কক্সবাংলা ডটকম(২৭ অক্টোবর) :: চলমান সাংগঠনিক সফর নিয়ে বেশ ব্যস্ত সময় পার করছেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা। তৃণমূলকে চাঙা রাখার পাশাপাশি দলে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে দলীয় প্রধান শেখ হাসিনার কঠোর বার্তা এসব সাংগঠনিক সফরে পৌঁছে দিচ্ছেন আওয়ামী লীগ নেতারা। ফলে দলের চলমান শুদ্ধি অভিযানের ঢেউ লেগেছে তৃণমূলেও।
আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, দলের কেন্দ্র থেকে তৃণমূলের সকল সম্মেলনে এবার কোথায় অনুপ্রবেশকারী কাউকে ঢুকতে দেয়া হবে না। এ জন্য সুনির্দিষ্টভাবে একটি তালিকা তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া দলীয় সংসদ সদস্য ও তৃণমূলের নেতাদের সমন্বয় সাধনের জন্য বিশেষ নজর দেয়া হচ্ছে দলের সাংগঠনিক সফরে।
আওয়ামী লীগ নেতারা বলছেন, অনুপ্রবেশকারী ঠেকাতে এখন থেকে যে কোনো সম্মেলনের আগে ও পরে তীক্ষ্ণ নজর রাখবে আওয়ামী লীগ। এ ছাড়া এবারের সাংগঠনিক সফরে তৃণমূলের বিভিন্ন বিষয় কেন্দ্রীয় নেতারা বিশেষ নজরে আনছেন। দলের জন্য ত্যাগী ও পোড়খাওয়া নেতাদের খুঁজে বের করার কাজও চলেছে এই সফরে। এদিকে রংপুর ও রাজশাহী বিভাগে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সফরে সঠিক চিত্র তুলে নিয়ে আসতে তৃণমূলে দেয়া হয়েছে তথ্য পূরণের জন্য প্রশ্নসহ ফরম।
দলীয় সূত্রগুলো বলছে, গত কয়েক বছর তৃণমূল গোছাতে তেমন তৎপরতা দেখা যায়নি আওয়ামী লীগে। তবে সম্প্রতিক সময়ে তৃণমূল গোছাতে বেশ সক্রিয়তা রয়েছে দলে। কেন্দ্রীয় নেতারা এখন তাদের দায়িত্বপ্রাপ্ত জেলাগুলোয় সাংগঠনিক সফর করছেন। বেশ দ্রুত সময়ের মধ্যে জেলাগুলোয় সাংগঠনিক সফর শেষ করতে চায় আওয়ামী লীগ। সেই সঙ্গে তৃণমূলের বিভিন্ন উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের সম্মেলন শেষ করতে চান দলের নীতিনির্ধারকরা। বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত যুগ্ম ও সাংগঠনিক সম্পাদকরা বলছেন, ৩০ নভেম্বরের মধ্যে মেয়াদোত্তীর্ণ সব উপজেলা এবং ডিসেম্বরের ১০ তারিখের মধ্যে জেলা সম্মেলন শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে তাদের।
আওয়ামী লীগের তৃণমূল পর্যায়ে সভার দায়িত্বপ্রাপ্ত কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, তৃণমূলে সংগঠনের বিষয়ে এবার বেশ তৎপর রয়েছে আওয়ামী লীগ। এ ছাড়া সামাজিক অঙ্গনে যে সকল কাজ রয়েছে তা করতে দলের তৃণমূল নেতৃত্বকে এগিয়ে আসার জন্য নির্দেশনা দিচ্ছেন আওয়ামী লীগের নেতারা।
নেতারা বলছেন, নেত্রীর (শেখ হাসিনার) বেঁধে দেয়া সময়ের মধ্যে তৃণমূলের সম্মেলন করার জন্য আমরা প্রায় প্রতিদিন আলাদাভাবে বিভিন্ন স্থানে সাংগঠনিক সফর করছি। মেয়াদোত্তীর্ণ কমিটির সম্মেলন শেষ না হওয়া পর্যন্ত এই ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকবে। দলের জাতীয় কাউন্সিলকে সামনে রেখে এবং একে সফল করতেই দলের চলমান ওই সাংগঠনিক সফরে ওয়ার্ড থেকে শুরু করে জেলা পর্যায়ে সম্মেলনের কাজ চলছে। এ জন্য দলের তৃণমূলে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা আছে।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা বলছেন, যারা পুরনো দিনের দলের নিবেদিতপ্রাণ নেতাকর্মী রয়েছেন। তাদের কাজ করার জায়গা এবারে সকল পর্যায়ের সম্মেলনের মাধ্যমে নিশ্চিত করা হবে। তৃণমূলে যেন কোনো অনুপ্রবেশকারী কেউ ঢুকতে না পারে, সেই নির্দেশনাই আছে দলীয় হাইকমান্ডের।
দলের নীতিনির্ধারণী সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তৃণমূলে কাউন্সিলের (সম্মেলন) আয়োজন ও নতুন কমিটিতে বিতর্কিতদের না রাখার বিষয়ে দিক-নির্দেশনা দিয়েছেন। এর পর তৃণমূলে চিঠি পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয় আওয়ামী লীগ। গত শনিবার দুপুর থেকে এসব চিঠি জেলা-উপজেলা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের ঠিকানা বরাবর কুরিয়ার সার্ভিসে পাঠানো শুরু হয়। এ ছাড়া দলে অনুপ্রবেশকারীর বেশ কিছু তালিকা সুনির্দিষ্ট আকারে তৈরি করা হয়েছে ।
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, দলের তৃণমূলে যদি কোনো অন্তরায় থাকে তা আমরা দূর করতেই কাজ করে যাচ্ছি এবং তৃণমূলের নেতাকর্মীরা সেটাই আশা করে। সেটাই তাদের প্রত্যাশার জায়গা। যারা দলে বিভিন্ন সুযোগে অনুপ্রবেশ করেছে, তাদের আমরা বের করে দেব। দুঃসময়ের নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন করা হবে। মূল দায়িত্বে তারাই থাকবে। এখানে কোনো হাইব্রিডের জায়গা নেই। এমপি-মন্ত্রী যেই হোন, তাদের দলীয় নেতাকর্মীর পাশে দাঁড়াতে হবে, সঙ্গে থাকতে হবে।
সূত্র জানায়, কিছুদিন আগে তৃণমূলে চিঠি পাঠানো হয়েছে। সেখানে ১০ ডিসেম্বরের মধ্যে সব পর্যায়ের কাউন্সিল শেষ করে তা তালিকা আকারে কেন্দ্রে পাঠাতে বলা হয়েছে। চিঠিতে তৃণমূল পর্যায়ে আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনের কমিটি থেকেও বিতর্কিত ব্যক্তিদের বাদ দেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। এটি চলমান ‘শুদ্ধি’ অভিযানের অংশ বলে দলটির নীতি-নির্ধারণী সূত্র থেকে বলা হয়েছে।
নীতিনির্ধারণী সূত্র বলছে, ওই চিঠির ভেতর দিয়েও অনুপ্রবেশকারী ঠেকানো নিশ্চিত করতে চায় আওয়ামী লীগ। দলীয়প্রধান শেখ হাসিনাও তার বক্তব্যের ভেতর দিয়ে একই বার্তা দিচ্ছেন। পাশাপাশি দলীয়প্রধানের ওই বার্তা দলের কেন্দ্রীয় নেতারা তৃণমূলের সফরে পৌঁছে দিচ্ছেন।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা জানিয়েছেন, দলের মধ্যে চলমান শুদ্ধি অভিযানকে স্বাগত জানিয়েছেন দলের তৃণমূল নেতাকর্মীরা। দলে যেন কোনোভাবেই অনুপ্রবেশকারী না ঢুকে- চলমান সাংগঠনিক সফরে তৃণমূল নেতাদের এ বিষয়ে সতর্ক করছেন দলের কেন্দ্রীয় নেতারা। সাংগঠনিক সফরে তৃণমূল নেতাদের বিভিন্ন বিষয়ে নির্দেশনা দিচ্ছেন দলের কেন্দ্রীয় নেতারা। দল নিয়ে শেখ হাসিনার সাংগঠনিক চিন্তাগুলো তৃণমূলে পৌঁছে দেয়া হচ্ছে। সামাজিকভাবে দলকে আরও শক্তিশালী কীভাবে করা যায় তা নিয়েও তৃণমূলে নির্দেশনা দিচ্ছেন তারা। এ ছাড়া আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কার্যক্রম ভালোভাবে প্রচারের জন্য তৃণমূলে বার্তা দেয়া হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের তৃণমূলের সাংগঠনিক সফর প্রসঙ্গে দলটির যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর কবির নানক বলেন, তৃণমূলকে আমরা প্রতিনিয়ত উঠান বৈঠক করার নির্দেশনা দিয়েছি। সরকারের উন্নয়নের প্রচার নিয়েও আমরা তৃণমূলকে নির্দেশনা দিচ্ছি। আমরা তৃণমূলের বক্তব্য শুনছি। নানক জানান, আমরা যখন তৃণমূলের প্রতিনিধি সভাগুলোয় যাচ্ছি তখন আমরা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ থেকে সকল স্তরের নেতাদের ওই সভাগুলোয় সম্পৃক্ত করছি। এর পর আমার দায়িত্বপ্রাপ্ত রংপুর ও রাজশাহী এই দুটি বিভাগে বিশেষ করে তৃণমূল নেতৃবৃন্দকে কিছু প্রশ্ন সম্বলিত একটি ফরম দেয়া হচ্ছে। পরে তাদের পূরণকৃত ফরম আমরা ঢাকায় নিয়ে আসছি। তাতে আমরা তৃণমূল থেকে যে তথ্য পাচ্ছি তা নিয়ে দলের একটি ডাটাবেজ নির্মাণ করবো। এর ফলে তৃণমূলের সকল তথ্য আমরা একসঙ্গে পেয়ে যাব। পাশাপাশি ওই তৃণমূলের তথ্য সম্বলিত ফরমগুলো ফাইল আকারে আমরা সংরক্ষণ করব। বঙ্গবন্ধু কন্যা ও আমাদের নেত্রী (শেখ হাসিনা) ওই ফাইলগুলো দেখবেন।
জানা গেছে, তৃণমূলের জন্য ওই ফরম প্রস্তুত করা হয়েছে। তৃণমূলের ইউনিয়ন পর্যায় থেকে শুরু করে জেলা পর্যায়ের তথ্য এর মাধ্যমে তুলে আনা হচ্ছে। এজন্য বেশ কিছু প্রশ্ন ও মতামত তৃণমূলের কাছে জানতে চাওয়া হচ্ছে। যেখানে নাম, মোবাইল ফোন নম্বর ও ঠিকানা ছাড়াও তৃণমূলের নেতাদের কাছে নিজ ইউনিটের সাংগঠিক অবস্থা, ওই ইউনিটের সম্মেলন কবে হয়েছে, তার তারিখ ও সাল জানতে চাওয়া হচ্ছে। পূর্ণাঙ্গ কমিটি কত সদস্য বিশিষ্ট এসব তথ্যও জানতে চাওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি দলের জেলা নেতারা সাংগঠনিক সফর করছেন কি না, করলে কতবার করেছেন এবং প্রত্যেক উত্তরদাতার সংশ্লিষ্ট সহযোগী সংগঠনগুলোর অবস্থা কেমন, তা জানতে চাওয়া হচ্ছে।
এ ছাড়া বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়ন কতটুকু প্রচার করছেন এ বিষয়েও জানতে চাওয়া হচ্ছে ওই ফরমে। এলাকার সংসদ সদস্যের সঙ্গে সমন্বয় কেমন হচ্ছে, দলের মধ্যে নারী ও তরুণ নেতৃত্ব বিকাশে পরামর্শ ও মতামত, কেন নারী ভোটে আওয়ামী লীগ পিছিয়ে থাকে, ধর্ম ব্যবসায়ীদের অপপ্রচার রোধে করণীয় জানতে চাওয়া হচ্ছে ফরমে। এর বাইরে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে বিরোধী সংগঠনগুলোর অপপ্রচার ও করণীয় নিয়ে তৃণমূলের মতামত জানতে চাওয়া হচ্ছে।
দলীয় সূত্রে জানা গেছে, প্রায় ৭ বছর পর শনিবার ফেনী জেলা আওয়ামী লীগের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের এতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। মেয়াদোত্তীর্ণ বাকি সাংগঠনিক জেলাগুলোর মধ্যে ১৫ নভেম্বর কুমিল্লা উত্তর জেলা, ৩০ নভেম্বর চট্টগ্রাম উত্তর জেলা, ১ ডিসেম্বর বরগুনা, ২ ডিসেম্বর পটুয়াখালী, ৩ ডিসেম্বর পিরোজপুর, ৫ ডিসেম্বর সিলেট জেলা, ৭ ডিসেম্বর বগুড়া জেলা ও বরিশাল জেলা, ৮ ডিসেম্বর বরিশাল মহানগর আওয়ামী লীগের সম্মেলনের তারিখ চূড়ান্ত করা হয়েছে। অন্যগুলোর তারিখও খুব শিগগিরই চূড়ান্ত করা হবে বলে জানা গেছে।
উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগের আগের কমিটির মেয়াদে (২০১২ থেকে ২০১৬ সালে) ৫৮টি সাংগঠনিক জেলার সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ২০১৬ সালের ২৩ অক্টোবর জাতীয় সম্মেলনের পর ৭৮টি সাংগঠনিক জেলার মধ্যে শুধু একটিতে (২০১৭ সালের ২৮ অক্টোবর মৌলভীবাজার) সম্মেলন হয়েছিল। বাকি প্রায় সবগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ ছিল। এর মধ্যে চাঁদপুর, কুমিল্লা দক্ষিণ, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ, শরীয়তপুর ও গাইবান্ধাসহ কিছু জেলা কমিটির মেয়াদ শেষ হয় গত মার্চ, ফেব্রুয়ারি ও জানুয়ারিতে। আর বান্দরবান, রাঙ্গামাটি, নোয়াখালী, বাগেরহাট, কক্সবাজার ও মাগুরাসহ বেশকিছু জেলা কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে গত বছর। কিছু জেলা কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে এরও আগে। আর উপজেলা-থানা ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে অনেক আগেই।
Posted ১২:৫২ পূর্বাহ্ণ | সোমবার, ২৮ অক্টোবর ২০১৯
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta