কক্সবাংলা ডটকম(১৮ নভেম্বর) :: একটি জেলা থেকে আওয়ামী লীগের মনোনয়নপ্রত্যাশী এক নেতা দলের জরিপে প্রথম স্থানে আছেন। এই তথ্য তিনি দলের সাংগঠনিক সম্পাদকসহ নানা সূত্র থেকে জেনেছেন। আর দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা ঘোষণা করেছেন, এগিয়ে থাকারাই মনোনয়ন পাবেন। তবে মনোনয়ন কে পাচ্ছেন, এই তথ্য জানার জন্য চেষ্টার কমতি নেই।
ওই নেতা দলের মনোনয়ন বোর্ডের দুজন সদস্যের সঙ্গে দেখা করেছেন, কথা বলেছেন দুজন সাংগঠনিক সম্পাদকের সঙ্গে। সেখান থেকেও নিশ্চিত তথ্য না পেয়ে গেছেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একজন কর্মকর্তার কাছে। কিন্তু সেখানেও পাননি নিশ্চিত তথ্য।
ওই নেতার মতো প্রতিটি আসনেই ঘটছে একই ধরনের ঘটনা। যেসব এলাকায় দলের অবস্থান শক্তিশালী, সেসব এলাকায় তো বটেই, এমনকি যেসব এলাকায় অবস্থান দুর্বল, সেসব এলাকাতেও মনোনয়নপ্রত্যাশীদের ঘুম হারাম হয়ে গেছে।
কেবল আওয়ামী লীগ নয়, বিএনপির পরিস্থিতিও ভিন্ন কিছু নয়। চেষ্টা-তদবির, দেনদরবারে মনোনয়ন নিশ্চিত করার হেন চেষ্টা নেই, যা তারা করছেন না।
এবার আওয়ামী লীগ থেকে প্রতীক পাওয়ার আশায় ফরম নিয়েছেন চার হাজার ২৩ জন নেতা। অর্থাৎ গড়ে প্রতিটি আসনে মনোনয়ন চাইছেন ১৩ দশমিক ৪১ জন নেতা। এত বেশি ফরম বিক্রি হওয়ায় বিরক্ত হয়েছেন দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনা।
বিএনপির ফরম বিক্রি হয়েছে আরও বেশি চার হাজার ৫৮০টি। অর্থাৎ সেখানে আগ্রহী প্রার্থী আরও বেশি। অর্থাৎ প্রতি আসনে ১৫ দশমিক ২৬ জন।
দুই দলেরই সূত্র বলছে, ফরম বিক্রি শুরুর আগেই অধিকাংশ আসনে প্রাথমিকভাবে প্রার্থী বাছাই করা হয়ে গেছে। আনুষ্ঠানিকতার জন্যই কেবল চূড়ান্ত করার ঘোষণা দেওয়া।
তবে শেষ মুহূর্তে মনোনয়নপ্রত্যাশীরা তাদের পক্ষে সিদ্ধান্ত নিয়ে আসার চেষ্টা করছেন। কেন্দ্রীয় শীর্ষ নেতাদের পাশাপাশি দপ্তরে খোঁজখবর রাখেন এমন কর্মীদেরও ধরছেন তারা। অবশ্য কেউ কেউ নিশ্চিত না হয়েই এলাকায় ঘোষণা দিয়ে বেড়াচ্ছেন, তিনি পেয়ে গেছেন মনোনয়ন।
আ.লীগে ভিড় বাড়ছে কেন্দ্রীয় নেতাদের বাসা-কার্যালয়ে
মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সাক্ষাৎকার হয়ে গেছে ১৪ নভেম্বর। কিন্তু এখনো কেউ জানেননি মনোনয়ন মিলেছে কি না। কিন্তু তর সইছে না। তারা মনোনয়ন বোর্ডের সদস্যদের কাছে ধরনা দিচ্ছেন। নিজের জন্য তদবির করছেন। শেষ মুহূর্তে শেখ হাসিনার দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠজনদের কাছেও মনোনয়নপ্রত্যাশীদের ভিড় বাড়ছে।
শেখ হাসিনা বারবার বলেছেন, এবার তিনি জরিপ প্রতিবেদনকে গুরুত্ব দেবেন। জনপ্রিয়তা দেখে মনোনয়ন দেবেন। এখানে চেষ্টা-তদবির বা দলের বড় নেতা-ছোট নেতা দেখা হবে না।
মনোনয়ন চূড়ান্তের বিষয়টি কত দূর এগোল জানতে চাইলে দলের সভাপতিম-লীর সদস্য ও সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য রমেশ চন্দ্র সেন বলেন, ‘প্রার্থিতা বাছাইয়ের বিষয়টি এখনো প্রাথমিক স্তরেই। আমরা মাঠপর্যায়ের জরিপ প্রতিবেদনগুলো বিশ্লেষণ করছি। এ সপ্তাহের মধ্যেই সব চূড়ান্ত হবে বলে আশা করছি।’
কেউ কেউ যে নিজের আসনে মনোনয়ন চূড়ান্ত বলে প্রচার করছেন, এ বিষয়ে জানতে চাইলে রমেশ বলেন, ‘কাউকে এখনো কোনো সংকেত দেওয়া হয়নি। কিছুই জানানো হয়নি। যারা বলছেন, তারা নিজেদের জাহির করার জন্য এ কাজ করছেন। মনোনয়ন বোর্ডের সদস্যদের অনেকে মনোনয়ন চেয়েছেন। কিন্তু তারা নিজেরাও নিজেদের কথা জানেন না।’
অন্ধকারে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীরাও
বিএনপিতেও পরিস্থিতিটা যে অন্য রকম, তা নয়। যারা ফরম জমা দিয়েছেন, তারা বিভিন্ন পর্যায়ে চেষ্টা-তদবির করে জানার চেষ্টা করছেন, তাদের সম্ভাবনা কতটুকু।
একাধিক মনোনয়নপ্রত্যাশী বিদেশে অবস্থানরত দলের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে যোগাযোগ-সম্পর্ক রাখছেন, কেউ কেউ দেখাও করে এসেছেন। কেবল তিনি নন, তার ঘনিষ্ঠ বলে পরিচিতদের সঙ্গেও চলছে দেনদরবার। ধরনা দিচ্ছেন মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ স্থায়ী কমিটির সদস্যদের কাছেও।
দলটির নীতিনির্ধারণী সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীদের বিষয়টিকে বিশেষ বিবেচনায় রেখে তারা প্রার্থী চূড়ান্ত করবে। এ ছাড়া দলের দুঃসময়েও যারা দলের জন্য ভূমিকা রেখেছেন, মামলা, দ-ের মুখোমুখি হয়েছেন, তাদের বিষয়টি দল বিশেষভাবে মূল্যায়ন করবে।
বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মধ্যে যারা এবারের নির্বাচনে অংশ নিতে পারছেন না, তাদের স্বজনেরা মনোনয়ন চেয়ে আবেদন করেছেন। দল তাদের মূল্যায়ন করবে, এই আস্থা থেকেই তারা প্রার্থী হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করছেন।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেন, ‘প্রতিবার ভোটের আগে মনোনয়নপ্রত্যাশীরা আমাদের দোয়া নিতে আসেন। এবারও এসেছেন। স্থানীয় পর্যায়ে জনপ্রিয়তায় কে এগিয়ে আছেন, তার ভিত্তিতেই মনোনয়ন দেব।’
আজ রোববার থেকে বিএনপির মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ শুরু হবে। নয়াপল্টনের কার্যালয়ে দলের সংসদীয় মনোনয়ন বোর্ডের সদস্যরা ছাড়াও সংশ্লিষ্ট জেলার সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদককে থাকতে বলা হয়েছে। বিভাগভিত্তিক এই সাক্ষাৎকার শুরু হবে রংপুর ও রাজশাহী বিভাগ দিয়ে।
বিদ্রোহীদের বিষয়টিও মাথায় রাখছে দুই দল
বিপুলসংখ্যক মনোনয়নপ্রত্যাশীর বিপরীতে প্রার্থী নির্বাচনে দুই দলকেই হিমশিম খেতে হচ্ছে। দুই দলের নীতিনির্ধারকেরা প্রকাশ্যে কিছু না বললেও তাদের দুশ্চিন্তার কারণ হতে পারেন মনোনয়নবঞ্চিতরা। যারা মনোনয়ন পাবেন না, তাদের একটি অংশ বিদ্রোহী প্রার্থী হতে পারে, এমন খবরও দুই দলের কেন্দ্রে আছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন সদস্য বলেন, ‘এই মুহূর্তে বিএনপির নির্বাচনে যাওয়াটা এক ধরনের চ্যালেঞ্জ। ঝুঁকিও আছে। কিন্তু তার ওপর এত সংখ্যক মনোনয়নপ্রত্যাশী আরেক চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।’
‘এক যুগ ধরে দল ক্ষমতায় নেই। অনেক নেতাকর্মী মামলা-মোকদ্দমা, জেল-জরিমানায় হয়রান হয়েছেন। নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তারা তো তাদের ত্যাগের মূল্যায়ন চাইবেন। সবাইকে খুশি করে তৃণমূলে দলের ঐক্য ধরে রাখতে না পারলে ভোটে সুবিধা হবে না।’
বিএনপিকে ৫০ আসনের তালিকা দিয়েছে জামায়াত
আসন্ন একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জোটগতভাবে মনোনয়নের প্রত্যাশায় ৫০ জন সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকা বিএনপির হাতে তুলে দিয়েছে জামায়াত। শনিবার (১৭ নভেম্বর) জামায়াতের একটি প্রতিনিধি দল ২০ দলীয় জোটের নেতৃত্বদানকারী বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও নজরুল ইসলাম খানের কাছে তালিকা পৌঁছে দেয়। জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের দায়িত্বশীল সূত্র এ তথ্য নিশ্চিত করেছে।
সূত্র জানায়, সারাদেশে ৬০টি আসন থেকে স্বতন্ত্রভাবে প্রার্থিতার জন্য মনোনয়নপত্র তুলেছিলেন জামায়াতের প্রার্থীরা। এই ৬০ জনের তালিকা থেকে যাচাই-বাছাই করে ৫০ জনের নামের তালিকা দলের পক্ষ থেকে বিএনপিকে দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে বিস্তারিত ব্যাখ্যাসহ প্রার্থী তালিকা হস্তান্তর করা হয়েছে।
তবে জামায়াতের কেন্দ্রীয় নায়েবে আমির অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘কেন্দ্রীয় সিদ্ধান্ত মোতাবেক ৬০টি আসন থেকে মনোনয়নপত্র উত্তোলন করেছেন প্রার্থীরা। এই তালিকা ধরেই একটি বাছাই তালিকা বিএনপির কাছে দেওয়ার কথা রয়েছে। আমি নিশ্চিত না, তালিকা দেওয়া হয়েছে কিনা।’
এ বিষয়ে জানতে চেয়ে ২০ দলীয় জোটের সমন্বয়ক নজরুল ইসলাম খানকে ফোন করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।
জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাচন পরিচালনা কমিটির একটি সূত্র জানায়, ৬০টি আসন থেকে মনোনয়নপত্র তুলেছেন তাদের প্রার্থীরা। এই তালিকা থেকে ৫০টি আসনে নির্বাচনের জন্য বিএনপিকে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তালিকায় নাম প্রস্তাব ছাড়াও সংশ্লিষ্ট আসনে ভোটের হিসাব, জামায়াতের বিগত দিনে প্রাপ্ত ভোট, সম্ভাবনা, সংশ্লিষ্ট এলাকায় বিএনপির অবস্থানসহ বিস্তারিত তথ্য দেওয়া হয়েছে।
দলের কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের একজন সদস্য জানান, বিএনপির সিদ্ধান্ত নিতে যেন সুবিধা ও সহজ হয়, সেজন্যই বিস্তারিত তথ্য দেওয়া হয়েছে।
দলের প্রভাবশালী দুই নেতার ভাষ্য, আমাদের প্রাথমিক প্রস্তাব ৫০টি। এরপর যাচাই-বাছাই করে জোটগত মনোনয়ন নিশ্চিত করা হবে। কোন-কোন আসনে বিএনপি জোটগত মনোনয়ন দিতে চায়, সে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রস্তাবিত তালিকায় বর্ণনা দেওয়া হয়েছে।
শনিবার এই তালিকা দিতে বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের সঙ্গে যোগাযোগ করে জামায়াতের শীর্ষ পর্যায়ের একনেতা। এরপর তার পরামর্শেই দলের প্রতিনিধি দলের সদস্যরা বিএনপির স্থায়ী কমিটির দুই সদস্যের কাছে তালিকা হস্তান্তর করেন।
মির্জা ফখরুলের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে জামায়াতের ওই নেতাকে তিনি জানান, জোটগতভাবে মনোনয়নের বিষয়টি সমন্বয় করছেন খন্দকার মোশাররফ হোসেন ও নজরুল ইসলাম খান।
তবে জামায়াতের শীর্ষ পর্যায়ের একনেতার সঙ্গে কথা বলে স্পষ্ট, জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সঙ্গে বিএনপির মূল নির্বাচনি জোট থাকায় তাদের এ বছর অনেক ছাড়ের জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে। বিএনপির তরফে অনানুষ্ঠানিকভাবে ১৮-২০টি আসন পাওয়ার বিষয়ে নিশ্চয়তা পাওয়া গেলেও দরকষাকষি করবে জামায়াত। এক্ষেত্রে দলটির পছন্দ অন্তত ৩০-৩৫টি আসন।
জামায়াতের নির্বাহী পরিষদের সূত্র জানায়, স্বতন্ত্র মার্কায় নির্বাচন করতে জামায়াতের প্রার্থীরা মনোনয়নপত্র উত্তোলন করলেও বিএনপির পক্ষ থেকে ধানের শীষে নির্বাচন করার প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, ধানের শীষ প্রতীকে নির্বাচন জামায়াত করবে কিনা, এ বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করা যেতে পারে।
যদিও প্রকাশ্যেই জামায়াতের নেতারা জানিয়ে দিয়েছেন, স্বতন্ত্র প্রতীক নিয়েই একাদশ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবে তাদের প্রার্থীরা।
কেন্দ্রীয় একনেতা আরও বলেন, ‘খুব শিগগিরই আমাদের দলীয় ফোরামে বিষয়টি নিয়ে ফের বৈঠক হবে। ওই বৈঠক থেকেই সিদ্ধান্ত হতে পারে ধানের শীষ প্রতীক নেওয়া হবে কিনা। এক্ষেত্রে আরপিও ধারাগুলো আবারও পর্যালোচনা করবে জামায়াত।’
এর আগে, ২০০১ সালে চার দলীয় জোটের ব্যানারে ৩১টি, এরমধ্যে জোটবদ্ধভাবে ৩০টি এবং এককভাবে একটিতে নির্বাচন করে জামায়াত। ২০০৮ সালের নির্বাচনে ৩৯টি আসনে জোটগত সমর্থন পেলেও চারটি থেকে দলীয়ভাবে নির্বাচন করেন জামায়াতের প্রার্থীরা। দলটির তৃণমূলের অভিমতের ভিত্তিতে এবার তাদের দাবি ৬২টি। তবে চূড়ান্তভাবে ত্রিশটি আসনে ন্যূনতম ছাড় চায় জামায়াত।