কক্সবাংলা ডটকম(৫ আগস্ট) :: চালের উচ্চমূল্য অর্থনীতিতে সংকট সৃষ্টি করেছে। মূল্যস্ফীতি বেড়ে যাওয়ার পেছনে এই মুহূর্তে চালের দামকেই প্রধান কারণ বলে মনে করছে অর্থবিভাগ।এ মুহূর্তে চাল আমদানির ওপর আরোপিত সব ধরনের শুল্ক প্রত্যাহারকেই কৌশল মানছেন তারা। তবে খাদ্য মন্ত্রণালয় বলছে, তারা চাল আমদানিতে শুল্ক প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেওয়ার বিষয়ে আরও কিছুটা সময় নিতে চান।দেশের প্রধান এই খাদ্যপণ্যটির দাম কীভাবে কমানো যায়- সেটিই এখন সরকারের বিবেচ্য বিষয়। চাল আমদানিতে শুল্ক প্রত্যাহারের বিষয়ে খাদ্য মন্ত্রণালয় থেকে এনবিআর-এ সুপারিশ যেতে পারে।
বেনাপোলের মেসার্স মুসা করিমের স্বত্বাধিকারী আব্দুস সামাদ। গত ৭ জুলাই বেসরকারিভাবে ১১ হাজার টন চাল আমদানির অনুমতি পেয়েছেন। ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে এ পর্যন্ত ৫০০ টন চাল আমদানি করেছেন। কারণ হিসেবে এই চাল আমদানিকারক বলছেন, বর্তমান বাজারদরের চেয়ে বেশি খরচের কারণে তিনি বরাদ্দ পাওয়া ১১ হাজার টন চাল আমদানি করতে পারেননি।
প্রায় একই বক্তব্য সব চাল আমদানিকারকের। তবে এই সুযোগে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী অস্থিতিশীল করে তুলছেন দেশের চালের বাজার। সারাদেশে পাইকারি পর্যায়ে প্রতি কেজি চালের দাম ২ থেকে ৪ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। আরো বাড়বে বলেও বাজারে গুজব রয়েছে। দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বগতিতে নতুন করে চালের দাম বাড়ায় চরম বিপাকে ভোক্তারা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত বোরো মৌসুমে লক্ষ্য অনুযায়ী ধান-চাল সংগ্রহ করতে পারেনি সরকার। মিলারদের জন্য চাল সংগ্রহে ভাটা পড়ে। পরবর্তী সময়ে বেসরকারি পর্যায়ে পর্যায়ক্রমে ১০ লাখ টন চাল আমদানির সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। কিন্তু ডলারের দাম বাড়ার কারণে আমদানিকারকরা বরাদ্দ পাওয়ার অর্ধেকও আমদানি করেননি। সরকার নির্ধারিত সময়ে চাল আমদানি না হওয়ায় সময়ও বাড়িয়েছে খাদ্য মন্ত্রণালয়।
সর্বশেষ ২১ আগস্ট পর্যন্ত চাল আমদানির এলসি খোলার সময় বাড়ায় মন্ত্রণালয়। বেসরকারি পর্যায়ে চাল আমদানির অনুমতি দিলেও ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় এতেও পড়েছে ভাটা। এসব কারণে বাজারে চালের ঘাটতি তৈরির শঙ্কায় ব্যবসায়ীরা। আর সরকারের এ দুর্বলতার সুযোগ কাজে লাগিয়ে এরই মধ্যে কিছু অসাধু ব্যবসায়ী কারসাজির ছক কষছেন। দেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ- এমনটাই বলা হয়। অথচ হুট করে পাইকারি পর্যায়ে চালের দাম ২ থেকে ৪ টাকা বেড়ে গেছে।
গতকাল ‘গরিবের চাল’ বলে খ্যাত মোটা চালের দাম পাইকারি পর্যায়ে ২ টাকা বাড়িয়ে প্রতি কেজি স্বর্ণা বিক্রি হচ্ছে ৪৯ টাকায়। আর একটু ভালো মানের অর্থাৎ মধ্যম মানের চাল বাজারে বিক্রি হচ্ছে কেজি ৫৫ টাকা পর্যন্ত।
আড়তদাররা বলছেন, মোটা চালের সরবরাহ আগের তুলনায় অনেক কমে গেছে। যার কারণে মিলাররা দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। এছাড়া মোটা চাল আমদানি কম হওয়ার কারণেও বাজারে মোটা চালের সরবরাহে ঘাটতি তৈরি হয়েছে বলেও মনে করেন তারা।
দ্রব্যমূল্যের এই ঊর্ধ্বমুখী সময়ে চালের দাম বাড়ায় বিপাকে সাধারণ মানুষ। বিশেষ করে স্বল্প আয়ের মানুষ পড়বেন চরম সংকটে। এমনিতেই সংসার চালাতে অনেকে খরচের খাতা কাটছাঁট করছেন। এবার চালের দাম বাড়লে আরো বেশি সমস্যায় পড়বেন তারা। এসব বিষয় নিয়ে কথা হয় কনজুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমানের সঙ্গে।
তিনি বলেন, চালের দাম বাড়লে সবচেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েন নি¤œ আয়ের মানুষ। তাদের বিভিন্ন খরচে কাটছাঁট করতে হয়। আর দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সময়ে চালের দাম বাড়লে তাদের কষ্ট আরো বাড়বে। বিশেষ করে মোটা চালের দাম বাড়লে বেশি সমস্যায় পড়েন সাধারণ মানুষ। তাই সরকারের উচিত চালের দাম দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করা।
আড়তদাররা বলছেন ভিন্ন কথা। তারা বলছেন, চালের দাম বাড়ানো মিলারদের একটি পুরনো কৌশল। সরবরাহে কোনো ধরনের ঘাটতি দেখা দিলে তারা দাম বাড়িয়ে দেন। আর এই মুহূর্তে কৃষকের কাছে ধান না থাকায় এই সুযোগটাকে কাজে লাগান অনেকে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে বগুড়া চাল ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি আবুল কালাম আজাদ বলেন, মোটা চালের সরবরাহ অন্যান্য সময়ের তুলনায় অনেক কম। এছাড়া বেসরকারিভাবে আমদানি কম হওয়ায় বাজারে মোটা চালের সরবরাহে এক ধরনের কৃত্রিম ঘাটতি তৈরি হয়েছে। যদিও এর সুফল পাবেন না কৃষকরা।
কারণ হিসেবে এই ব্যবসায়ী নেতা আরো বলেন, কৃষকের কাছে এখন আর ধান নেই। ধান এখন মিলারদের কাছে। এছাড়া চালের বাজারের এ অস্থিরতা তৈরি হয়েছে বেশ কয়েকটি শিল্পগ্রুপের জন্য। কারণ এসব গ্রুপ বেশি দামে ধান সংগ্রহ করার কারণে বাজারে চালের দামে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে বলেও মনে করেন এই ব্যবসায়ী নেতা।
জানা গেছে, দেশে চালের উৎপাদন চাহিদার চেয়েও বেশি। ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে চালের উৎপাদন হয় ৩ কোটি ৮৬ লাখ টন। চাহিদা ছিল ২ কোটি ৯৬ লাখ টন। সেই হিসেবে দেশে প্রায় ৮৬ লাখ টন চাল বেশি উৎপাদন হয়েছে। তবুও বিভিন্ন অসাধু সিন্ডিকেটের কারণে চালের বাজারে অস্থিরতা তৈরি হয়েছে। শুধু ঢাকা, চট্টগ্রাম কিংবা বেনাপোলে নয়, উত্তরাঞ্চলের খাদ্য ভাণ্ডারখ্যাত নওগাঁয়ও বেড়েছে চালের দাম।
নওগাঁর মহাদেবপুর উপজেলার বিভিন্ন চালকলেও সপ্তাহের ব্যবধানে মোটা চালের দাম কেজিতে ২ থেকে ৩ টাকা এবং মাঝারি চালের দাম ৩ থেকে ৪ টাকা বেড়েছে। এক সপ্তাহ আগে মোটা জাতের স্বর্ণা-৫ চাল ৪৪ টাকা কেজি দরে বিক্রি হলেও বর্তমানে তা বিক্রি হচ্ছে ৪৮ টাকায়। ৫৩ থেকে ৫৪ টাকায় বিক্রি হওয়া চাল ৫৬ থেকে ৫৮ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
মিলাররা বলছেন, খরচ বেড়ে যাওয়ায় চালের দাম বেড়েছে। জানতে চাইলে বাংলাদেশ চালকল মালিক গ্রুপের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক আলহাজ ওসমান আলী বলেন, প্রান্তিক চাষীরা মৌসুমের শুরুতেই ধান বিক্রি করে তাদের আর্থিক চাহিদা মিটানোর ফলে বর্তমানে তাদের গোলা শূন্য রয়েছে। এসব প্রান্তিক চাষীদের আর্থিক দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে জেলার বড় বড় ব্যবসায়ী মৌসুমের শুরুতেই ওইসব ধান কিনে মজুত করেছেন। আর অতিরিক্ত মুনাফার লোভে ওইসব ধান ব্যবসায়ী চালকলগুলোয় ধান বিক্রি করেছেন কম।
তিনি আরো বলেন, ব্যাংকঋণের সুদের কারণে বহু চালকল বন্ধ রয়েছে। এসব কারণে নওগাঁ জেলায় চাল উৎপাদনেও বড় ধরনের বাধার সম্মুখীন হচ্ছে বলেও মনে করেন এই মিলার।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা কনসাস কনজুমার সোসাইটির (সিসিএস) নির্বাহী পরিচালক পলাশ মাহমুদ বলেন, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ দেশ। প্রতি বছর চাহিদার চেয়ে বেশি চাল উৎপাদন হয়। সুতরাং খাদ্য সরবরাহে কোনো ধরনের ঘাটতি থাকার কথা নয়। এই সময়ে যারা চালের দাম বাড়িয়েছেন বা যারা বাড়ানোর চেষ্টা করছেন, তাদের ভিন্ন উদ্দেশ্য রয়েছে। তিনি মনে করেন, সরকারের উচিত চালের দামে কোনো সিন্ডিকেট হচ্ছে কিনা, আর যদি সিন্ডিকেট হয় তাহলে এসব অসাধুদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা।
Posted ৬:০৫ অপরাহ্ণ | শুক্রবার, ০৫ আগস্ট ২০২২
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta