শহিদুল ইসলাম,উখিয়া(২৬ নভেম্বর) :: আমরা এমন ঘর চাইনি। এটি কি ঘর হলো। আমকাঠ দিয়ে বানানো হয়েছে দরজা ও জানালার পাল্লা। ১৫/২০ দিন হলো ঘর করে দিয়েছে অথচ এখনও তা খোলা মেলা করা যায় না। কথাগুলো ক্ষোভের সাথে বলেন, কক্সবাজারের উখিয়ার পালংখালী ইউনিয়নের পশ্চিম পালংখালী গ্রামের কবির আহামদ।একটু দূরে আরেকটি ঘর। সেটি দেয়া হয়েছে আবুল হোসেন (৪৩) কে।
তিনি জানান, পরিবার পরিজন নিয়ে এ ধরনের ঘরে থাকার কোনো পরিবেশ নেই। ঘরের চারপাশে যে বেড়া দিয়েছে তাতে ভেতর-বাইরের সব কিছু দেখা যায়। দরজা-জানালা খোলা যায় না। ফ্লোরে ঢালাও ভাবে এক দেড় ইঞ্চির ঢালাই দেয়া হয়েছে। মাটির উপরে কয়েকটি ইট বসিয়ে দিয়ে সিঁড়ি বানিয়েছে, যা এখনই ভেঙ্গে যাচ্ছে।
স্থানীয় ইউপি মেম্বার নুরুল হক বলেন, যে ঘর দিয়েছে তা মানুষ বসবাসের উপযোগী নয়। চালের ঢেউটিনগুলো মোটামুটি ভাল। অন্য মালামাল গুলো খুবই নিন্মমানের। ঘরের চর্তুদিকের বেড়া দিয়ে উপর-নিচে মাত্র দুটি বাটাম দেয়া হয়েছে। অন্তত আরো দুটি বাটামের প্রয়োজন ছিল যা দেয়া হয়নি। এসব ঘরের স্থায়িত্ব নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সুইস রেড ক্রসের আর্থিক সহায়তায় বাংলাদেশ রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির (বিডিআরসিএস) পপুলেশন ম্যানেজমেন্ট অপারেশন (পিএমও) প্রোগ্রাম ঘর নির্মাণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। প্রধানমন্ত্রীর ‘জমি আছে ঘর নাই’ কর্মসূচির আওতায় রোহিঙ্গা ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার হত দরিদ্র লোকজনদের বিনামূল্যে এসব ঘর দেয়ার কথা। উপকার ভোগী মনোনয়নে স্থানীয় ইউপি মেম্বার, চেয়ারম্যান, উপজেলা পরিষদ, উপজেলা প্রশাসনের সিদ্ধান্ত বা মতামতকে গুরুত্ব দেয়ার কথা।
কিন্তু বিডিআরসিএসর পিএমও উল্লেখিত কারো মতামতের তোয়াক্কা না করে তাদের ইচ্ছামত যত্রতত্র ঘর বানিয়ে দিচ্ছে। এক্ষেত্রে যারা ঘর পাওয়ার উপযোগী তাদের অনেকে বঞ্চিত হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।নির্দেশনা অনুযায়ী, যাদের নুন্যতম বা ৫ শতাংশ জমি রয়েছে অথচ ঘর নেই তাদের ঘর দেয়ার কথা। কিন্তু এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ভূমি অফিসের সুপারিশপত্রকে অগ্রাধিকার প্রদানের নির্দেশ রয়েছে। দেখা গেছে এসব নির্দেশনার তোয়াক্কা না করে পিএমওর লোকজন সরকারি রক্ষিত বনভূমিতে ঘর করে দিয়েছে।
পালংখালী ইউনিয়নের পশ্চিম পালংখালী গ্রামের মৃত কবির আহামদের ছেলে হারুন রশীদ (৩৫) স্ত্রী ছেলে মেয়ে ও বিধবা মাকে নিয়ে পৈত্রিক ১২ শতাংশ জমিতে সরকারি টিনের বেড়া ও পলিথিনের ছাউনিতে কষ্টে জীবন কাটালেও একটি ত্রাণের ঘরও পাননি। পাশ্ববর্তী বেশ স্বচ্ছল পরিবারকে দেয়া হয়েছে ত্রাণের ঘর।
পালংখালী ইউনিয়ন আওয়ামীলীগের সভাপতি এম এ মঞ্জুর বিডিআরসিএস এর প্রদত্ত ঘরের মান নিয়ে ও উপকার ভোগী নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, কারা কাকে কী পরিমাণের কোন ধরনের ঘর দিচ্ছে সে সম্পর্কে কিছুই জানি না। এসব ঘর প্রদানে ও নির্মাণে ব্যাপক অনিয়মের অভিযোগ করেন তিনি।
পালংখালী ইউপি চেয়ারম্যান গফুর উদ্দিন চৌধুরী বলেন, রোহিঙ্গাদের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এ ইউনিয়ন। বিডিআরসিএসএর লোকজন আমার ইউনিয়নে ৪৪০ টি ঘর বানিয়ে দেবে বলে জানিয়েছিলেন। সে অনুযায়ী আমি কিছু তালিকাও দিয়েছিলাম। পরে মাত্র ২২৫টি ঘর দিয়ে বাকি ঘরগুলো রোহিঙ্গা অবস্থান থেকে ১০-১৫ কিমি দূরে হলদিয়া ও রত্নাপালং ইউনিয়নে দেয়া হচ্ছে। এটা অনিয়ম ও দুর্নীতি।
বিডিআরসিএসর পিএমও প্রোগ্রামের কক্সবাজার প্রোগ্রাম ম্যানেজার মো. জয়নাল এ ব্যাপারে বিস্তারিত জানাতে অপারগতা প্রকাশ করে শেল্টার কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলতে বলেন। সিনিয়র শেল্টার অফিসার কামরুল হাসান নিন্মমানের ঘর নির্মাণ, উপকারভোগী নির্বাচনসহ সব অভিযোগ অস্বীকার করেন। উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সঙ্গে পরামর্শ করে উনার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রকল্প কাজ চালানো হচ্ছে বলে দাবি করেন।
তিনি জানান, নির্দেশনা অনুসরণ করে যাদের নিজস্ব খতিয়ানের জমি রয়েছে তাদেরই শুধু ঘর দেয়া হচ্ছে। পালংখালী ইউনিয়নের জন্য বরাদ্দকৃত ৪৪০টি ঘরের মধ্যে ২২৫ টি পালংখালী ইউনিয়নে দেয়া হয়েছে। বাকি ১২৫ টি হলদিয়া পালং ও ৭৫ টি রত্নাপালং ইউনিয়নে উখিয়া ইউএনওর পরামর্শে দেয়া হচ্ছে। প্রতিটি ঘরের ব্যয় বরাদ্দ ৬০-৬৫ হাজার টাকা বলে তিনি জানান।
উখিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. নিকারুজ্জামান চৌধুরীর বলেন, ঘর দেয়ার পূর্বে বিডিআরসিএসর লোকজনদের বলেছিলাম কীভাবে উপকারভোগী নির্বাচন করা হয়েছে, কারা উপকার ভোগী, কী ধরণের ঘর হবে, ব্যয়ের পরিমাণ বরাদ্দ কত ইত্যাদি বিষয় জানাতে বলা হলেও তারা তা জানায়নি। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর ‘জমি আছে ঘর নাই’ কর্মসূচির নীতিমালা অনুসরণের জন্য বলা হলেও তারা তা মানেনি।
তিনি আরও জানান, সরকারি জবর দখলকৃত বনভূমিতে পালংখালী ইউনিয়নে বেশ কিছু ঘর দেয়ায় সেখান থেকে কিছু ঘর অন্য ইউনিয়নে দিতে বলা হয়েছিল। কিন্তু পরিবর্তীত ঘরগুলো নিয়েও একই অভিযোগ আসছে। প্রতিটি ঘরের ব্যয় বরাদ্দ প্রায় ১ লাখ ২৫-৩০ হাজার টাকার মত হবে।
উখিয়া উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, বিডিআরসিএসর ঘর নির্মাণ ও অনিয়মের বেশ লিখিত অভিযোগ পেয়েছি। তবে কারা, কার মাধ্যমে, কীভাবে ঘরগুলো নির্মাণ করছে সে ব্যাপারে আমি কিছুই জানি না। তাছাড়া একজনের খতিয়ানভুক্ত জমিতে আরেকজনকে ঘর নির্মাণ করে দেয়া বেআইনি। বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হচ্ছে।
Posted ২:২১ পূর্বাহ্ণ | বুধবার, ২৭ নভেম্বর ২০১৯
coxbangla.com | Chanchal Das Gupta