রধানত ক্যাথলিক ও ইসলামে জবরদস্তিমূলক ধর্মান্তর, ১৭২০-এর দশকের আফগান আক্রমণ এবং ১৭৪০-এর দশকে নাদির শাহের লুণ্ঠনকে দায়ী করা হয়। পাশাপাশি এশিয়ার বাণিজ্যিক সুযোগের সন্ধানে ইউরোপীয় কোম্পানিগুলো কৌশলে আর্মেনীয়দের নিজেদের পক্ষে টেনে নিয়েছিল।
সম্রাট আকবর পারস্য উপসাগরে আর্মেনীয় বাণিজ্যে করমুক্তি দিয়েছিলেন। ষোলো শতকে সুরাটে (গুজরাট) ও সতেরো শতকের শেষে চিনসুরায় (পশ্চিমবঙ্গ) তারা বসতি গড়ে তোলে। ১৬৬৫ সালে সম্রাট আওরঙ্গজেব এক ফরমানে মুর্শিদাবাদ জেলার সৈদাবাদে তাদের বসবাসের অনুমতি দেন। মুর্শিদাবাদ ছাড়াও সুরাট ও বারাণসী আর্মেনীয় বাণিজ্যের কল্যাণে রেশম শিল্পের প্রাণকেন্দ্র হয়ে ওঠে।
আর্মেনীয় জাহাজ ভারত-পারস্য-তুরস্ক-চীন যাত্রা করত। এ সুবাদে আঠারো শতকের কলকাতায় গড়ে ওঠে আর্মেনীয় স্ট্রিট, আরমানিটোলা, আর্মেনীয় ঘাট। ১৭৩৪ সালে আর্মেনীয় ঘাটেই ১৮৫৪-৫৭ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া রেলওয়ের প্রথম টিকিট সংরক্ষণ কক্ষ চালু হয়। ১৮৭৩-১৯০২ সাল পর্যন্ত শিয়ালদাহ থেকে আর্মেনীয় ঘাট পর্যন্ত ঘোড়ায় টানা ট্রাম চলত কলকাতা ট্রামওয়ে কোম্পানির।
বিশ শতকে ভারতে আর্মেনীয়দের সংখ্যা ছিল প্রায় ২৫ হাজার। এর মধ্যে কলকাতায়ই ছিল এক হাজার, যা শহরের ৩ হাজার ২০০ ব্রিটিশ বাসিন্দার এক-চতুর্থাংশেরও বেশি। তাদের বাণিজ্যিক প্রতিভা, স্থাপত্য ও সাংস্কৃতিক ছোঁয়ায় বাংলার ইতিহাসের এক অনন্য অধ্যায় রচিত হয়েছিল। আজও তা ইতিহাসের পাতায় অপেক্ষা করছে স্বীকৃতির।
বাংলায় আর্মেনীয়দের উত্থানের নেপথ্যে ছিল ইউরোপীয় ও আঞ্চলিক শক্তিদ্বন্দ্বের ফাঁকে বাণিজ্যিক সুবিধা হাতিয়ে নেয়ার অসামান্য দক্ষতা। প্রভুভক্তি দেখাতে তারা ইংরেজিয়ানার আবরণেও জড়িয়েছিল নিজেদের।
১৭৪৪ সালে জোসেফ এমিন পারস্য ও পরে আফগানিস্তান থেকে পালিয়ে কলকাতায় আশ্রয় নেন। সেখানে তখন প্রায় চার হাজার আর্মেনীয় বসতি। এমিন ইংরেজদের আচার-ভাষা, শিল্প-বিজ্ঞানের পাঠ নিতে ব্যাকুল ছিলেন। ১৭৫৬ সালে এমিন লন্ডনে পৌঁছান একজন লস্কর হিসেবে। সেখানে তিনি এডমান্ড বার্কের সান্নিধ্যে আসেন, যিনি তাকে নিজ ছায়ায় টেনে নেন। বার্কের বিখ্যাত রচনা ‘অন দ্য সাবলাইম অ্যান্ড বিউটিফুল’-সহ অন্যান্য লেখা নকল করেছিলেন এমিন।
তিনি মিসেস এলিজাবেথ মন্টাগু, স্যার উইলিয়াম জোন্স, নর্থাম্বারল্যান্ড ও কাম্বারল্যান্ডের ডিউকদের মতো প্রভাবশালীদের পৃষ্ঠপোষকতাও লাভ করেছিলেন। এক পর্যায়ে তিনি উলউইচে সামরিক প্রশিক্ষণ নিয়ে ফরাসিদের বিরুদ্ধে ইংরেজ বাহিনীতেও যোগ দেন। ১৭৭২ সালে বার্কের অনুরোধে ক্লাইভ এমিনের সামরিক পদোন্নতির সুপারিশ করেন। কিছুদিন পর তিনি কলকাতায় ফিরে মন্টেগু-জোন্স ও ৭৩ গ্রাহকের সহায়তায় ৬৬ বছর বয়সে প্রকাশ করেন আত্মজীবনী দ্য লাইফ অ্যান্ড অ্যাডভেঞ্চারস অব জোসেফ এমিন (১৭৯২)।
বার্ক এমিনকে লেখা এক চিঠিতে প্রশ্ন তুলেছিলেন—
সেই দিন কে ভেবেছিল, সেন্ট জেমস পার্কে তোমার সাথে আমার সাক্ষাতের পর এই রাজ্যই ভারতের বৃহৎ অংশ শাসন করবে? কিন্তু রাজ্য আসে-যায়… সম্রাটের চোখ উপড়ে ফেলা হয়, পথের পসারিরাই সাম্রাজ্যের কর্ণধার হয়ে ওঠে।
সত্যিই, ক্লাইভের বাংলায় এমন বহু ‘পসারি’ ও রাজনীতির নেপথ্য নায়ক ছিল—যাদের মধ্যে আর্মেনীয়দের উপস্থিতি অনস্বীকার্য।
খোজা ওয়াজিদ ছিলেন তাদেরই একজন—লবণপত্রিক বাণিজ্যের সম্রাট, ফরাসি-ইংরেজ-ডাচ সবার সঙ্গে ব্যবসায়িক সখ্য, মক্কা-বসরার সঙ্গে বাণিজ্যিক সেতু। এভাক ডি আরাটুন, খাচিক ডি খোজামালের মতো আর্মেনীয় বণিকদের প্রতিও ঝুঁকেছিল ইউরোপীয় কোম্পানিগুলোর দৃষ্টি। খোজা পেট্রাস আরাটুন, মুর্শিদাবাদের মোগল দরবার ও সৈদাবাদের সঙ্গে সখ্য রাখা আরেক প্রবাদপুরুষ। তার দুই ভাই খোজা গ্রেগরি আরাটুন ও খোজা বারসিক আরাটুন কলকাতার বণিক ও কূটনীতিক মহলে ছিলেন প্রাতিস্বিক।
ওয়াজিদের আসল খেলা ছিল কূটনীতির ছদ্মাবরণে ইউরোপীয় শক্তিগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক অক্ষুণ্ন রেখে লবণপত্রিকের একচেটিয়া অধিকার ধরে রাখা। ক্লাইভ-সিরাজের মধ্যস্থতায় ফরাসিদের জড়ানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু ১৭৫৭ সালে হুগলি দখলের সময় তার ব্যবসায়িক সাম্রাজ্য ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। ইংরেজদের সন্দেহ—সিরাজের প্রতি তার সহানুভূতি, বাংলায় ফরাসি হস্তক্ষেপে তার ভূমিকা। ১৭৫৯ সালে ডাচদের সঙ্গে জাফরের ষড়যন্ত্রে যোগ দেন ওয়াজিদ। চিনসুরার যুদ্ধে ডাচদের পতনের পর সব ইউরোপীয়র কোপানলে পড়েন তিনি। ক্লাইভের কারাগারে বন্দি অবস্থায় ‘আত্মহননের’ মাধ্যমে ইতিহাসের আঁধারে মিলিয়ে যান বাংলার বণিক সম্রাট।
ওয়াজিদের পতনের সঙ্গে সংগতি রেখে আড়াতুনের উত্থান, যিনি এক দশকেরও বেশি সময় ধরে ধীরে ধীরে ইংরেজদের সঙ্গে তার সম্পর্ক সুদৃঢ় করেছিলেন। কলকাতার ব্ল্যাক হোলের পর ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সৈন্যদের জন্য রসদ সরবরাহ করেছিলেন আড়াতুন। ভারতীয়-আর্মেনীয় ঐতিহাসিক মেস্রোব জ্যাকব সেথ লিখেছেন, মানবতাবাদী আর্মেনীয়রা না থাকলে ফুলটার ব্রিটিশ শরণার্থীদের আত্মসমর্পণ করতে অনাহারে মরতে হতো।’ পলাশী ষড়যন্ত্রে সিরাজউদ্দৌলাকে উৎখাত করতে জাফরের সঙ্গে ক্লাইভের আলোচনার সময় আরাটুন গোয়েন্দা হিসেবে নিযুক্ত হন। এ দায়িত্ব স্বাভাবিকভাবে ওয়াজিদেরই হওয়ার কথা ছিল।
ক্লাইভের সঙ্গে আরাটুনের অবস্থান ও প্রভাব হেস্টিংসের সমকক্ষ ছিল, যিনি তখন মাত্র ১৯ বছরের এক কূটনীতিক, ভবিষ্যৎ গভর্নর জেনারেল। আরাটুন মাদ্রাজে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাউন্সিলের সদস্য হন এবং বাংলার আর্মেনীয়দের প্রতিনিধিতে পরিণত হন—যাদের পরবর্তী পরিচয় গঠিত হয় দানশীলতা, ধার্মিকতা এবং ব্রিটিশ সাম্রাজ্যিক স্বার্থের প্রতি অটল আনুগত্য দিয়ে।
পলাশীর আগে ও পরে আর্মেনীয়দের সহায়তা বাংলায় ব্রিটিশ বাণিজ্য ও সামরিক উপস্থিতিকে অভাবনীয়ভাবে সংহত করেছিল। কলকাতা মহানগরী গঠনের পাশাপাশি ভারতীয় আর্মেনীয়দের বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক উদ্যোগ লন্ডনের ঔপনিবেশিক কেন্দ্রটিকে পুনর্নির্মাণেও ভূমিকা রাখে—১৬৬৬ সালের মহা অগ্নিকাণ্ডের ১০০ বছর পর, ইংরেজ কোম্পানির বিশাল সাম্রাজ্যিক লুণ্ঠনের অর্থে। উদাহরণস্বরূপ, আর্মেনীয় বাণিজ্যিক সহায়তায় লিডেনহল স্ট্রিটে নির্মাণ হয় ইস্ট ইন্ডিয়া হাউজ—বিশ্বের প্রথম বহুজাতিক কোম্পানির বহু বছরের সদর দপ্তর।
মিনহাজুল আবেদীন: