মানিক বৈরাগী(১ ডিসেম্বর) :: দেখা হয়নি আমার কেমন ছিল একাত্তরের অগ্নিচেতনা। অগ্নিঝরা দিনগুলোতে সদ্য মানব শিশু। ওঁ আঁ করে চিৎকার দিই। ছেড়ে দিতে হবে আমার অধিকার। মা একা আমরা ক’জন ছোট ভাইবোন নিয়ে এ গ্রাম ও গ্রাম, এ পাড়া ওই পাড়ায় ছোটাছুটি করছে নিরাপত্তার আশায়। শিকলঘাট বাস স্টেশনের নিজ বাড়ী থেকে আমার বাবার নানার বাড়ি ভেওলা মানিকচরে চলে যান মা। বাবা দাদা দাদি উদ্বেগ উৎকন্ঠায় বাড়িতে অস্থির জীবন যাপন করছে। সারাদেশ উত্তাল স্বাধীনতার মন্ত্রে।
৭ মার্চ এর বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণের পর পরই বঙ্গবন্ধুর ডাকে সাড়া দিয়ে সারাদেশে প্রগতিশীল ছাত্র আন্দোলনের কর্মীরা যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু করেছে। সম্ভবত মার্চের ১০ কি ১১ এর দিকে চকরিয়া কলেজের প্রাক্তন অধ্যক্ষ ভাষা সৈনিক শাহাব উদ্দিন আহমদ চৌধুরীর পরোক্ষ তত্বাবধানে অধ্যাপক হান্নানের সহযোগিতায় বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের স্থানীয় নেতাকর্মীরা কম্পো, ক্যারাটি, বাঁশের লাঠি খেলা,পিটি প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন। ইতোমধ্যে ওই প্রশিক্ষণে যোগ দিয়েছেন চট্টগ্রাম রেলওয়ের কর্মচারী ও পূর্ব পাকিস্তান জাতীয় ফুটবল টীমের কৃতি ফুটবলার মাস্টার নজির আহমদ ( বর্তমান চকরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের যুগ্ন আহ্বায়ক জামাল উদ্দিন জয়নালের শুশ্বর)। তার তত্ত্বাবধানে দশ পনের জনের একটি টিম মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণ ক্যাম্প গঠন হয়।
২৫ মার্চ কালো রাতের পর পরই ২৭ এপ্রিল চকরিয়া কলেজ ক্যাম্পাসে পাকি হানাদার বাহিনী ও দেশীয় দোসর রাজাকারেরা তাদের হত্যাযজ্ঞের ক্যাম্প হিসেবে দখলে নিয়েছে। আমার বড় ভাই জাফর আলম সেই সময় জেলা ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ছিলেন। চট্টগ্রাম কলেজের জনপ্রিয় ছাত্রনেতা ( মেনন গ্রুপ) হাজী বশিরুল আলম চট্টগ্রাম ছেড়ে চকরিয়া চলে আসেন। তিনি তার মতো করে ছাত্র ইউনিয়নের উভয় গ্রুপের ( মেনন ও মতিয়া গ্রুপ) নেতাদের সমন্বয় করে মুক্তিযুদ্ধে সংগঠিত করার চেষ্টা চালান। জাফর ততদিনে বাড়ির কাউকে না জানিয়ে উধাও। চকরিয়ায় পাকি বাহিনী দেশীয় দোসদের পাকি রাজত্ব চলছে তখন। আমার বাবা ভাসানী ন্যাপ নেতা ছালেহ আহমদ কন্ট্রাক্টর কে রাজাকার কমান্ডারেরা প্রায় সময় ক্যাম্পে ডেকে নিয়ে যেতো।
প্রশ্ন করা হতো জাফর কোথায়? নিরুত্তোর থেকে একটি শব্দ উচ্চারণ করতো জানিনা। হুমকি ধমকি কতই না অকট্য ভাষায় গালিগালাজ সয়েছে, আমার মধ্য বয়স্ক বাবা। মুসলিম লীগের দুই নেতার করুণায় বাবা পরে তাদের অত্যাচার থেকে বেঁচে গেলেন। তিনি ঘৃণায় অপমানে বহুদিন শুধু নিরবে কান্নায় করতেন। ছেড়ে দিয়েছেন নাওয়া খাওয়া। দাদা দাদির অনেক অনুনয় বিনয়ে তিন বেলার মধ্যে হয়তো এক বেলা খেয়েছে । অথচ এই বাবাই এক সময় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ডাকে “লডকে লেঙ্গে পাকিস্তান “আন্দোলনে যোগ দিয়েছিলেন। স্বাদের পাকিস্তানের জন্য। সে সময় বাবার হাঁটুতে বৃটিশ সরকারের লেলিয়ে পুলিশের গুলি লেগেছিল। বাবা পাকিস্তান আন্দোলনের কথা, নিজের আত্মত্যাগ গর্বের সাথে গল্প করতেন। সেই পাকিস্তান এরপর ফাকিস্তানে পরিচয় দিতে থাকে,চলে চরম নৈরাজ্য।এসব কারণে নিজের বড় ছেলেকে যুদ্ধে যেতে বারণ করেননি । মনে মনে গৌরববোধ করতেন তার বড় সন্তান যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। স্বাধীন সার্বভৌম একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ গঠনের প্রত্যাশায়।
আমার বড় ভাই জাফর আলম ছাত্র ইউনিয়নের নেতা এবং ভাল সংগঠক ছিলেন। চকরিয়ায় আমাদের জন্মভিটাটি লক্ষ্যাচর ইউনিয়নে। অত্র ইউনিয়নের পশ্চিমে কৈয়ারবিল পূর্বে কাকারা,উত্তরে হারবাং এবং বরইতলী। এ চার ইউনিয়ন ছিলো সামন্ত প্রভু, মুসলিম লীগ ও নেজামে ইসলামীর কেন্দ্রিয় নেতাদের পারিবারিক অবস্থান।
কৈয়ার বিলের আব্বাস আহমদ চৌধুরী (মুসলিম লীগ), বরইতলীতে খতিবে আযম মাওলানা ছিদ্দিক আহমদ (নেজামে ইসলাম), কাকারার আনোয়ার মিয়া ( মুসলিম লীগ) ও লাল আজিজ (পিডিপি) আর লক্ষ্যাচরের রফিক আহমদ চৌধুরী (তরুন শিল্পপতি)। ওই চার ইউনিয়নে বড় বড় মুসলিম লীগ ও নেজামে ইসলামের অবস্থান হলেও তেমনি মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য বাম সংগঠনের অবস্থানও শক্তিশালী ছিলো।
ওই চার ইউনিয়নের মূল কেন্দ্র ছিলো লক্ষ্যাচর ইউনিয়নের শিকলকাটা বাস স্টেশন। মাতামুহুরি নদী কে ঘিরে গড়ে উঠে নদী বন্দর। একমাত্র মাতামুহুরী নদীর শিকলকাটা নদী বন্দর দিয়ে লামা, আলিকদম, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, পেকুয়া, মগনামা, উজানটিয়া, বাঁশখালী যোগাযোগের অন্যতম সুগম নদী যোগাযোগ ব্যবস্থা।
সিকলঘাটায় অবস্থিত চকরিয়া উপজেলা (থানা)আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়, পাশাপাশি ন্যাপ ভাসানি ও মোজাফফর এর কার্যালয়। এসব কার্যালয় থেকেই যার যার রাজনৈতিক মতাদর্শের রাজনৈতিক কার্যক্রম পরিচালিত হতো। মাওবাদী কমিনিউনিস্ট আন্দোলনের কেন্দ্রিয় নেতা ডাক্তার উপেন্দ্র কুমার সুশীল। তার সাথে কমরেড তোয়াহা, কমরেড অধ্যাপক আসহাব উদ্দিন আহমদ, কমরেড অনল সেনের সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্ক ও যোগাযোগ ছিলো। ফলে লক্ষ্যাচর কৈয়ারবিল কাকারা বরইতলীতে বহু কৃষক আন্দোলন সংগঠিত হয় এ অঞ্চলে।কৃষক ক্ষেত মজুর আন্দোলনের পরামর্শ কেন্দ্র ছিলো আমাদের কাচারি ঘর। এ দিকে মোজাফ্ফর ন্যাপের তরুন নেতা ডাক্তার আবদুস সোবহানের চেম্বারে বসে কমিউনিস্ট পার্টির নেতা চকরিয়ায় আন্দোলন সংগ্রামের পরিকল্পনা করতো।
মাওবাদী কমিনিউনিস্ট আন্দোলনের কেন্দ্রিয় নেতা ডাক্তার উপেন্দ্র কুমার সুশীলকে উপদেষ্টা করে তৎকালিন পিকিংপন্থী ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রিয় নেতা হাজী বশিরুল আলমের নেতৃত্বে ছাত্র ইউনিয়ন (মস্কোপন্থী) জেলা নেতা কমরেড জাফর আলম (পরবর্তীতে কক্সবাজার জেলা সিপিবির সাধারণ সম্পাদক) ডাক্তার খ ম রফিক (বতর্মান চকরিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের উপদেস্টা নুরুল আলম চেয়ারম্যানের ছোট ভাই), আরিফুল হক চৌধুরী ( মুক্তিযুদ্ধের প্রশিক্ষণদাতা মাস্টার নজির আহমদের বড় ছেলে), মাস্টার ফয়জুল কবির, বাদল, শওকত ওসমান বাবুল, ন্যাপ নেতা আশেক আহমদ, কৃষক নেতা আবদুশ শুক্কর, বামপন্থী তাত্ত্বিক এজাহার হোসাইন ( শহীদ আবদুল হামিদের বড় ভাই), চকরিয়া কলেজের তরুণ অধ্যাপক আবদুল হান্নান, চকরিয়া কলেজে সদ্য যোগদানকারী অধ্যাপক আমানউল্লাহ খান (দাশর্নিক চিন্তাবিদ ড.সলিমুল্লাহ খানের বড় ভাই), অধ্যাপক আবু তাহের সিকদার, কৈয়ারবিলের আমীর হোসেন, হাজী দিলদার হোসেন (দিলদার খলিফা), পটিয়ার কমরেড অনিল লালা, ডুলাহাজারার কামাল উদ্দিন চৌধুরী ( কামাল ড্রাইভার), কে এম সালাউদ্দিন, কৈয়ারবিলের সরোয়ার আলম, শিলখালীর ছাবের আহমদ, পালাকাটার ফজলুল কাদের চৌধুরী (সাংবাদিক), বিএমচরের মাস্টার কবির আহমদ (সাম্যবাদী দল ও লেখক শিবিরে সংগঠক) প্রমুখকে নিয়ে চকরিয়া মুক্তিফৌজ গঠন করা হয়।
এই মুক্তিফৌজের সাথে যোাগাযোগ রাখতেন কমিউনিস্ট নেতা অধ্যাপক আসহাব উদ্দিন আহমদ, পটিয়া থেকে কমিউনিস্ট পার্টি নেতা পূর্ণেন্দু দস্তিদার, চট্টগ্রাম জেলা ছাত্র ইউনিয়নের নেতা মোহাম্মদ মুছা, কমরেড সুধাংশু বিমল দত্ত (সাতকানিয়া) প্রমুখ।
ওই সময়ে আওয়ামী লীগ ছাত্রলীগ গঠন করলেও সংগ্রাম কমিটি ও বিএলএফ এর অনেক সদস্যরা ভারত ও বার্মায় প্রশিক্ষনের জন্য চলে যায়। কিন্তু চকরিয়াতে কমিউনিস্ট গেরিলা বাহিনীর মুক্তিফৌজ ন্যাপ কম্উিন্টি পার্টি ছাত্র ইউনিয়ন(উভয় গ্রুপ) চকরিয়াতেই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। তারা বারবাকিয়া শীলখালী ও বিএমচরে প্রশিক্ষণ সেন্টার গড়ে তোলেন। ওই প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের প্রশিক্ষক ছিলেন সুবেদার মেজর গোলাম কাদের, হাবিলদার আবুল কালাম ও মাস্টার নজির আহমদ। প্রশিক্ষণ শেষে মুক্তিফৌজ বিভিন্ন ইউনিটে ভাগ হয়ে সাহারবিল,বারবাকিয়া, কাকারা, ডুলাহাজারা, সাতকানিয়ার সদাহ, বাঁশখালীর নাপোড়া, চিম্বুকের পাদদেশে এবং চকরিয়ার কৈয়ারবিল ও বিএমচরেরর বিভিন্ন প্রতিরোধ যুুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সংগঠিত করে।
মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে রাজাকার বাহিনী আমাদের বাড়ি (ছালেহ আহমদ কন্ট্রাক্টর এর বাড়ি) লুটপাট করে।সিকলঘাটা বাস স্টেশনে বাবার কয়েকটি ভাড়া দোকান ছিলো। এর মধ্যে দুটি দোকান ছিলো স্বর্ণের একটি সেলুন আরেকটি মুদির দোকান। মুক্তিযুদ্ধের সময় স্বর্ণের দোকানের মহাজনেরা একজনের বাড়ি হারবাং, আরেক জনের বাড়ি লোহাগড়ায়। তারা তাদের দোকানের সকল স্বর্ণালংকার ও অন্যান্য ধাতব মুদ্রা বড় কয়েকটি টিনের কন্টেনারে ভরে রাখে।পরে তারা আমার বাবার আমানতদার হিসাবে জমা রাখেন।পরে তারা সময় সুযোগ বুঝে ভারতে চলে যায়।
বাবা আমানতের স্বর্ণের টিন গুলো বাড়ির ভেতর মাটি খুড়ে গর্ত করে লুকিয়ে রাখে। সে কয়েক মণ ওজনের স্বর্ণের লোভে আমাদের বাড়িতে রাতের অন্ধকারে হামলা চালায় এবং ওই সময় আমার বাবাকে ধরে নিয়ে যাবার উদ্দেশ্য ছিলো, ভাগ্য ভালো বাবা সে রাতে বাড়িতে ছিলোনা।
বাড়িতে ছিলো আমার দাদা পীরে কামেল হজরত আবদুল খালেক মিয়াজী (রঃ)ও আমার দাদী।
আমার দাদা ছিলেন বিখ্যাত কবিরাজ। তিনি বাড়িতে বসেই কবিরাজী ওষুধ তৈরী করতেন এবং পরবর্তীতে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে তার মুরিদদের বিক্রি করতেন। সে সময় তার উদ্ভাবিত একটি প্রসিদ্ধ ম্যাসেজ তৈল বেশ সুনাম কুঁড়িয়েছিলো। ওই তেলের নাম ” শতগুণি তৈল”। এ তৈলের সুনাম বার্মার রেঙ্গুন ও পশ্চিম বঙ্গের কলকাতায় ছড়িয়ে পড়ে।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন দাদার কবিরাজী ব্যবসা ও সুফি পীরের দাওয়াতি কর্মের ব্যাপক ক্ষতি হয়। এরপর ও তিনি রেঙ্গুন কলকাতা ও দেশের অন্যান্য জেলায় যাওয়া আসা বন্ধ হয়ে যায়। ফলে দাদা বাড়িতেই কবিরাজি ডাক্তারি ও ঔষধ বানাতেন ও বিক্রি করতেন যা সম্ভব।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য নিজের প্রতিষ্ঠিত মসজিদে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করতেন।মহাজনের আমানতি স্বর্ণের কথা কিভাবে জানাজানি হলে রাজাকার ও পাকবাহিনীরা বাড়িতে স্বর্ণের কন্টেনার লুট করতে আসে।কিন্তু দাদা পীর হিসাবে লুকিয়ে রাখা মাটি চাপা দেয়া স্বর্ণের টিনের চারপাশে দোয়া দরুদ পড়ে পানি পড়া ছিঠিয়ে দিয়েছিলেন। দাদা জানতেন রাজাকারেরা এই আমানতি স্বর্ণের খবর পেলে লুট হতে পারে।
রাজাকারের গুন্ডারা যাতে লুট করতে না পারে।
ঠিকই এক রাতে স্বর্ণের খোজে আসে,যারা লুট করতে এসেছিল বাড়ির ভেতরে ঢোকার সাথে সাথেই নাকি চোখ অন্ধ হয়েযায়। তারা যখন বাড়ির ভেতর শক্তিশালী টর্স ব্যবহার করেও যখন দেখতে পাচ্ছেনা, চোখ জ্বালা যন্ত্রনায় অস্থির হয়ে পড়ে।এরপর তারা হুর হুর করে ঘরের ভেতর থেকে হয়ে যায়। যখন তারা উঠানে এসে যখন তাদের চোখেরর জ্বালা যন্ত্রণা করছেনা, চোখে দেখতে ঠিকই আগের মতো দেখতে পাচ্ছে।
এই মোনাফেক মুসরিকের বাচ্চারা যাবার সময়ভক গোয়ালঘরের গরুছাগল সহ অন্যান্য গৃহপালিত পশু যা ছিলো তা লুটকরে নিয়ে যায়।সাথে ধানের গোলা,কাচারি ঘর,খড়ের গাদা জ্বালিয়ে দিয়ে যায়।তারা চলে যাওয়ার পর প্রতিবেশীদের সহায়তায় আগুন থেকে আমাদেরর বাড়ি ঘর রক্ষা পায়।
এর ক’দিন পর আমার বাবা বাড়িতে এলে সব শুনে আব্বাস মিয়ার সাথে যোগাযোগ করে সমাধানের আশায়। রাজাকার ক্যাম্প গরু উদ্ধারের চেষ্টা করেছিলেন।কিন্তু গরু গুলো পাকি বাহিনী তাদের সামরিক ট্রাকে করে অন্যত্র নিয়ে যায়।
আমাদের সিকলঘাটায় পাঞ্জাবিদের টর্সাল সেল ও ক্যাম্প হওয়ার কারণে সবসময় পাঞ্জাবি তে গিজগিজ করতো স্টেশন। এমন সময় মানুষের নিরানন্দের মাঝে হাসির খোরাক সৃষ্টি হয়। আমাদের দোকানের ভাড়াটিয়া নাপিত গোবিন্দকে পাকি হানাদার বাহিনী ধরে নিয়ে যায় ক্যাম্পে। তারা উর্দুতে চুল দাড়ি কামানোর কথা বলে; এ্ই গোবিন্দ বাল কাটমে,উত্তরে গোবিন্দ বলে –‘কাপড় আলগা মে,’ এ কথা বলাতে গোবিন্দকে হানাদারেরা এমন মাইর মারে এবং বেঁধে রাখে। এবারও আমার বাবার রফিক মিয়ার সহায়তায় তাকে রাজাকার ক্যাম্প থেকে ছাড়িয়ে আনেন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালিন সময়ে তরুণ শিল্পপতি রফিক মিয়া রাতের বেলায় সংগ্রাম পরিষদ ও মুক্তিফৌজকে অর্থ ও রসদ সামগ্রী সহায়তা করতো বলে আমার বাবা ও লোকের মুখে শোনা গেছে।
মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে দেশ স্বাধীন হলে নরেন্দ্র মহাজনেরা দেশে ফিরে এলে তাদের আমানত দেয়া সকল স্বর্ণালংকার ও মুদ্রা যেভাবে জমা দিয়েছিলো ঠিক সেভাবে নরেন্দ্র মহাজনের হাতে তুলে দিয়েছেন। সেদিন নরেন্দ্র মহাজন আমার বাবাকে পায়ে ধরে নমস্কার করে ধর্মের ভাই ডেকেছিলেন।
এরপর থেকে আমরাও নরেন্দ্র মহাজনকেও কাকা বলেই জানতাম। কারণ আমার বাবারা ছিলো এক ভাই দু বোন। রক্তের আত্মীয় হিসেবে বাবা যাকে চাচা হিসেবে জানত তিনি আমার দাদার সৎ ভাই। তারা কেউ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিলোনা। সে চাচার বড় ছেলে রাজাকারদের সাথে আমাদের বাড়িও লুটপাট করতে এসেছিল। বর্তমানে তিনি বিএনপি নেতা। নরেন্দ্র মহাজন আমার বাবার (২০০৫) মৃত্যুর অল্প কদিনের মধ্যে মৃত্যুবরণ করেন।
সারাদেশে কমিউনিস্ট পার্টি ন্যাপ ও ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে গেরিলা কমান্ড গঠন হলে চট্টগ্রামের কমরেড পুণেন্দু দস্তিদার, আহসান উল্লাহ ও মোহাম্মদ মুছার নির্দেশে কক্সবাজার মহকুমার সকল থানায় গেরিলা কমান্ড গঠনের নির্দেশ দেয়। এরই প্রেক্ষিতে জোয়ারিয়া নালার ন্যাপ নেতা আবু তাহের সিকদার, রামুর প্রফেসর মোশতাক আহমদ, কক্সবাজারের কমিউনিস্ট পার্টির নেতা বিপ্লবী সুরেশ চন্দ্র সেন, ন্যাপ নেতা পীযুষ চৌধুরী (শহীদ জ্ঞানেন্দ্র লাল চৌধুরীর একমাত্র ছেলে), ইদ্রিস আহমদ, ছাত্র ইউনিয়ন নেতা শহীদ সুভাষ দে, রাখাল চন্দ্র পাল, আমিন, দেবব্রত, সমীর পাল, পেকুয়ার মোস্তফা, সিরাজুল মোস্তফা (কক্সবাজার সরকারি মহিলা কলেজের অধ্যক্ষ থেকে অবসরপ্রাপ্ত) প্রমুখ।
জুলাই আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে ( সঠিক দিন তারিখ পাওয়া যায়নি) নৌকায় মাতামুহুরী নদী হয়ে ঈদগাঁও ,ঈদগাঁও থেকে টেক্সী যোগে মুক্তিফৌজ কমান্ডার কমরেড জাফর আলম রামুর জোয়ারিয়ানালার ন্যাপ নেতা আবু তাহের সিকদারের রামুর চা বাগানে গোপন মিটিং এ অংশ গ্রহণ করেন।যুদ্ধ পরিকল্পনা শেষে কক্সবাজার যাওয়ার সময় খরুলিয়ায় পৌছলে রাজাকার বাহিনী তাকে (জাফর আলমকে) চিনতে পেরে বন্দি করে। এ খবর জানাজানি হলে সংগ্রাম পরিষদ ও আওয়ামীলীগ নেতা এডভোকেট জহিরুল ইসলাম ও জমাদার ফজলুল করিমের সহায়তায় রাজাকার বাহিনীর কাছ থেকে উদ্ধার হন।
উদ্ধারের পরে কক্সবাজারে কমিউনিস্ট পার্টি- ন্যাপ ছাত্র ইউনিয়ন গেরিলা কমান্ড নেতা পীযুষ চৌধুরী, ইদ্রিস আহমদ, সমির পাল প্রমুখের সাথে যোগাযোগ করে চট্টগ্রাম কমান্ডের নির্দেশের কথা জানিয়ে কাজ শুরু করেন। এ সময় মহকুমা ছাত্র ইউনিয়ন নেতা সুভাষ দে শহীদ হওয়ার সংবাদ শুনে আরো বেগমান হয়ে মুক্তিযুদ্ধের গেরিলা কমান্ড স্থানীয় ভাবে যে যেভাবে পারে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
কমরেড জাফর গোপনে কক্সবাজারে কয়েকদিন অবস্থান করে উখিয়ার ভালুকিয়ায় ন্যাপ নেতা অরবিন্দ বড়ুয়ার সাথে যোগাযোগ করার জন্য রওয়ানা দেন। যাওয়ার পথে কোট বাজার স্টেশনে কক্সবাজার মহকুমা সংগ্রাম পরিষদের নেতা শমশের আলম চৌধুরীর সাথে সাক্ষাত ও কৌশল বিনিময় করেন। শমশের আলম চৌধুরীর তাঁর একজন বিশ্বস্ত কর্মী নিয়ে ভালুকিয়া রওয়ানা দেন। ভালূকিয়ায় অরবিন্দ বড়ুয়ার বাড়িতে নাইক্ষংছড়ি পাহাড়ের দিকে কমিউনিস্ট পার্টি, ন্যাপ ছাত্র ইউনিয়ন গেরিলা কমান্ড গঠন করে।ঐ গেরিলা কমান্ড আবার বান্দবানের বিএলএফ ও গেরিলা কমান্ড যৌথ ভাবে মুক্তিযুদ্ধের বেশ কয়েকটি সফল অপারেশন পরিচালনা করেন। সেই সব বীরত্বের চিত্র আমি এখানে লিখছি না,কারণ আমি মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সন্তান, মুক্তযোদ্ধা না তাই।আমি যেভাবে মুক্তিযুদ্ধের পরবর্তী এই বাংলাদেশ কে দেখেছি, আর যা শ্রুতি হিসাবে পরিবার থেকে জেনেছি তাই উল্লেখ করলাম।
হেরে গেলো মুক্তিযুদ্ধের জাতীয় প্রবিত্র চেতনা
১৯৭১সনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কে পারিবারিক ভাবে হত্যার মধ্যদিয়ে যে জাতি পাকিস্তানের শক্তিশালী সামরিক বাহিনী ও পূর্ব বঙ্গে সাম্প্রদায়িক মৌলবাদী গোষ্ঠীর বিপক্ষে বাশের লাটি তৈরি করে শুধু প্রাণের আবেগ কে সম্বল করে নয়মাসের যুদ্ধের মধ্য দিয়ে একটি স্বাধীন সার্বভৌম ভাষাভিত্তিক জাতি রাষ্ট্র কায়েম করেছিলো তার নাম বাংলাদেশ।
এই জাতি রাষ্ট্র টির বীজ অংকুরিত হওয়ার আগেই সেই রাষ্ট্রের ভেতরে স্বদেশী রাজাকার, আল বদর, আল শামস,শান্তি কমিটি ও পাকিস্তান পন্থি মাওবাদী রাজাকারেরা পাকিস্তানিরা যা করতে সাহস করেনি তারাই সেই ঘৃণ্য সাহসে হত্যা করলো জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সহ তাঁর পরিবারের দুই কন্যা ছাড়া শিশুপুত্র রাসেল কে পর্যন্ত। হত্যা করলো ভাই ভাগ্নে সহ অসংখ্য আত্মীয় স্বজন। তারা এতেই ক্ষান্ত হয়নি সারা দেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সচেতন প্রতিবাদী, প্রগতিশীল পরিবারের উপর ও নির্মম নির্যাতন চালালো।
হত্যা করা হলো সামরিক মুক্তিযোদ্ধাদের। খালেদ মোশাররফ কে হত্যা করা হলো ভারতীয় চর, দালাল অভিযোগে বীর মুক্তিযোদ্ধা খালেদ মোশাররফ কে।
আমি এ লেখায় সে দিকে যেতে চাইনা।আমি শুধু আমার পরিবার পরিজন শুধু মাত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রতি অবিচল আস্থা ও রাজনৈতিক সাংগঠনিক ভাবে সক্রিয় থাকার কারণে রাষ্ট্র মদদে মামলা, হামলার একটি নমুনা তুলে ধরলাম মাত্র।
আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে এ বাঙালি জাতির একটি মাত্র রাজনৈতিক দল আওয়ামীলীগ এর ভেতরেও এরা সফল ভাবে অবস্থান করছে, তাদের খোলস পাল্টে।শুধুমাত্র এ দলের নেতা এমপির রাজনৈতিক আদর্শহীনতা, দোদুল্যমানতা,অনৈতিক ব্যবসায়িক সম্পর্ক, আত্মীয়তা, দেউলিয়া পনার কারণে। এসব বিষয় কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সময় ও ছিলো। তবে প্রাদুর্ভাব ছিলোনা।
পক্ষান্তরে একটি ভাষাভিত্তিক অসাম্প্রদায়িক জাতি রাষ্ট্র গঠনের যে লড়াই তা অংকুরেই রয়ে গেলো। কিন্তু যারা এমন স্বপ্ন বিনির্মাণের জন্য এত আত্মত্যাগ করলো খেটে খাওয়া সাধারণ মেহনতী মানুষ,নিম্নবিত্ত, মধ্যবিত্ত, পেশাজীবি মহত মানুষের দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে সেই পঁচাত্তর থেকে।
১৯৭৫এর পর বাঙ্গালির জাতীয় চার মূলনীতি কে জীবন যাপনের আদর্শিক অবস্থান এই জাফর আলম একাত্তরের অগ্নি চেতনা বহন করে চলছেন। ৭৫র পরবর্তী মুক্তিযুদ্ধের জাতীয় চার মূলনীতি ধূলিসাৎ হলেও এখনো হতাশ হননি আক্ষেপ করেনা আমার বড় ভাই। আমাদের ৫ ভাই ২ বোনের মধ্যে একজনও আদর্শ চ্যুত হয়ে বিএনপি জামায়াতের সাথে জড়িত হয়নি। অথচ বর্তমান সুবিধাবাদী সময়ে এক ভাই আওয়ামী লীগ, এক ভাই বিএনপি, চাচা জামায়াত, আবার অনেকে মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হয়ে ও বনে গেছেন জামায়াত শিবিরের ক্যাডার।
স্বাধীনতার পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর সরকারের সময় রিলিফ চুরি ও লুটপাতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতে যেয়ে জাফর আলম জেল খেটেছেন। স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের সময়ে মালুমঘাট, রিংভং, চরণদ্বীপে কৃষক ও ক্ষেত মজুর এবং খাস জমির আন্দোলন করতে গিয়েও তিনি কারাভোগ করেন।
অত্র লেখক কে ১৯৯১সনে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবির পা কেটে নির্মম নির্যাতন করে।পড়ালেখার বিচ্ছেদ ঘটে।চকরিয়া উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ও জেলা ছাত্রলীগের সিনিয়র সদস্য হওয়ার অপরাধে বিগত জোট সরকারের সময় লেখকের ফেরারী জীবন, বাড়ি ঘর লূটপাট (একাত্তরে যারা আমাদের বাড়িতে লুটপাট করতে এসেছিল তাদের সন্তানরাই বিএনপির জিয়াপরিষদের নেতাকর্মী হিসেবে বাড়ি লুটপাট করে)। মামলা করায় আত্মীয় স্বজনের বিরুদ্ধে। এমনকি এসএসসি পরীক্ষার্থী ভাতিজাও মামলার আসামি হয়।থানায় বসে এসএসসি পরিক্ষা দিতে হয়।
মুক্তিযুদ্ধ,সমাজতন্ত্র, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধুর আদর্শের চেতনা আমরা চল্লিশ বছর ধরে অবিচল আস্থায় পথ চলছি। বিন্দু পরিমান লোভের তাড়নায় আমরা কেউ আদর্শচ্যুত হয়নি। একাত্তর পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগের অনেক নেতারাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সনদকে কেজি মাপা ধরে বিক্রি করে আর আমার সময়ে বিক্রি হয় মুজিবের চেতনা। এমনি এক স্বদেশ পেলাম আমরা মৌলিক মুক্তিযোদ্ধা যারা কমরেড মনি সিংহ, মোজাফফর আহমদ, বঙ্গবন্ধুর চেতনাকে ধারণ করে বামধারার মুক্তিযোদ্ধারা দেশ স্বাধীন করেছিলো। তারা সনদের পেছনে ছুটে নি।
ছুটে ছিলো মুক্তিযোদ্ধা পরবর্তী একটি স্বাধীন সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্টার প্রত্যয়ে। কলঙ্কিনী পচাত্তর, বেহুলা বাংলার সকল চেতনা আদর্শ লক্ষ্য কে ধ্বংস করে আমরা একটি সেলুকাস বাংলাদেশে বসবাস করছি। তবুও রবীন্দ্র নাথের অমিয় বাণীর মতোন বলি “সত্য যে কঠিন কঠিনেরে ভাল বাসিলাম। সত্য কখনো করেনা প্রবঞ্চনা।” এই বাণী মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাহিত জাফর আলম ও তার পরিবারের শান্তির ঠিকানা। আমেন।
মানিক বৈরাগী : কবি, শিশুতোষ লেখ, নব্বুইয়ের নির্যাতিত ছাত্রনেতা, কক্সবাজার, বাংলাদেশ।
প্রকাশিত গ্রন্থ
কবিতা
১-গহীনে দ্রোহ নীল
২-শুভ্রতার কলঙ্ক মুখস্ত করেছি
৩-নৈনিতালের দিন
শিশুতোষ গল্প
১-বন বিহঙ্গের কথা
২-ইরাবতী ও কালাদান
সম্পাদক
গরান (ছোট কাগজ)
তড়িৎ বার্তা-suamanik1971@gmai.com